অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২১)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

“আজ থেকে আঠারো বছর আগের ঘটনা….

এই চট্টগ্রামেই থাকতাম। আমার বীনুর বয়স তখন সবে পাঁচ। পিচ্চি মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াতো। বড্ড চঞ্চল মেয়ে ছিলো আমার। সারাক্ষণ মামা বাড়ি, মামা বাড়ি করেই থাকতো। অবশ্য ওর মামাবাড়ি বেশি দূরেও ছিলো না। গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা।

সে মাসে প্রায়শই ল্যান্ড লাইনে একটা কল আসতো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আমার স্বামী, বাসেদ আহমেদের নামে কেউ একজন যা তা বলতো। আমি ভীষণ ভালোবাসতাম বাসেদকে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। তাই কখনো টেলিফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে বাসেদকে সন্দেহ করিনি।

তখন ছিলো বর্ষা কাল। সকাল থেকে গুরি গুরি বৃষ্টি। আর এদিকে বীনুও মামাবাড়ি যাবার জন্য কান্না জুড়ে বসেছে। অগত্যা বাড়ির গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম।

কিন্তু, আমার মন সেদিন বড্ড কু গাচ্ছিলো। ঐ বাড়িতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। অশান্ত এই মনকে বোঝাতে না পেরে, বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। বৃষ্টি থেমে যেতেই বিকেলের দিকে বেরোলাম।

বাসেদ আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলো। এজন্য একাই চলে এসেছিলাম। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ির সামনে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে ব্রেক কষলাম।

পাহাড়ি রাস্তা ছিলো। একটা মেয়েকে আমার গাড়ির সামনে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।

মনের মাঝে একটা কথাই ছিলো,‘সুইসাইড করতে এসেছে নাকি এই মেয়েটি?’

জোরপূর্বক গাড়ি থেকে বেরোলাম। বেরোতেই মেয়েটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মস্তিষ্কে অনেক কথারা এসে ভীড় জমাচ্ছে।

নিস্তব্ধতার মাঝেই সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,’তোমার সাথে কথা আছে।’

মুহূর্তেই অবাক বনে গেলাম। আমায় চেনে?

‘কী কথা?’

‘বাসেদকে ছেড়ে দিচ্ছো না কেনো?’

‘আজব! আপনি কে? আর বাসেদকে ছেড়ে দিতে বলছেন কেনো?’

‘তোমার স্বামী আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু তোমার জন্য আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না।’

এমন কথা ল্যান্ডলাইনের সেই মেয়েটি বারবার বলতো। তবে কি এই সেই? মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। রেগে গেলাম ভীষণ ভাবে।

তেজ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,‘আমি বাসেদকে চিনি। এসব বানোয়াট কথা অন্য কাউকে গিয়ে বলুন না।’

‘ওহ্! বুঝেছি। এভাবে নিজ থেকে সরবে না। তোমার জন্য আরো একটা রাস্তা আছে।’

পাহাড়ি সরু রাস্তায় ছিলাম। হুট করে আমার হাত ধরে টেনে একদম কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আকস্মিক এমন আক্রমণ আমি বুঝতে পারিনি।

মহিলাটি বাঁকা হাসলো। পুনরায় বললো,‘বাসেদকে ছেড়ে যাবি নাকি এই দুনিয়া ছাড়ার ব্যবস্থা করে দেবো?’

‘দেখুন আপনি ভুল করছেন। বাসেদ আপনাকে না, আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মেয়ে আছে। আপনি এরকম করবেন না। দোহায় লাগে, ছেড়ে দিন।’

‘ওকে, ছেড়ে দিলাম।’—বলেই আমার হাত ছেড়ে আমাকে ধাক্কা দিলো। নিচে গড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি।“

এটুকু বলে মিসেস শেফালী থামলেন। পাশ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো গ্লাস পানি পান করলেন। পুরনো স্মৃতি গুলো যখন নিজের বর্তমানে প্রভাব ফেলে, হয়তো তখন সবার অবস্থা মিসেস শেফালির মতোই নাজেহাল হয়।

আরহান প্রশ্ন তুললো,“এরপর? পাহাড় থেকে ফেলার পরও?”

শেফালী বেগম আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করলেন,“ভাগ্য! ভাগ্য চেনো? সেটাই।

আমাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিলেও, সে জানতো না, ওপাশে খানিকটা নিচেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা আছে। বেশি নিচে ছিলো না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।

ঠিক তখনই ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সে আর কিছু না করেই চলে যায়।

মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম ভীষণ। সেই রাস্তা দিয়ে আশরাফ ভাই যাচ্ছিলেন। আমাকে ওরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, সাহায্য করেন। পার্শ্ববর্তী হসপিটালে এডমিট করেন।

জানেন? সেদিন আমার জীবনের দ্বিতীয় খুশির আগমনের কথা জানতে পারি। আমার প্রথম খুশি আমার বীনু ছিলো। আর দ্বিতীয় খুশি বাবুন।

সেদিন ডাক্তার আমাকে জানায়, আমি পুনরায় মা হতে চলেছি। এতো কষ্টের ভীড়েও সেদিন হেসেছিলাম আমি। আশরাফ ভাই সেই ক’দিন আমার পুরো খেয়াল রেখেছেন, যেমনটা আমার নিজের ভাই হলে রাখতেন।

প্রায় দুই মাসের মতো হসপিটালে ছিলাম আমি। উপর থেকে পড়ায়, তেমন চোট না পেলেও, মাথায়, হাতে আর পায়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছিলাম। পায়েরটা মারাত্মক ছিলো।

ডাক্তারের একটা কথা এখনও আমার কানে বাজে,‘ইট’স মিরাকেল। নয়তো এরকম কেসে বেবি বাঁচে না।’

দুই মাসে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার একটা দোষ ছিলো। টেলিফোন নম্বর মনে রাখতে পারতাম না। সেজন্য সবসময় একটা ডায়েরি সাথে নিয়ে ঘুরতাম, ওটাতে সবার নম্বর থাকতো।

সেবার আমার কাছে কিছুই ছিলো না।

দুইমাস বাদে আশরাফ ভাই আমাকে উনার বাড়িতে নিয়ে যান, দু’দিন থাকার উদ্দেশ্যে। সেখানে তানিয়া আপা আমাকে পছন্দ করতেন না। তবে, আশরাফ ভাইয়ের দশ বছর বয়সী ছেলেটা দুদিনেই আমাকে আপন করে নেয়। আমি বুঝে যাই, ভালোবাসার বড্ড অভাব সেই বাচ্চাটার।

দুদিন বাদে, আশরাফ ভাই আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এলেন। বাড়ির সামনে তাকাতেই আমি বড়সড় একটা ঝটকা খাই। নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

কি অদ্ভুত! মানলাম, আমি সবার কাছে মৃত। কিন্তু বাসেদ? সে কি করে এতো জলদি আমাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে গেলো?

গেটের উপর বিশাল আকারে সাইনবোর্ডে লেখা আছে,‘বাসেদ ওয়েডস মনিরা…’

পাশে থেকে একজন মহিলার কথা কানে এলো,‘হুননিডে, বউ ইভার আস্ট বছরের একগুয়া মেইপুয়া আচে।’

(শুনলাম, বউএর নাকি আট বছরের একটা মেয়ে আছে।)

অন্যজন বললো,‘তুই জানো না কন বেডির কথা কইর? মনত ন পড়ের? আগে এই ঘরত আইতো যে? বাসেদের বান্ধবী আছিল দে।’

(তুমি জানো না কার কথা বলি? মনে পড়ে? আগে এই বাড়িতে প্রায় আসতো যেই মেয়ে। বাসেদের বান্ধবী লাগতো)

‘বেডি ইভার আগের টুন সম্পর্ক আচিল ল?’

(মানে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?)

‘হ! আইয়ো হুইনি বাসেদ মাইয়া ইভার লাই বিয়া ন গরে, ইতের বাপে পরে দি যাই শেফালির লি বিয়া করাই দিইয়ে।’

(হ্যাঁ! শুনেছি বাসেদ নাকি এই মেয়ের জন্য বিয়ে করতে চায়নি। এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, পরে ওর আব্বা জোর করে শেফালির সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।)

আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলাম না। ধরে নিলাম, মেয়েটা আমাকে যা বলেছিলো, সত্যি বলেছিলো। বোরখা পরিহিত ছিলাম বলে, কেউ চিনতে পারেনি আমাকে।

ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে আশরাফ ভাইয়ের সাথে প্রস্থান করলাম। রওনা দিলাম বীনুর মামার বাড়ি।

কিন্তু….

সেদিন বাড়িতে পৌঁছতেই দেখি ঐ বাড়ি ফাঁকা। শুধু ঐ বাড়ি না। আশে পাশের প্রায় সব বাড়িই ফাঁকা। সরকার নাকি ওখানে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করবে, এজন্য কলোনী খালি করিয়েছে।

বুক ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এখন আমার বীনুকে কোথায় পাবো? মাথায় কিছুই আসছিলো না। একসাথে এতো ঝটকা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।

আশরাফ ভাই তখন আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে সেই বাচ্চা ছেলের চোখের মনি হয়ে উঠি। মিষ্টি করে আমাকে মামনি ডাকে। ধীরে ধীরে আমার বাবাইটার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাই আমি।

কিছুদিন বাদেই আশরাফ ভাই পরিবার সহ সিলেট শিফট করেন। আমিও তাদের সাথেই সেখানে চলে যাই।

নিজেকে যাতে বোঝা মনে না হয়, এজন্য আশরাফ ভাইয়ের অফিসে কাজে লেগে যাই। শুরু করি বাবুনকে নিয়ে নতুন জীবন।

সিলেট থাকতে থাকতে আমার বাবুন বড় হতে লাগলো। বাবুন থার্ড স্ট্যান্ডার্ডে ছিলো যখন, তখন একটা দুর্ঘটনায় আশরাফ ভাই আর তানিয়া আপা মারা যান।

বাবাই একরোখা হয়ে যায়। হুট করেই অনেক পরিবর্তন পাই বাবাইয়ের মাঝে। চোখে সবসময় কোনো এক আগুন জ্বলতো, যা ওর বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।

ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আশরাফ ভাইয়ের ছেলেটা তখন থেকে আমার ছেলে হয়ে গেলো।

বীনুকে ওর মামার কাছে রেখে এসেছিলাম বলে নিশ্চিন্ত মনে ছিলাম আমি। তবুও বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু, যেই শহর জুড়ে বিশ্বাস ঘাতকতা ছেঁয়ে ছিলো, সেই শহরের হাওয়া সহ্য হতো না।

চার মাস আগে, বাবুন হুট করেই বলে ফেলে, ও চবিতে পড়বে। আমি মানা করে দেই। তাই ও গিয়ে ওর ভাইকে বলে। অগত্যা ওদের জোরাজুরিতে ফিরতেই হলো। আশরাফ ভাই ছাড়া কেউ আমার অতীত জানতো না। বড় হবার পর বাবাই জেনে যায়, আমিও ধোঁকা খেয়েছি, এই শহর থেকে। আর কিছুদিন আগে বাবুন আমার ডায়েরি পড়ে জেনে যায় সবটাই।”

মিসেস শেফালী কথা শেষ করেন। এটুকুই তো কাহিনী। কেটে ছেটে এটুকুই তো আছে।

এতক্ষণ গভীর মনোযোগে সবটা শোনার পর আরহান বললেন,“মিসেস মনিরা ডাবল গেইম খেলেছেন।”

মিসেস শেফালী চকিতে চাইলেন। উনার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান বললেন,“আপনি যা জেনেছেন, তা ছিলো আংশিক সত্যি। পুরো মিথ্যের চেয়ে আংশিক সত্যি বেশি ভয়ংকর।”

_____________________

“ভালোবাসা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি কোনটা যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হতো! তবে কোনো সময় ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় বলে দিতাম, এটা ভালোবাসা। ভালোবাসার উপলব্ধির পূর্বকাল থেকেই সুখ অনুভব করা যায়। আর প্রতিক্ষণ মনটা উত্তেজিত হয়ে থাকে। কখন আমার প্রিয় মানুষটি আমার নেত্র সম্মুখে আসবে, দুচোখ ভরে দেখবো। আর…. হ্যাঁ! ভীষন লজ্জা পাবো।”

ডায়েরিতে এটুকু লিখে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিলাম। অবশেষে মনের ভালোবাসা মুখে নিয়ে এলাম। দুপুরের দিকে যে, আরহানকে বললাম। এরপর থেকে আর আরহানের সামনেই আসিনি। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। উনি কাছে এলেই সব কথা আওলিয়ে যাচ্ছে।

খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু সাজতে। আচ্ছা! আরহান যদি বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বউ তার জন্য সেজে বসে আছে, তখন আরহানের মুখখানা কেমন দেখাবে? বিস্মিত হবেন নিশ্চয়ই!

হালকা হেসে কাবার্ড থেকে একটা গোলাপী সুতির শাড়ি পরে নিলাম। সাথে কালো ব্লাউস। আয়নায় এক ফাঁকে কোমরের এই বেলী চেইন দেখে নিলাম। মাথা নিচু করে হাসলাম। সেদিন আরহান স্বীকার করেছেন, এটা উনিই দিয়েছিলেন।

চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল খোঁপা করে নিলাম।

হুট করেই পেছন থেকে কারো আলিঙ্গনে আমি স্তব্ধ, পাথর বনে গেলাম। শরীরের থরথর কাঁপুনি আমার বিস্মিত হবার বহিঃপ্রকাশ। কানের কাছে কারো ওষ্ঠের স্পর্শ পেলাম। সর্বাঙ্গে শিহরন ছেয়ে যাচ্ছে।

ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভালোবাসি শুকতারা…”

চলবে…