অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৯)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

সকালের মৃদু আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললাম। মাথা ভার লাগছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বসে থাকতেই হুট করেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। লোকটা আরহানের কথা বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। শেষবার যখন জিজ্ঞেস করলাম,“কি হচ্ছে এটা?”

লোকটা বাঁকা হেসে “ধোঁকা” বলেই আমার মুখের সামনে কিছু একটা স্প্রে করলো। এরপর… এরপর কি হয়েছিলো? উফফ! মনে পড়ছে না কেনো?

তখনই রুমে প্রবেশ করলো একটা মহিলা। আমাকে বললো,“ম্যাম! আপনি উঠে পড়েছেন? ফ্রেশ হয়ে নিচে চলুন ব্রেকফাস্ট করতে। স্যার ডেকেছেন।”

মহিলাটি এই বাড়ির মেইড হবে হয়তো। কেনো যেনো প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও শান্ত কন্ঠে বললাম,“আপনার স্যারকে ডাকুন।”

মহিলাটি “আচ্ছা” বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

কিছুক্ষণ বাদেই রুম নক করার সাউন্ড পেলাম। ততক্ষণে আমি বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওপাশের লোকটি ভেতরে ঢুকতেই আমি তাকালাম।

নীলাভ চক্ষু দ্বয়ের এই সুদর্শন পুরুষকে দেখতেই মনে পড়লো ভার্সিটির নবীন বরণের দিনের কথা। মনে পড়ে গেলো, সেদিন রুদ্রের সাথে আরহানের সেই কথাগুলো। চোখ দুটো বড় বড় করে মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম,“তৃষ্ণা!”

তৃষ্ণা মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। এরপর বললো,“ইয়াহ! আই এম।”

হুট করেই রাগ এবং বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো আমার। সাথে ভয়ের সংমিশ্রণ আছেই। আমাকে ধোঁকা দিয়ে তুলে আনলো! কিছু করবে না তো আবার!

“দ’দেখুন! আপনি আমাকে এখানে এনেছেন কেনো?”

তৃষ্ণার সহজসরল স্বীকারোক্তি,“ভালোবাসি তাই..”

ভয় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলাম,“ভালো হচ্ছে না, আরহান জানতে পারলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে।”

ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো,“আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আরহান আপনাকে ভালোবাসে কি না জানিনা, তবে আপনাকে আমার মতো এতো ভালোবাসতে পারবে না কেউ।”

আমি ভালোবাসায় বড্ড ভয় পাই। এর চেয়ে সুখের কিছু নেই, আবার এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হতে পারে না। এর চেয়ে বড় পুরষ্কার কেউ পায়নি। এর চেয়ে ধারালো অস্ত্র এখনও তৈরি হয়নি। হালকা আওয়াজে বললাম,“যেতে দিন আমাকে।”

“কিন্তু কেনো?”

“কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

“আপনি শুধু পাশে থাকবেন, আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।”

“পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? আমি বললাম তো ভালোবাসি না আপনাকে।”

তৃষ্ণার কণ্ঠস্বর হঠাৎ পরিবর্তন হলো। মাঝে তীব্র এক রাগের আভাস পাওয়া গেলো। বললো,“আমাকে মেনে নিলে সমস্যা কি? বারবার বলছি তো, আপনাকে ভালোবাসি আমি।”

আমি ভীত হয়ে বললাম,“আরহানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে,এটা জানেন?”

তৃষ্ণা একই কন্ঠে রাগের তেজ বাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ! ও সবসময় আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে হারাতে চায়। এজন্যই আপনাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি আরহানের কাছে হারতে পারলেও, আপনাকে হারাতে রাজি নই নয়নতারা।”

“ভুল। উনি আপনার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি। বরং আপনার কাছ থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। আপনি তো সেদিন প্রথম দেখলেন আমাকে। আর আরহান! সে দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসে আমাকে।”

তৃষ্ণার কপাল কুঁচকে এলো। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে জোরপূর্বক হেসে বললো,“সে বাসুক। আপনি তো বাসেন না। তাই না? আর আপনার বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? বাচ্চার মা হলেও আমার আপনাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”

“আপনি ভুল করছেন।”

“ভালোবাসা যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আমি এমন সহস্র ভুল করতে রাজি আছি।”

স্থির চাহনি ফ্লোরে নিক্ষেপ করে বললাম,“আমি আরহানকে ভালোবাসি।”

কিভাবে বললাম জানিনা। তবে, বলে ফেললাম। আর অনুভব করলাম, এটা সত্যি।

সামনে তৃষ্ণার নীল চক্ষুর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, তৃষ্ণা এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,“সে ইট এগেইন…”

এতক্ষণের ভয় ভীতি সব ভুলে পুনরায় বললাম,“ভালোবাসি আরহানকে।”

গম্ভীর তৃষ্ণার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বুলি আওড়ালো, “শিট! এবারও… এবারও…”

চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললো। যেনো এই পাঁচ মিনিটে পুরনো অনেক কিছু কল্পনা করে নিলো।

আমার দিকে তাকালো তৃষ্ণা। এগিয়ে এলো খানিকটা। আমি দূরত্ব বজায় রাখতে সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম।

আমার এমন করা দেখে তৃষ্ণা নিজেও দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত হালকা সামনে তুলে বললো,“ভয় পাবেন না। আমি কাছে আসছি না।”

শান্ত কন্ঠে এরকম কথায় ভয় কমলো। তবে গেলো না।

তৃষ্ণা পুনরায় বললো,“কিছু বলতে চাই। আই প্রমিজ, এটাই শেষ বার।”

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তৃষ্ণা আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখেই বললো, “জীবন আমাকে কিছু দিতে পারেনি। আমার পাওয়া জিনিসগুলো ছিনিয়েই নিয়েছে শুধু। তন্মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্খিত আপনি। জীবন সেই আপনিটাকেই আমার হতে দিলো না। এর জন্য রয়েছে শুধুই আফসোস!”

তৃষ্ণা হাঁটু মুড়ে আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখে বললো,“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মিথ্যায় ঘেরা জীবনের একটি মাত্র সত্যি, আপনাকে ভালোবাসি।”

আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। তৃষ্ণা পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিয়ে বললো,“ম্যামকে বাড়ি দিয়ে এসো।”

এরপর আমার দিকে তাকালো। এই চোখে অনেক কিছু আছে। যা আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু, আমি জানতে চাই না।

তখন তৃষ্ণা হালকা হাসলো। বড্ড অদ্ভুত এক হাসি ছিলো। বললো,“বাইরে গাড়ি রাখা আছে। আমার লোক, আপনাকে সেইফলি আপনার বাড়ি দিয়ে আসবে।”

আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। পাশেই আমার ফোন রাখা ছিলো। নিয়ে জলদি বেরিয়ে পড়লাম।

___________________

বাড়ি ফিরতে ফিরতে তখন বেলা এগারোটা বেজে গেলো। বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেখেই মা পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে এলেন। আপাদমস্তক দেখে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

এরপর আমাকে ছেড়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,“তুই কোথায় চলে গিয়েছিলি? ঠিক আছিস মা? আরহান তোকে বাড়ি থেকে বেরোতে না করে দিয়েছিলো না? কেনো গিয়েছিলি?”

মুহূর্তেই আরহানের কথা মাথায় আসায় জিজ্ঞেস করলাম,“আমি তো ঠিক আছি। তবে আরহান! উনি কোথায়?”

“তোকে খুঁজতে বেরিয়েছে।” —বলেই মা উচ্চকন্ঠে নিশাকে ডাকলেন। নিশা এসে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“ভাবি! কোথায় ছিলে তুমি? জানো ভাইয়া তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই পাগল হয়ে গিয়েছে। এতোটা কাতর অবস্থায় ভাইয়াকে কখনো দেখিনি।”

মা নিশাকে বললেন,“আরহানকে কল দিয়ে বল, বীনি বাড়ি ফিরেছে।”

নিশা তখনই আরহানকে কল দিলো।

নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। মাথাটা ব্যাথা করছে। হঠাৎ সেখানে আরহান প্রবেশ করলেন। দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রস্তুত আমি এখন আরহানের বুকে। উনার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হৃদপিন্ড অনেক দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। যেখানে আমার হৃদযন্ত্র থমকে গিয়েছে।

“এখন… এখন আমি বেঁচে গেলাম। আরেকটু হলে, সত্যিই মরে যেতাম।”

কাতর ও অস্থির কণ্ঠস্বর আরহানের। বুকটা ধুক করে উঠলো। সত্যি তো! আরহান আমাকে অনেক খুঁজেছেন। উনার এই অস্থিরতা তো আমারই জন্য।

মিনিট দশেক পর আমাকে ছাড়লেন। এতক্ষণ মুখ লুকোনো থাকলেও, এখন চেহারায় লজ্জার রেশ ফুটে উঠেছে। আরহান আমার এই লাজে রাঙা মুখের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,“না করেছিলাম না? বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করেছিলাম না? কেনো বেরোলে?”

চকিতে চাইলাম আরহানের পানে। আরহান আমার সাথে কখনোই রাগ দেখাননি। আজ প্রথম উনার কন্ঠে এমন তেজ লক্ষ্য করাতে স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়েছি। এতে আরহানের রাগ বাড়লো বৈ কমলো না। আমার দুই বাহুতে ঝাঁকিয়ে বললো,“কিছু জিজ্ঞেস করেছি না? আজ যদি ঐ তৃষ্ণা কিছু করে দিতো?”

কেঁপে উঠলাম। সাথে ভয় ও পেয়ে গেলাম। এই আরহানকে চিনিনা আমি।

“স্পিক আপ..”

আবারও কেঁপে উঠলাম। আরহান এই রাগ নিয়ে কখনো কথা বলেননি আমার সাথে। তাই আর সময় অপচয় না করে ব্যক্ত করলাম,“তৃষ্ণা বলেছিলো আপনার ক্ষতি করে দিবে। এজন্য গিয়েছিলাম।”

“আর তাই তুমি বিশ্বাস করে নিলে? এতোটা গাঁধা কী করে হলে? বাড়িতে কাউকে না বলে চলে গেলে!”

আমি অশ্রুসজল নেত্রে চেয়ে রইলাম। কী করে ভাবতাম তখন অতো কিছু? তৃষ্ণা যে আরহানের ক্ষতির কথা বলছিলো।

আরহান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। বেড সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলেন।

হুট করেই আরহান তাকালেন আমার দিকে। চাহনিতে অন্য কিছু রয়েছে।

অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“আমার ক্ষতি করে দেবে বলে তুমি গিয়েছিলে?”

“হুঁ..”

“কেনো?”

আমিতো এখনও আরহানের নতুন রূপ দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে আছি। তাই অতো কিছু না ভেবে উত্তর করে যাচ্ছি। কিন্তু শেষের এই ‘কেনো’ টা আমাকে বোঝালো আরহান আমার মুখ থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে।

আমি চুপ হয়ে গেলাম।

আরহান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তৃষ্ণার কাছ থেকে পালিয়ে আসলে কী করে? যতদূর ওকে চিনি, ওর হাত থেকে পালানো অসম্ভব।”

“পালাইনি।”

আরহান সজোরে বলে উঠলেন, “হোয়াট?”

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,“না পালালে এলে কি করে? এখন আবার এটা বলো না যে তৃষ্ণা নিজেই তোমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ এটা সম্ভব নয়।”

“তৃষ্ণা নিজেই আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে।”

আরহান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললেন,“ইম্পসিবল….”

“জানিনা আমি কিছুই। তবে আমার কোনো ক্ষতি করেননি উনি। ইন ফ্যাক্ট আমার হাত অবদি ছুঁয়ে দেখেননি। সকালে জ্ঞান ফিরতেই তৃষ্ণা আমাকে বলে, উনি আমাকে ভালোবাসেন….”

“এক মিনিট! তৃষ্ণা তোমাকে ভালোবাসে?”

“উনি তো তাই বললেন।”

আরহান কপালে হাত রেখে আস্তে বুলি আওড়ালেন, “ওহ্ গড! সেই আগে থেকেই ওর কেনো আমার জিনিসটাই পছন্দ হওয়া লাগে!

আরহান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“ভালোবাসে! তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিলো কেনো?”

“কারণ আমি বলেছি, আমি উনাকে ভালোবাসি না।”

“শুধু এজন্যেই ছেড়ে দিলো?”

“নাহ্!”

“তবে?”

“আমি বলে দিয়েছি,‘আমি আরহানকে ভালোবাসি’। তাই ছেড়ে দিলো।”

“সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কী বলেছি।

চলবে…