“ভালোবাসি। মনের মণিকোঠায় ভালোবাসা নামক শব্দের আগমনের আগে থেকেই ভালোবাসি। হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি। ভীষন রকমের ভালোবাসি।”
নিশার ফোনালাপের এটুকু বক্তব্য শুনতেই রুদ্রের হৃদপিন্ডের স্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে গেলো। যেনো থমকে গেলো সব। প্রিয় মানুষটির মুখে ভালোবাসার শব্দগুলো ভীষণ সুখময় হয়, তবে তা কেবলমাত্র নিজের ক্ষেত্রে। যখন প্রিয় মানুষটি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে সেই একই শব্দগুলো বলে, তখন তা থেকে বিষক্রিয়া শুরু হয়। যেমনটা এখন হচ্ছে রুদ্রের মনে। পরবর্তী কোনো কথা কানে এলো না রুদ্রের। এক বুক যন্ত্রণা সহিত অতি দ্রুত প্রস্থান করলো সে। ভালো লাগছে না তার। এই দুনিয়ার কিছুই তার ভালো লাগছে না। ভালোবাসায় যে এতো যন্ত্রণা! এটা আগে জানলে কখনো, কোনো মানুষ, কাউকে ভালোবাসার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতো না।
রুদ্রের যাওয়া আসা কোনোটাই টের পেলো না নিশা। সে তো বিশাল ব্যস্ত তার বেস্ট ফ্রেন্ড, রাহার সাথে কথা বলতে।
“না রে রাহা! রুদ্র ভাইয়া এখনও আমার অনুভূতি বোঝে না। তাকে সত্যি আমি অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।”
“তুই ভাইয়াকে বলেছিস তোর মনের কথা?”
“আজব! আমি কেনো বলতে যাবো? আর তাছাড়া উনি তো আমার প্রতি তেমন কিছু ফিলই করে না। যদি ভাইয়াকে বলে দেয় এসব?”
“থাক! বুঝলাম। তোর দ্বারা কিছুই হবে না।”
“দেখ! তুই কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।”
এভাবেই চলতে লাগলো রাহা আর নিশার কথা বার্তা।
_____________________
বেশ কিছুদিন ধরে রুশীর শরীর খারাপ করছে। খাবারে অনীহা আর দুর্বলতা যেনো দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে, রাতের খাবার খেতে পারলো না সে। গা গুলিয়ে এলো। যার দরুন খাবার রেখেই উঠে রুমে চলে আসতে হলো তাকে। শরীরের এমন অবনতি চিন্তায় ফেলছে তাকে। হঠাৎ রুশীর আবার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। বুঝতে পেরেই দ্রুত বেগে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীর চলছে না আর। এভাবেই রাতে খেতে পারেনি। তার উপর যেটুকু খেয়েছিলো তাও বমি করে এলো। আর পারছে না রুশী। চোখ বুজে এলো।
সকালে ঘুম ভাঙতেই রুশীর চোখ যায়, তার পাশে শুয়ে থাকা মারুফের দিকে। একজন স্বামীর ঠিক যেই যেই গুন থাকা লাগে, সব আছে। কিন্তু মেয়েরা তো স্বামীর মধ্যে প্রেমিক খুঁজে। যে যত্ন করবে, ভালোবাসবে। রুশী সেরকম কিছু পায়নি। তার স্বামীর কাছ থেকে যা পেয়েছে, সবটাই দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভালোবাসা নামক শব্দ থেকে এই সংসারটা একদম অপরিচিত। খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিয়েছে তার স্বামী। কিন্তু সুখ কি এতেই সীমাবদ্ধ? অবশ্য রুশী নিজেও তো এখনও তাকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম রাতের মতো যতবার মারুফ কাছে এসেছে, ততবার রুশীর অস্বস্তি হয়েছে। দমবন্ধ হয়ে এসেছে। বার বার ইচ্ছে হয়েছে, যদি চোখটা বন্ধ করলেই সারাজীবনের মতো চোখ বন্ধ হয়ে যেতো!
চোখ বুজে মনে মনে আওড়ালো,“শরীরের সাথে শরীরের সন্ধি হয়ে কি হবে? যেখানে দুটো মন এখনও দুজনের অজানা আর আলাদা। এটাই তো মুখ্য বিষয়।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুশী। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা বড্ড কষ্টের। পুনরায় মস্তিষ্কে প্রশ্ন এলো,“আচ্ছা! অয়ন কেমন আছে?”
হয়তো রুশী ভালো নেই বলেই মস্তিষ্কে এমন প্রশ্ন এলো। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুশী। মাথা ঘুরে এলো। পুনরায় বিছানায় বসে পড়লো। এতো দুর্বল লাগছে কেনো?
_________________
দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দু’সপ্তাহে আরহান আমাকে পড়াশোনার উপরে রেখেছে। সত্যি বলতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। মানে, উনার মনে কি দয়া মায়া নেই নাকি?
সকালে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে একটা হলুদ থ্রি-পিস পরে নিলাম। আজ অনেক দিন পর শাড়ি বাদে অন্য কিছু পরেছি। তাই নিজেকে কেমন যেনো লাগছে নিজের কাছে।
আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই আমিকে দেখছি। কতোটা পাল্টে গিয়েছি আমি! আগে শাড়ি পরতেই হিমশিম খেতাম। আর আজ সেই আমিই শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে অস্বস্তি বোধ করছি। চেহারায়ও পরিবর্তন এসেছে। হয়তো সুখময় জীবন অতিবাহিত করার পরিণাম এই চেহারায় লক্ষণীয় হয়েছে।
“শুকতারা! হয়েছে তোমার? যেতে হবে তো নাকি। তার আগে খাওয়াটা মাস্ট।”
কথাটা শেষ করেই খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন আরহান। কাছে এসে আমাকে বসতে বলে, নিজেও আমার সামনে বসে পড়লেন। অতি সন্তর্পনে মুখে তুলে খাওয়াতে লাগলেন।
আরহানের হাতে খেতে খেতেই প্রশ্ন তুললাম,“আপনি খেয়েছেন?”
“পরে।”
“না। পরে কিসের? এখনই খাবেন।”
আমার কথায় আরহান হাসলেন। ঠিক কি কারণে হাসলেন, তা আমার মস্তিষ্কে ধরেনি। একই প্লেট থেকে আরহানও খাওয়া শুরু করলেন।
_________________
আরহান আমার সাথেই ক্যাম্পাসে এসছেন। এখন আমাকে এখানে রেখে চলে যাবেন। আবার এক্সাম শেষ হতেই আমাকে নিতে আসবেন। গাড়ি থেকে আরহান আগে নেমে তারপর আমাকে নামালেন। আমি “বাই” বলে চলে যেতে নিলেই আরহান আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি পিছে ফিরলাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,“ঠান্ডা মাথায় এক্সাম দিয়ো। যেগুলো পারবে সেগুলো আগে এনসার করবে। কোনো এনসার মনে না পড়লে হাইপার হবে না। অনেক ভালো মতো পড়িয়েছি তোমাকে। সব পারবে তুমি। শুধু মাথা ঠান্ডা রেখো।”
আরহানের কথা শেষ হতেই আমি “আচ্ছা” বলে চলে আসতে নিলেই, পুনরায় আরহান আটকালেন আমাকে। দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন, “খেয়াল রেখো। আমি তোমার মনে আছি বলে আবার এক্সাম পেপারে আমাকে নিয়ে লিখে এসো না।”
লজ্জায় গাল দুটো রক্তিম হয়ে এলো। এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে এলাম।
কিছুটা এগোতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটিকে দেখে চোখ থমকে গেলো আমার। পরনে জলপাই রঙের শাড়ি। স্বর্ণের নাকফুল, চুড়ি। কপাল কুঁচকে এলো। এসব পরে ক্যাম্পাসে এসেছে কেনো রুশী? হন্যে হয়ে এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে। আমাকে দেখেনি এখনও।
এগিয়ে গেলাম রুশীর দিকে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠলো রুশী। দ্রুত আমার দিকে ফিরতেই আমি প্রশ্ন করে বসলাম,“এতদিন পর? কই ছিলি তুই?”
আমাকে দেখে রুশীর চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলেও, আমার প্রশ্নে ওর ভেতরের চাপা রাগ বেরিয়ে আসছে। রুশী রাগী নয়। রাগের ছিটে ফোঁটাও নেই ওর মাঝে। কিন্তু কষ্টের পরিমাণটা যে এতো বেশি হয়ে গিয়েছে! এই কষ্টময় জীবনের জন্য রুশী নিমিষেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলো। সেদিন যদি আমাকে ও পেতো, তবে কখনোই এই বিয়ে করার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না রুশী। অতিরিক্ত কষ্ট, যন্ত্রণায় রুশী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। যার দরুন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। সেই মুহূর্তে আমাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু পায়নি।
চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,“আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
রুশীর উত্তর আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিলো। কিছুক্ষণ বাদে হেসে ফেললাম।
“দেখ রুশী। এতদিন বাদে দেখা হচ্ছে। মজা নিস না তো। অয়ন কোথায় এটা বল।”
আমার এহেন প্রশ্নে রুশীর কণ্ঠের তেজ বেড়ে গেলো। অনেকটা চিল্লিয়েই বলে উঠলো,“মাথা খাস না। সর এখান থেকে। কাজ আছে আমার।”
চলে গেলো রুশী। এই রুশী একদম আমার অপরিচিত। বিস্মিত, চমকিত আমি চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। রুশী এমন করলো কেনো? আর অয়ন কোথায়? অয়নের নম্বর ডায়াল করলাম। কল দিতেই প্রতিবারের মতো এবারও সুইচ অফ দেখাচ্ছে।
পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিলাম অয়নকে। পেলাম না।
_____________
এক্সাম দেয়নি অয়ন। নেহার কাছে শুনলাম, আজই নাকি রুশী ক্যাম্পাসে এসেছে। গত তিনমাসে আমার মতো রুশীও আসেনি। আর অয়ন নাকি প্রথম দুইদিন এসেছিলো। এরপর সে ও লাপাত্তা। অনেক কষ্টে অয়নের বাবার নম্বর জোগাড় করলাম।
ক্যাম্পাসের পেছনের এই বকুল গাছ তলায় এসে দাঁড়ালাম। আরহানের আসতে একটু সময় লাগবে বলে আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। একা একা বেরোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
ফোন বের করে অয়নের বাবার নম্বরে কল লাগলাম। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলেন একজন মহিলা।
আমি সালাম দিলাম। ওপাশের মহিলা সালামের জবাব দিলেন। কন্ঠটা কেমন যেনো শোনাচ্ছে। অসুস্থ হয়তো।
“কাকে চাই?”
“এটা অয়নের বাবার নম্বর!”
মহিলাটি “হ্যাঁ” বলেই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“কে বলছো?”
“আমি অয়নের বন্ধু।”
“ওহ্! কি জন্য ফোন দিয়েছো?”
“আসলে। অয়নের খোঁজ নিতে। কোথায় আছে ও?”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় কাটলো। এরপর তেজী কন্ঠে বললো,“অয়ন তো আমাদের সাথে থাকে না। ওখানেই থাকে। তাহলে তোমরাই তো ভালো জানবে। তাইনা? কলেজে উঠে সেই যে ঝগড়া করে বাড়ি ছাড়লো, এরপর কি আর ফিরেছে? নাকি ফেরাতে পেরেছি আমরা? এই রগচটা ছেলে যে কি করে আমার গর্ভে এলো, জানি না আমি। সত্যি জানিনা। আর তোমাকেও বলছি, এই ছেলের জন্য আর কোনোদিন কল দেবে না।”
অয়নের মা ছিলো! কল কেটে দিলো অয়নের মা। অয়ন কখনো ওর পরিবারের কথা আমাদের কাছে বলেনি। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে। অয়ন যে অনেকদিন আগে থেকেই পরিবারের সাথে থাকে না, এটা বলেনি। একটা শ্বাস ফেললাম। ছেলেটা গেলো কই! আর রুশীরই বা হলো টা কি? চিন্তিত আমি ওভাবেই বকুল গাছের নিচে বসে পড়লাম।
_____________________
দুই ঘণ্টা ধরে হসপিটালের করিডোরে বসে আছে রুশী। কিছুক্ষন আগেই কিছু টেস্ট করিয়েছে। এতদিনের অসুস্থতা ওর কাছে ভালো লক্ষণ লাগছে না। ও নিজেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। সিউর হবার জন্যই টেস্ট গুলো করালো।
রুশীর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কিছু মাস আগেও তো কত ভালো ছিলো! হাসি খুশি ছিলো! সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগেই থাকতো। জীবনের মানে তখন তার কাছে কেবল হাসি,আনন্দ,সুখ ছিলো। কষ্ট লাগতো না তো! ওর সামান্য কষ্টতে যে ওর প্রিয় মানুষের বুকে রক্তক্ষরণ হতো। আজ সেই প্রিয় মানুষ নেই। সব উল্টে গিয়েছে রুশীর। হয়তো ক’দিন বাদে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু না পাবার দীর্ঘশ্বাস নিয়েই আজীবন কাটাতে হবে রুশীর। এক অন্তরীক্ষ কষ্টের সাথে কিছু অপূর্ণতা নিয়েই চলতে হবে বাকিটা জীবন। কান্না পাচ্ছে রুশীর। কিন্তু চোখের জল যে সেই কবেই শুকিয়ে গিয়েছে।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে উচ্চারণ করলো রুশী,“যদি ভাগ্যে তুই না’ই ছিলি, তবে কেনো এলি জীবনে?”
কিছুক্ষণ বাদে একটা নার্স এগিয়ে এসে বললো,“ম্যাম! ডক্টর আপনাকে ডেকেছে।”
রুশী এগিয়ে গিয়ে ডক্টরের কেবিনে ঢুকলো।
_______________
স্তব্ধ, বিমূঢ় রুশী চুপচাপ বসে আছে নিজের ঘরে। হাতে তার রিপোর্ট। মাথায় ঘুরছে ডক্টরের সেই একটা কথাই। রুশীকে দেখে বিন্দুমাত্র ধারণা করার উপায় নেই যে ও অতিরিক্ত খুশিতে কথা হারিয়ে ফেলেছে নাকি তীব্র কষ্টে বাকশক্তিহীন হয়ে গিয়েছে। হয়তো একটাও না। আবার হয়তো দুটোই। একবার পুনরায় রিপোর্টে দেখে নিলো। নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। মুচকি হাসলো। তবে বেশিক্ষণ থাকলো না এই হাসি। মুহূর্তেই নিভে গেলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। বুকটা হাহাকার করছে রুশীর। ভাগ্য এতো নির্মম কেনো?
আবারও ডক্টরের কথা মনে পড়লো। যখন সে বলেছিলো, “কংগ্রাচুলেশন মাই ডিয়ার। তুমি মা হতে চলেছো। তোমার প্রেগন্যান্সির আড়াই মাস চলছে।”
চলবে…