অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১০)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

রুশী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে নিজের রুমে। মাথা নিচু। চাহনি ফ্লোরে। মস্তিষ্কে কিছু মানুষের স্বার্থপরতা আর মনে রয়েছে ভালোবাসার উপলব্ধির আগেই ইতি বিষয়ক যন্ত্রণা। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে রুশীর।

সামনে দাড়িয়ে আছে রুশীর মা ও বাবা। চাহনি স্থির তাদের। কোনো আফসোস নেই। যেনো তারা কোনো অন্যায় করেনি। তবুও নিজেকে এক্সপ্লেইন করার জন্য রুশীর বাবা বলে উঠলেন,“আমরা কি তোর খারাপ চাই মা? যা করছি এতে তো তোর ভালোই হবে।”

রুশী ছলছল নয়নে তার বাবার পানে তাকালো। চোখ দুটো ভয়ঙ্কর রকমের লাল হয়ে আছে। ইতিমধ্যে রুশীর সমস্ত মুখশ্রী লাল হয়ে গিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো। এ যেনো রুশীর বিধ্বস্ত এক রূপ।

মেয়ের এমন অবস্থা দেখেও তাদের খুব একটা সমস্যা হলো না। ভাবলো, হয়তো তাদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য মন কেমন করছে রুশীর। ব্যাপারটা এই পর্যন্তই রাখলো তারা।

“আমাকে নিয়ে ড’ডিল করলে তোমরা? তোমাদের বন্ধুত্বের জন্য আ’আমাকে নিয়ে ডিল করে ফেললে? আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? আ’আমি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছি, ন’না?”

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে রুশীর চোখের বাঁধ ভেঙে নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে।

রুশীর মা এতে একটু রেগে গিয়েই বললো,“এতো রিয়েক্ট করার কি আছে রুশী? বিয়ে কি কেউ করে না নাকি?”

“তাই বলে আমাকে জানাবেই না?”

রুশীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে ওর বাবা মা। রুশীর বাবা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওর মা ওর বাবাকে থামিয়ে বলে উঠলো,“এতো কষ্ট করে মানুষ করেছি তোকে আমরা। এইটুকু অধিকার নেই তোর উপর?”

হুট করেই রুশী থমকে গেলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার ওর বাবা মাকে দেখে নিলো। এতোটা আশা করেনি।

রুশীর মা পুনরায় বললো,“দেখ! ছেলে আর ছেলের পরিবার সব দিক থেকেই ভালো। টাকা পয়সায়ও কমতি নেই।”

রুশী হাসলো। তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসলো। পুনরায় ফ্লোরে তাকালো। বাবা মা তার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে। দিয়ে দেবে কি? নাকি নিজের সুখটা বেছে নেবে? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে রুশী। বুকে কেমন যেনো এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কিছু পাবার আগেই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা বড্ড পোড়ায়। রুশীর স্থির দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ রেখেই বললো,“আমি রাজি।”

রুশীর বাবা মা খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কথাটা রুশীর জন্য বলা এতোটা সহজ ছিলো না। কিন্তু, বাবা মায়ের উপর বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি রুশী। তাই তো নিজেকে বলি দিলো।

রুশীর বাবা মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বললো, “ভুল বুঝিস না রে মা। বাবা মা তাদের সন্তানের খারাপ কোনোদিনও চায় না। একদিন এই সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে বেশি তুই’ই খুশি হবি।”

রুশী নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। যেনো এক পাথর হয়ে গিয়েছে। রুশীর মা মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললো,“তাহলে মারুফ ভাইকে কল দিয়ে বলে দাও, তাড়াতাড়ি বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে।”

রুশীর বাবাও খুশি মনে হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরোলো, তার কলেজ জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে খবর দিতে। সাথে রুশীর মা ও গেলো।

যাবার সময় রুশীর মা দরজাটা টেনে দিয়ে গেলো। সেই শব্দ হবার সাথে সাথেই রুশী চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। কার্নিশ বেয়ে পুনরায় অশ্রুধারা বইছে। রুশী বাকরুদ্ধ। কি বলবে এখন? কি’ই বা বলার আছে? কি’ই বা করার আছে? ধপ করে বেড থেকে ফ্লোরে বসে পড়লো। বন্ধরত নয়ন এখন তার মুখ বিচরণ করছে, যাকে দেখলে রুশীর সুখ লাগতো। ধন্য হতো চক্ষুদ্বয়। ভাবনায় পুরনো দিনের সেসকল কথা ভেসে আসছে, যা ছিলো রুশীর একান্ত প্রিয়জনকে ঘিরে।

অয়ন! ছেলেটা কখনো বলেনি, কতোটা ভালোবেসেছে। চুপ থেকেই ভালোবাসার সহস্র রঙের সাথে পরিচয় করিয়েছে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে। একদম গোপনে।

আবারো খানিকটা হাসলো রুশী। ছেলেটা পাগল ছিলো রুশীর জন্য। ওকে ছাড়াতো অয়ন থাকতেই পারতো না। রুশীর সামান্য কষ্টও সহ্য করার ক্ষমতা ছিলো না। একটু কিছুতেই কি রিয়েক্টই না করে ফেলতো। সেখানে…

ফট করে চোখ মেললো রুশী। অয়ন যদি এসব জেনে যায়? ও তো খুন করে ফেলবে সবাইকে। বা দিকে তাকাতেই, আয়নায় নিজের এই বিধ্বস্ত রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তার অয়ন তো তার তিল পরিমাণ কষ্টও সহ্য করতে পারে না। এভাবে দেখলে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে অয়ন। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচলের শেষাংশ দিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে ফেললো। এলো মেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গোছানোর চেষ্টা করলো। পুরোপুরি না হলেও খানিকটা সফল হলো। অশ্রুভেজা চোখে নিজেকে আয়নায় দেখে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি আনার চেষ্টা করলো। হাসলো। তৎক্ষণাৎ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।

কান্না মিশ্রিত কন্ঠে উচ্চারণ করলো,“তোকে খুব ভালোবাসি অয়ন। খুব ভালোবাসি।”

কিছুক্ষণ কান্না করতে করতে হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হলো রুশীর। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“যাকে ঘিরে আমার পুরো পৃথিবী ছিলো, আজ এই পৃথিবীতে সে আমার জন্য নিষিদ্ধ।”

____________________

পিটপিট করে চোখ মেললাম। রুমে লাইট অন করা। রাত্রির শেষ প্রহর চলছে। চক্ষুদ্বয় সিলিংয়ে নিবদ্ধ থাকতেই চোখের সামনে গতকাল রাতের সেই দৃশ্য ভেসে এলো। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালাম। পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে। পুনরায় কালকের ঘটনা ভাবনায় আসতেই, সর্বাঙ্গে ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার জন্ম নিলো।

মুহূর্তেই আরহান এর কথা মাথায় এলো। আরহান কোথায়? ঠিক আছেন তো উনি? এতো কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ভালোবাসার সুখ পেয়েছি। তাও আবার অসীম ভালোবাসা। আরহানকে না চাইতেও মনের কোঠায় স্থান দিয়ে দিয়েছি। আমাদের মতো মানুষদের জন্য যদি কেউ সামান্য কিছু করে, আমরা তাদের জন্য জান দিয়ে দেই। এখানে তো আরহান ভালো বেসেছে আমাকে। উনাকে কি দেওয়া যায়? এই চিন্তা করাটা সামান্য ব্যাপার এখানে।

তখনই ওয়াশরুম থেকে আরহান বেরোলেন। উনাকে সুস্থ থাকতে দেখে দৌঁড়ে ছুটে গেলাম উনার কাছে। জড়িয়ে ধরলাম।

ঘটনার আকস্মিকতায় আরহান কিছুটা পিছিয়ে গেলেন। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিনিট খানেক সময় লাগলো এই ঘটনা বুঝতে। বুঝতে পারতেই খেয়াল করলেন আমি কাঁপছি। শরীর আমার অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। আরহান আমাকে আলিঙ্গন করে নিলেন। ডান হাত আমার মাথার পেছনের চুলে হাত বুলোচ্ছে। মিহি কণ্ঠে বললেন, “কাঁপছো কেনো শুকতারা? কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে তো।”

উনার এমন আদরমাখা কন্ঠে আমি আবেগী হয়ে বেশ জোরেশোরেই কেঁদে দিলাম। অস্থির হয়ে পড়লেন আরহান। ইতিমধ্যে আমার চুলের পেছনে উনার হাতের বিচরণ থেমে গিয়েছে। আমাকে নিজের বুকে থেকে উঠিয়ে আমার দুই গালে হাত রাখলেন। ব্যাস্ত ভঙ্গীতে বললেন,“হুশ! হুশ! কাঁদে না। আমি আছি তো।”

কথাটি শেষ করেই আরহান আমার কপালে চুমু খেলেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম। আরহান পুনরায় জড়িয়ে নিলেন আমাকে। আমি উনার বুকে মুখ গুজে অস্ফুট স্বরে বললাম,“আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে কেউ উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলেছে। আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু ঐ লাশ…!”

হঠাৎ ঐ লাশের কথা মনে পড়তেই আমি বুকে থেকে মুখ তুলে তাকালাম আরহানের পানে। শুধালাম,“ঐটা কে ছিলো? কার লাশ? কে খুন করলো? আর এখানে! এখানে তো রক্ত ছিলো।”

শেষ কথাটি, তর্জনী আঙ্গুল ফ্লোরের দিকে ইশারা করে বলেছি।

আরহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,“কিসের রক্ত?”

“এখানেই তো ছিলো, দেখেন নি?”

“আমিতো কোনো রক্ত দেখতে পেলাম না। আমি এখানেই বেডে শুয়ে ছিলাম। তোমার চিৎকার শুনে এদিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছো।”

আমি অবাক। শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লাম,“কেউ ছিলো না! সত্যি?”

“হয়তো অনেক চিন্তিত তুমি। এজন্যই এমনটা হচ্ছে তোমার সাথে। এতো টেনশন করো না। আমি আছি তো। চলো, ঘুমোবে।”

আমি আসলেই চিন্তিত। আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।

বিছানায়, উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে আছি। শুয়েছি ঘণ্টা খানেক হবে হয়তো। ঘুম আসছে না। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পেছনে ঘুরতেই, ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় আরহানকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করলাম। চাহনি স্থির। আমি চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমোননি?”

“নাহ্! আসছে না।”

“আমারও না।”

“একটা কথা বলি শুকতারা?”

উনার, আমাকে এই শুকতারা বলে ডাকাটা এতো ভালো লাগে! বলে বোঝাতে পারবো না। উনাকে কথাটা বলার সুযোগ দিতে আমি “হুঁ” বললাম।

“ক্যান আই হাগ ইউ?”

আরহানের নিঃসংকোচে করা এমন আবদারে আমি থম মেরে গেলাম। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলেন। উনার উষ্ণ আলিঙ্গনে আমিও গুটিশুটি মেরে রইলাম। আরহান আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভীষণ ভালোবাসি শুকতারা।”

_____________________

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেটের প্যাকেট খালি করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। এই নিয়ে তৃতীয় প্যাকেটটা খুলতেই সেখানে আশিকের আগমন।

“স্যার! আপনের নামে পার্সেল আইসে।”

তৃষ্ণা একবার আশিকের দিকে তাকালো। তারপর আগের মতো আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“পাঠিয়ে দাও রুমে।”

আশিক চলে গেলো। মিনিট পাঁচেক পর, বিশাল আকৃতির একটা বক্স নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তৃষ্ণা এতো বড় বক্স দেখতেই কপাল কুঁচকে ফেললো।

আনবক্স করতেই সেখানে আশিক চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো।

চলবে…