নিশির প্রবাস (পর্ব-৩)

Photo of author

By Asma Ahmed

সময় মানুষ কে অনেক কিছু শেখায়।
নিশি আমেরিকা এসেছে আজ ২৬ দিন। ওর মাথায় সারাদিন একি চিন্তা কাজ করে, এখানে কেউ বসে বসে খায় না। সকালে সুমন কাজে চলে যাওয়ার পর নিশি প্রতিদিন বের হয়ে যায়, চাকরির খোজে, নিশি একটা দোকানের সামনে দাড়ালো,
(সিং এম্পোরিয়াম) দেখলো এক ইন্ডিয়ান সিক বয়স্ক করে লোক দারানো, ও আস্তে আস্তে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের কি কোন লোক প্রোয়জন আছে কাজ করার জন্য ” লোকটি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো ” তুমি কি ইন্ডিয়ান?
” না, আমি বাংলাদেশি। ( ততদিন এ নিশির ইংলিশ বলার জড়তা কেটে গিয়েছে, চাকরি চাইতে ও আর লজ্জা লাগে না) লোকটি বললো – দেখো আমার এই দোকান টা আমি শুধু সামার এ খোলা রাখি, দুপুর ২ টা থেকে রাত ৮ টা, এখন খোলার সময় হয়েছে, যেহেতু সামার চলে আসছে। আমি নেক্সট ২দিন এটা পরিষ্কার করবো, তারপর ওপেন করবো। তুমি চাইলে এখানে কাজ করতে পারো, সেলস গার্ল হিসাবে, ঘন্টায় ৪ ডলার, সপ্তাহে ৫দিন, তুমি যদি রাজি থাকো, কাল থেকে শুরু করতে পারো, এই দুই দিন পরিস্কার করে, কাজ শুরু করতে পারো।
তোমার পেমেন্ট আমি কাল থেকেই ধরবো। নিশি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো। বললো জি আমি কাল ২ টায় চলে আসবো। নিশির খুবি খুশি লাগছিল, সুমন অনেক খুশি হবে।
রাতে সুমন বাসায় ঢোকার সাথে সাথে বললো – আমার জব হয়েছে, তারপর বিস্তারিত। –
” পার্ট টাইম, ৪ ডলারX ৬ ঘন্টা = ২৪ ডলার = ৫ দিন =১২০ ডলার সপ্তাহে। আসা যাওয়ার ভাড়া। কিন্ত চাকরি খোজা ছাইরো না। সেদিন শুনলে না লাভলি ভাবি সপ্তাহে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার পায়। বিকাল থেকে নিশির ভিতরে যে খুশি টা কাজ করছিলো তা এক নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। রাতে আব্বার ফোন এলো, আব্বার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আম্মা যখন ফোন নিলো, কেনো যেন আম্মার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না। আম্মা জিজ্ঞেস করলো ” সারাদিন কি করো মা? ইচ্ছা হচ্ছিল বলে ” ওমা আপনি জানেন না আমাকে এখানে স্কুল এ ভরতি করে দিয়েছে, কি সুন্দুর স্কুল, সুইমিংপুল আছে, সবুজ আর সবুজ ” উত্তর দিলাম তেমন কিছু না, সারাদিন বাসায় থাকি, মাঝে মাঝে সুমন এর সাথে বাইরে যাই। আম্মা মহা খুশি আমি জানি।
পরদিন শুরু হলো আমার জিবনের প্রথম চাকুরী জীবন। ওই মল টা তিন তলা, কাপড় থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিষ সবই আছে। সেদিন বাসায় আসতে আসতে রাত ৯ টা, আমি রান্না করে রেখে যাই নাই, দেখলাম সুমন ও ফিরেছে, আমার সাথে খুবি রাগারাগি করলো কেনো রান্না করে রেখে যাই নাই, এখন কখন রান্না হবে, কখন খাবো। ” আমি কি তোমার মতো ২ টায় যাই, আমার সকাল ৭ টায় উঠতে হয়” নিশি বললো কাল থেকে আর হবে না, আমি রান্না করে রেখে যাব।
নিশির অই মলের কাজ টা ভালোই চলছিল, আর পাশাপাশি নিশি চাকরি খুজতে থাকলো,
( সুমন ২/৪ দিন পর পর মনে করিয়ে দিতো) এই ২ মাসে নিশি আরো বেশি শিখতে পেরেছে, জিবনের বাস্তবতা শিখছে, সুমন এর অবহেলা আর আগের মতো কস্ট দেয় না, আর ভিতর টা মনে হচ্ছিল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। নিশির বেতন এর টাকা দিয়ে গতমাসে বাজার করেছে, নিশি খুশি সুমন এর কাছে চাইতে হয় না। ( এর মদ্ধে ২ বার ২ টা বাঙালি দাওয়াত এ গিয়েছিলো ওরা, একদিন একি কথা আবার ও রিপিট করলো সুমন-
” সবাই তোর দিকে তাকিয়ে থাকে কেনো ” তুই!! (নিশির মনে পড়ে না এই জিবনে নিশিকে কেউ তুই বলেছে) আর একদিন দাওয়াত থেকে এসে ধুম মেরে ছিলো, পরের দিন রবিবার সকালে দেড়ি করে উঠেছে, জিজ্ঞেস করছিলো “এত কি গল্প করছিলা ওদের সাথে?” নিশি উত্তর দিলো – নরমাল কথাবার্তা, বাংলাদেশ এ আমরা কোথায় থাকি, আমার দেশের বাড়ি কোথায়, কোন স্কুল এ পড়তাম, এইসব।
যে বাড়ি টা তে ওরা থাকতো সেটা গ্রাউন্ড ফ্লোর এ ছিলো, জানালা খোলা যায় না, পর্দা সরানো যায় না, বাইরে থেকে সব দেখা যায়, আর সাবওয়ে স্টেশন একটু দূর ছিলো, আমাকে বলে হলো, নেক্সট রবিবার এই বাসা টা শিফট করবো।
বাসা শিফট করা হলো। অই এপার্টমেন্ট ছিলো ২৬ তলা, নিশি রা উঠলো ৭০৩ এ, দুই দিন পর অই ফ্লোর এর ই এক বাংগালি মহিলার সাথে পরিচয় হলো, শিলা ভাবি। উনারা ছিলেন ৭১০ এ। অই ভাবির দুই টা জমজ বাচ্চা, তাই ভাবি আর এখন কাজ করে না। উনার হাসবেন্ড ভালো একটা জব করে। অল্প দিনের মদ্ধে ভাবির সাথে নিশির খুব ভালো একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো। ভাবি বাজারে যায়, নিশি বাসায় থাকলে বাচ্চা দুইটা কে দেখাশোনা করে, ভাবি ভালো মন্দ রান্না করলে নিশিকে ডাক দিয়ে একসাথে খায়। একমাত্র অই ভাবির সাথে নিশি কিছুটা কস্ট, অভিমান শেয়ার করতো।
অই ভাবির সাথে নিশির সখ্যতা সুমন পছন্দ করতো না, কেনো সেটা নিশির বোঝার বাইরে।
একদিন ভাবি বললো “নিশি আমি যে জব টা করতাম, “একটা ফ্রেঞ্চ চেইন রেস্টুরেন্ট, ফুল টাইম, অইখানে এখন ও কাউকে নেয় নাই, তুমি চাইলে আমি কথা বলে দেখতে পারি” নিশি বললো দেখেন না ভাবি, তাহলে তো খুবি ভালো হয়। দুই দিন পর ভাবি বললো ” নিশি আমি কথা বলেছি, তোমার জব এর বিষয়, তুমি কাল ১২ টায় এই ঠিকানায় যাবে, ঐ শপ টার হেড হচ্ছে মিস্টার মেনুয়াল, উনার সাথে দেখা করবে।”
নিশি সুমন কে জানালো,কাল একটা ইন্টারভিউ আছে।
নির্দিষ্ট দিনে নিশি গেলো, মিস্টার মেনুয়াল ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো, তারপর ওকে কাজ বুঝালো– “দুই মাস তোমাকে সব করতে হবে, স্টোর থেকে মাল উঠানো, টেবিল ক্লিনিং, মপ করা, তারপর আমি তোমার সাথে কথা বলে এক জায়গায় দিবো, হতে পারে ওয়েট্রেস, হতে পারে ক্যাশ এ, বা ফ্রন্ট এ, আর এই শপ ২৪ ঘন্টা খোলা তোমাকে শিফটিং ডিউটি করতে হবে, কোন কোন সপ্তাহে তোমাকে নাইট শিফট করতে হবে, ঘন্টায় তুমি ১০ডলার পাবে, ৮ ঘন্টা করে, সপ্তাহে ৬ দিন” – নিশি তো মনে মনে মহাখুশি। ও জিজ্ঞেস করলো আমাকে কবে থেকে শুরু করতে হবে? ” নেক্সট মানডে থেকে ” – নিশি আল্লার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া জানালো, ও যখন উঠতে যাবে তখন মেনুয়াল বললো ” ওয়েট, এটা কি তোমার আসল চুল? নিশি খুব অবাক হলো, নকল চুল হয় নাকি আবার! বললো “তোমার এতো লম্বা চুল নিয়ে কিন্ত এখানে কাজ করতে পারবা না, তোমার চুল কাটতে হবে, তুমি দেখো আমার এখানে ইউনিফর্ম এর সাথে আলাদা একটা স্টাইল আছে, এবং এটাই সবাইকে মেইন্টেন করতে হবে। (সবার মাথায় হেট,পিছনের ফাকা জায়গা দিয়ে অল্প একটু চুল,বের করা,নেট দিয়ে আটকানো)
চুল নিশির সবচেয়ে বড় অহংকার, নিশির মা ও নিশির চুল নিয়ে খুব অহংকার করতো। আর সুমন ও রাজি হবে না, সে নিজে না বললে ও বাংলাদেশ এ থাকা অবস্থায় ওর পক্ষের আত্তিয়সজন যখন চুলের প্রশংসা করেছে, তখন সুমন ও খুশি হয়েছে। এখানে যে কয়টা প্রোগ্রাম এ গিয়েছে, কেউ বাদ নাই, ওর চুলের প্রশংসা করে নাই। ও মেনুয়েল কে বল্লো, আচ্ছা আমি তোমার ফোন নাম্বার নিয়ে যাচ্ছি, আমি কাল তোমাকে ফোনে কনফার্ম করবো। মন টা খুব খারাপ লাগছিলো,এই জব টা ও করা হবে না। আর মনে মনে ভাবছিলো ইস চুল কেটে উনার ওইখানে কাজ করবে, খাইয়া দাইয়া কাজ নাই।
আর সুমন ও রাজি হবে না।

চলবে…