মুসকান – গোধূলি বেলার প্রেম

Photo of author

By Alam M

#পর্ব১ – ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ইং

–আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?

এমন একটা ক্ষুদে বার্তা আসে জায়েদ আহমেদের মেসেঞ্জারে। সে ভাবতে থাকে এটা কেমন হলো। কেউ তো কথা শুরু করে hi, hey, hello দিয়ে, নয়তো সালাম দিয়ে। এটা কেমন শুরু। তাই সে উত্তর না দিয়ে ইগনোর করে যায়।

কয়েকদিন পর আবারও একই মেসেজ, “আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?”। জায়েদ সাহেব বুঝতে পারেননা তার কি করা উচিৎ। আসলেই কি মেয়েটার কোনো দরকার আছে। তাকে কি উত্তর দিয়ে সহযোগিতা করা উচিৎ। আজকাল তো অনেকেই অনেক ধরনের ফাঁদ পাতে।

জায়েদ সাহেব একা থাকেন। তার বয়েস এখন ৬০, রিটায়ার করেছেন। এক ছেলে, এক মেয়ে। তারা দু’জনই আমেরিকায়। ছেলে পড়াশুনা শেষ করতেই গুগুলে জব হয়ে গেছে। মেয়েটার পড়া শেষ হবে এ বছরেই। স্ত্রী গত হয়েছে তিন বছর হলো। অনেক বন্ধুর সাথেই এখন আর তার কথা হয়না। নিঃসঙ্গ! মেসেঞ্জারের ওপরে তাকিয়ে দেখলেন, মুসকান মায়া নামের কোনো একটা মেয়ে মেসেজ দিয়েছে। এর আগে তিনি খেয়াল করেননি। তারও একটু কথা বলতে মন চাইলো। জায়েদ সাহেব এবার উত্তর দিলেন।

–আমাদের মাঝে কি আগে কখনও কোনোভাবে কথা হয়েছে?

–না তো।

–আমার বাসা ঠাকুরগাঁও হলে কি হবে?

–আমার প্রয়োজন তাই জানতে চাচ্ছি।

–কি প্রয়োজন তা তো আমাকে আগে জানতে হবে।

–আমি ঠাকুরগাঁও এর একজনকে খুঁজতে ছিলাম।

–আপনার পরিচয় কি?

–আমি মুসকান। পুরো নাম মুসকান মায়া। আমার বাসা রংপুরে।

–আমি চেক করে দেখলাম, আপনার তো ফেসবুক নাই। শুধু মেসেঞ্জার চালান।

–আছে, তবে ওটা বর্তমানে ডিএ্যাকটিভ করে রেখেছি। ফেসবুক আর চালাবো না।

–আমার কি কোনো মুসকান মায়াকে চেনার কথা?

–জানিনা তো। আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?

–আচ্ছা, আমি যদি মুসকান মায়া হতাম আর আপনি যদি আমি হতেন তবে কিভাবে কথা বলতেন?

–মানে?

–মানে একজন অপরিচিতা কাউকে নিজের সম্পর্কে হঠাত করে কোনোকিছু জানানো কি ঠিক?

–সরি! আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। আমি রাখছি। bye

জায়েদ সাহেব বুঝতেই পারেননি এভাবে হঠাত করেই মুসকান bye বলে অফলাইনে চলে যাবে। ভাবছিলেন, আরও কিছু কথা তো বলাই যেতো। জানা হলোনা মেয়েটা সত্যিই কাউকে খুঁজতে ছিলো কিনা। সে আসলেই কোনো মেয়ে কিনা, নাকি মহিলা, নাকি ছেলে মানুষ। মেয়েদের নাম ব্যবহার করে আইডি বানিয়েছে। প্রোফাইলে একটা ফুলের ছবি দেয়া। তবুও তিনি মনে মনে ভাবতে চাইছিলেন অল্প বয়েসি কোনো একটা মেয়ে হবে। মুসকান মায়া নামটা ভাবতেই তার মনে হয়ে কিশোরীই হবে। মুসকান মায়া একটা কিশোরী মেয়ের নাম, মায়া মায়া!

এরপর তিনি ব্যাপারটা ভুলেই গেলেন।

জায়েদ সাহেব একা থাকেন বারো তলা বিল্ডিং এর টপ ফ্লোরের একটা এপার্টমেন্টে। বাসায় কোনো কাজের মানুষ নেই। পাশেই একটা হোটেল ক্যাফে সান এর সাথে চুক্তি করেছেন সকালের নাস্ত, দুপুরের এবং রাতের খাবার পাঠিয়ে দিতে। শুধু পাঠানোর আগে ফোনে জেনে নিতে বলেছেন, খাবার হিসেবে কি কি পাঠাবেন।

রিটায়ারমেন্টের টাকা আর দেশের বাড়ি কিছু জমি বেচে দিয়ে এই এপার্টমেন্ট কিনেছেন। আগে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। এখন তিনি নিরিবিলি থাকতে চান। আর তাইতো টপ ফ্লোরে এপার্টমেন্ট নিয়েছেন। ছেলেমেয়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা হয়। মোবাইল এখন বন্ধ করেই রাখেন। কারো সাথে আর কথা বলতে তার ভাল্লাগে না। ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিতে তার মেয়ে হেল্প করেছে যাতে অন্তত মেসেঞ্জারে কথা হতে পারে। জায়েদ সাহেবের ফেসবুক একাউন্টে তার ছেলে আর মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই।

ছেলে গুগুলে জব পাবার পর বলেছে, – বাবা, আমার এখানে চলে এসো। আমাদের দু ভাইবোনের সাথে থাকবে, তোমার ভাল্লাগবে। আমরা চাইনা, তুমি মায়ের জন্যে মন খারাপ করে সবার থেকে আলাদা হয়ে একা একা থাকো। জায়েদ সাহেব জানিয়ে দেন, তার একা থাকতেই ভাল্লাগে। তবে একদিন তোদের কাছে চলে আসবো, সে কথাও বলেন।

জায়েদ সাহেব তার নিজের এপার্টমেন্ট নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। তার শোবার ঘরের ইটের দেয়ালের পরিবর্তে তিনি ভারি কাঁচের দেয়াল দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। রাতে তিনি সমস্ত পর্দা সরিয়ে দেন। রাতের আকাশের নাকি কেমন একটা আলাদা আলো আছে। তিনি সে আলোয় ঘুমান আর ভাবেন, জুবেদা কেমন আছে। আর কিছুদিন কি সাথ দেয়া যেতো না। এমন সময় ভাবনায় ছেদ পড়ে। একটা ক্ষুদে বার্তা –

–আপনি কেমন আছেন?

জায়েদ সাহেব মোবাইলের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন রাত তিনটে বাজে। এতো রাতে মুসকানের মেসেজ দেখে বুঝতে পারেন না তার কি করা উচিৎ। উঠে বসেন। ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরান। তার মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কথা। প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসেই স্যারের লেকচার শুনার সময় হাত তুলে স্যারকে প্রশ্ন করে লেকচারের পুরো মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্যার ভুল করে ফেলেছিলেন। ভালো স্টুডেন্ট মনে করে ক্লাসের ছয়জন মেয়েই কাছে ভেরে। বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এটা দেখে টুটুল আর সেলিমও দলে ভেরে। ক্লাস বিরতিতে আড্ডা জমতো। একদিন মিশকাত বললো, তোমরা সিগারেট ছেড়ে দাওনা কেনো। মিশকাত আর মুসকান, খুব কাছাকাছি নাম মনে হচ্ছে কেনো? বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে মিশকাতকে বলা হয়নি তাকে যে তার ভালো লাগতো। মিশকাত, মুসকান! একদম অপরিচিত একটা মেয়েকে এতোরাতে কি জবাব দেবে তা ভেবে পায়না। এলোমেলো লাগছে। জুবেদা, কেনো ছেড়ে চলে গেলে আগে আগে। একা থাকতে যে আর ভালো লাগেনা। অনেকক্ষণ ভেবে ভেবে শেষে উত্তর দেন,

-হুম, ভালো আছি। এতো রাতে কি মনে করে? আমি একা মানুষ। দুই ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে। স্ত্রী গত হয়েছে তিন বছর হলো।

মেসেজ সেন্ড করে ভাবছেন, এমন উত্তর দেয়া কি ঠিক হলো? সাথে সাথে মেসেজ মুছে দিলেন জায়েদ সাহেব। এরপর আর অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল আটটায় তার ঘুম ভাঙ্গে কলিং বেলের আওয়াজে। হোটেল থেকে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। ওদের তো ফোন করবার কথা ছিলো। না জানিয়েই নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছে, তাও আবার এতো সকালে। অল্প বয়েসি একটা ছেলে নাস্তা নিয়ে এসেছে। ছেলেটাকে ভেতরে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা রেখে চলে যেতে বললেন। ছেলেটা চলে যাচ্ছে এমন সময় ডেকে দাড়াতে বললেন। হাতে দশটাকা দিয়ে বললেন, ম্যানেজার সাহেবকে ফোন দিতে বোলো। আর এ দশ টাকাটা তোমার। কাউকে বলতে হবে না, ঠিক আছে? ছেলেটা মাথা নেড়ে জানান দেয় যে কেউ জানবে না।

ছেলেটা চলে যাবার পর নাস্তা না খেয়েই জায়েদ সাহেব আবার শুয়ে পড়েন। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে। গতরাতে তার ঘুমই হয়নি বলা চলে।

আবার হঠাত ঘুম ভাঙ্গে ইন্টারকমের শব্দে। কি হলো? তিনি ফোন ধরলেন। সিকিউরিটির কবির ছেলেটা ফোন দিয়ে বলছে, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন। কোন হোটেল থেকে নাকি আসছেন। উনার নাম হাবিব সাহেব। জায়েদ সাহেব বললেন, উনাকে ইন্টারকমটা দাও। হোটেলের ম্যানেজার হাবিব সালাম দিয়ে বলতে শুরু করে, স্যার আপনারে ফোন দিয়া নাম্বার বন্ধ পাইছি। তাই নাস্তা পাঠানোর আগে কিছু জানাইতে পারি নাই। জায়েদ সাহেব বলেন, আচ্ছা, সমস্যা নাই। আজকে তুমি দুপুরের খাবার পাঠিও না। আমি নিজেই হোটেলে আসবো। তোমাকে আমার আরেকটা নাম্বার দেবো। সেটাতে কল করে জেনে নিও।

এই কথা বলেই ভাবতে লাগলেন, তার কাছে তো আর কোনো নাম্বার নেই। আগের নাম্বারটা তো অন রাখতে চাইছেন না। সেই আমলে গ্রামীণফোনের একটা নাম্বার নিয়েছিলেন কতো দিয়ে যেনো। এখন তেমন মনে করতে পারছেন না। কতো দাম হবে এখন বুঝতে পারছেন না।

ম্যানেজার হাবিব জানতে চায়, স্যার আজকের নাস্তাটা কেমন হয়েছে? জায়েদ সাহেব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে, আমি এখনও নাস্তা করিনি। পরে জানাবো। আর আসার জন্য ধন্যবাদ। আবারও বলিছি, আজ দুপুরে খাবার পাঠানোর দরকার নেই। আমি রাতে আপনাদের হোটেলেই আসবো, বলেই ইন্টারকমটা তিনি রেখে দিলেন। আবার ইন্টারকম হাতে তুলে নিয়ে নীচে সিকিউরিটিকে ফোন দিলেন। কবির সালাম দিয়ে উঠে দাড়ায়। কেনো দাঁড়িয়ে যায় তা সে নিজেও জানেনা। জায়েদ সাহেব বলেন, একটা গ্রামীণফোনের নাম্বার নিতে কতো লাগতে পারে তা কি তুমি জানো? কবির জানায়, স্যার বেশি না। মাত্র ২০০টাকা। উত্তর শুনে জায়েদ সাহেব বলেন, ও আচ্ছা। কোথায় পাওয়া যাবে তা কি তুমি জানো? কবির বলে, স্যার আমাদের বিল্ডিং এর উল্টাপাশেই মোবাইল রিচার্যের দোকান আছে। ওরাই সিম বেচে। আচ্ছা, ঠিক আছে, এই বলে জায়েদ সাহেব ইন্টারকম রেখে দেন।

কোনো রকম নাস্তাটা সেরে আবার ঘুমানোর জন্যে বিছানায় যান। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখেন, মেসেঞ্জারে বেশ কয়েকটা ভিডিও মিস কল। মেয়ে ফোন দিয়েছিলো। মেয়েকে কল ব্যাক দেয়।

–আব্বু, তুমি কল ধরোনি কেনো? টেনশন হচ্ছিলো।

–আর মা, একটু বেশি ঘুমোছিলাম আজ। টেনশন করার কিছু নেই। আমি ভালো আছি।

–তুমি কি আবারও সিগারেট খাও নাকি?

–মাঝে মাঝে দুই একটা খাই রে মা। ও কিচ্ছু হবে না। আমার এখন আবারও ঘুমাতে ইচ্ছে করতেছে। তোকে পরে কল দেবো রে মা। এখন রাখবো।

–আমিই তোমাকে সন্ধায় কল দেবো। রাখছি। লাভ ইউ, বাবা।

–লাভ ইউ, মা।

কল রেখে দিয়ে এবার মুসকানের মেসেজ ওপেন করলেন জায়েদ সাহেব। আর কোনো মেসেজ দেয়নি। তিনি আবার লম্বা একটা ঘুম দিলেন।

সন্ধ্যার বাসা থেকে বের হলেন। তারপর সিকিউরিটি কবিরের দেখিয়ে দেয়া দোকানে গিয়ে একটা সিম কিনলেন। দোকানী জিজ্ঞেস করলে, ভালো নাম্বার আছে, লাগবে নাকি স্যার? জায়েদ সাহেব উল্টো প্রশ্ন করলেন, ভালো নাম্বার মানে? ভালো নাম্বার দিয়ে কি ভালোভাবে কথা বলা যাবে? দোকানী বলে, না স্যার। ভালো নাম্বার মানে সুন্দর নাম্বার, মনে রাখার মতো নাম্বার। এর জন্যে ৩০০ টাকা বেশি দিতে হবে। জায়েদ সাহেব বললেন, আচ্ছা, দিয়ে দিন। আমার নিজের নাম্বার মনে থাকেনা। সুন্দর নাম্বার হলে হয়তো মনে রাখতে পারবো। আচ্ছা, আপনার দোকানে কি নরমাল মোবাইল ফোন হবে? তাহলে এই নতুন নম্বরটা সেট করে দিন। দোকানী একটা নরমান নোকিয়া ফোনে নাম্বারটা সেট করে দিয়ে দিলেন। জায়েদ সাহেবের তখন মনে হলো টাকা তো সাথে আনেননি। শুধু কার্ড নিয়ে বের হয়েছেন। এখন কি হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি তো টাকা আনিনি। সাথে আমার কার্ড আছে। এখানে কি কার্ড চলবে? তা না হলে আমি কিছুক্ষণ পরে এসে নিয়ে যাবো। দোকানী অবাক করে দিয়ে বললো, স্যার আমরা কার্ড এক্সেপ্ট করি।

পেমেন্ট করে দিয়ে জায়েদ সাহেব মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ হাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। হাটা দরকার শরীর ভালো রাখতে। এখন হাটার মতো কোনো পার্ক খুঁজে পাওয়া যায়না। রাস্তার ফুটপাথ দিয়েই হাটতে লাগলেন। ফুটফাথেও হাটার অবস্থা নেই। ফুটপাথের প্রায় অংশই দখল হয়ে গেছে। তবুও তিনি প্রায় ঘন্টাখানেক হেটে বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন। এমন সময় তার মনে হলো ফুটপাথে দুধ চা খাবেন। অনেকদিন ফুটপাথে চা খাওয়া হয়না। একসময় কতো আড্ডা হয়েছে ফুটপাথের টং দোকান গুলোতে। চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দিয়ে বলেছি, মামা পরে নিস। সেই মামার দিনগুলি কতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেছে। এককাপ দুধ চা দাও তো। চিনে দিবে না। আর একটা বেনসন। চা শেষ করে বেনসন ধরাতেই তার মনে পড়লো, টাকা তো সাথে নেই। এখন কি হবে? জায়েদ সাহেব চা দোকানদারকে বললেন পুরোনো স্টাইলে, মামা আমি তো সাথে টাকা নিয়ে বের হতে ভুলে গেছি। এখন মনে হইছে সাথে টাকা আনি নাই। দোকানি অবাক করে দিয়ে বললো, সমস্যা নাই মামা অংকেল। পরে দিলেও চলবো। একথা শুনে তার মনে হলো, গরীবের আত্মা বড় হয়। এরা বিশ্বাস করে। আর এদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে আমরা সাম্রাজ্য গড়ি। অথচ এরাই আত্মার দিক দিয়ে অনেক অনেক ধনী। আচ্ছা মামা, আমি যদি টাকা দিতে ভুলে যাই, তাহলে? বয়স্ক মানুষ, এখন তো অনেক কিছুই মনে থাকেনা। তুমি আমার এই প্যাকটটা রাখো। আমি টাকা দিয়ে নিয়ে যাবো। দোকানদার বললো, লাগবো না মামা আঙ্কেল। আপনি এইদিক আইলে চা খাইয়েন। আমি মনে করাইয়া দিমুনে। জায়েদ সাহেব হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি মামা? চা ওয়ালা মামা উত্তর দিলো, আমার নাম শফিক। জায়েদ সাহেব মাথা নেড়ে হাসি দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন।

বাসায় এসে একটা শাওয়ার নিলেন। তার এখন বেশ ভালো লাগছে। নতুন ফোনটা চার্যে বসিয়ে দিলেন। স্মার্ট টিভি অন করলেন। Netflix এ কি মুভি দেখা যায় তা ব্রাইজ করছেন। কোনো মুভির নামই তার এখন কেনো জানি পছন্দ হচ্ছে না। মুভি দেখা বাদ দিয়ে কিছুক্ষণ খবরের চ্যালেন দিয়ে রাখলেন। কি সব খবর দেখাচ্ছে… আজকাল কি শুধু এসব খবর? গার্মেন্টস এর কর্মচারিরা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে বেতন পায়না বলে। কেনো এদের বেতন আটকে রাখে জায়েদ সাহেব তা বুঝতে পারেন না। মানুষজন এতো বেপোরোয়া গাড়ি চালায় কেন? এক্সিডেন্টের খবর এখন নিয়মিত। আর রাজনৈতিক মুখস্ত বক্তব্য। আর ভালো লাগে না। টিভি বন্ধ করে দিয়ে একটা বই নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে পড়তে লাগলেন।

হঠাত ঘুম ভাঙ্গে। বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা মনেই নেই। ক্ষুধার জন্যে ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন, রাত আড়াইটা! এখন খাবার পাবেন কোথায়। ফ্রিজ খুলে দেখলেন কিছু খেজুর এখনও রয়ে গেছে। সেই রমজানে কিনেছিলেন, সৌদির আজওয়া খেজুর। কয়েকটা খেলে আর ক্ষুধা থাকেনা। তিনি আপাতত ক্ষুধা নিবারনের জন্যে তাই করলেন।

ফোনটা হাতে নিলেন। মুসকানের আর কোনো মেসেজ নেই। মুসকানের মেসেজ কেনো জায়েদ সাহেব আশা করছেন। “আপনার বাসা কি ঠাকুরগাঁও?” – এভাবে কি কেউ মেসেজ দেয়? তার ভালো লাগছে না। এখন তো আর ঘুমও ধরবে না। এখন রাইসা মা’কে কল দেয়া যায়। আমেরিকায় এখন দিন।

#পর্ব২ – ১৩ জানুয়ারী, ২০২৩ইং, শুক্রবার

“আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?” – সেই ক্ষুদে বার্তা প্রায়ই জায়েদ সাহেবের ভাবনায় ছেদ ফেলে। মুসকান মায়া কেনো সেদিন এই মেসেজ দিয়েছিলো? কেনো উত্তর জানতে পারলো না জায়েদ সাহেব তাই নিয়ে তার মাঝে মধ্যেই মনে মনে রাগ হয়। সেদিন একটু ভালোভাবে কথা বললে নিশ্চয়ই উত্তরটা জানা যেতো।

২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ইং, মঙ্গলবার সকাল সকাল জায়েদ সাহেব বই মেলায় গিয়ে হাজির হলেন। ভালো বই কিছু এসেছে কিনা, তা দেখা এবং কেনার জন্যেই যাওয়া। ঠান্ডা কমে এসেছে। আজ ঝকঝকে রোদ। জায়েদ সাহেবের চোখ কালো ব্লাউজে হলদে শাড়িতে একটা ছিমছাম মোটামুটি আন্দাজ ৫’-৪” লম্বা মেয়ের দিকে দৃষ্টি আটকে যায়। তার হাতে বেশ কয়েকটা বই। বইগুলোর কাভার দেখতেও হলুদ রঙের। তবে বইয়ের নাম কি তা এতোট দূর থেকে বুঝতে পারার কথা নয়। মেয়েটাকে ঘিরে রয়েছে চারজন, তারা নিশ্চয়ই তার বন্ধুই হবে। মেলায় আসা কেউ কেউ তার কাছ থেকে বই নিচ্ছে। বইতে কিছু লিখে অটোগ্রাফও দিচ্ছে মনে হয়। একটু ওপরের দিকে নজর দিতেই দেখতে পান, কালিকলম পাবলিকেশন্স এর সামনে মেয়েটা দাঁড়িয়ে। তিনি মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে কালিকলম পাবলিকেশন্স এর বইগুলো একটা একটা করে দেখতে থাকেন। দুই একটা বইয়ের নাম এবং প্রচ্চদ পছন্দ হয়। তিনি বইগুলো নেবেন বলে প্যাক করতে বলেন। এমন সময় একটা হলুদ রঙ প্রচ্ছদের বইয়ের দিকে নজর যায়। সে বইটা চেয়ে হাতে নেয়। একি দেখছেন জায়েদ সাহেব? বইয়ের নাম, “আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?” এবং লেখিকার নাম, মুসকান মায়া। তিনি এই বইটিও কিনলেন, কিন্তু প্যাকেট করতে বারন করলেন।

তার মোবাইলের মেসেঞ্জার ওপেন করে মুসকান মায়ার মেসেজ বের করলেন। মেসেজটা খোলা রেখেই বইয়ের ওপরে মোবাইলসহ বইটা মুসকানের কাছে গিয়ে বলেন, আমাকে কি একটা অটোগ্রাফ দেয়া যাবে? মোবাইল দেখে মুসকান বলে, মোবাইলে কি কেউ অটোগ্রাফ দেয়? মোবাইলসহ বইটা দিয়েছেন কেনো? আমি বইতে কিছু লিখে অটোগ্রাফ দিয়েই দিচ্ছি। তাছাড়া আমি অতো বড় কোনো লেখিকা নই যে অটোগ্রাফের জন্যে আপনার মতো এতোটা মুরুব্বী মানুষ আমার সামনে আসবেন!

জায়েদ সাহেব এবার একটু হেসে দিয়ে বললেন, আগে তো মোবাইলের মেসেজগুলো পড়ে দেখো। এটা নিশ্চয়ই তোমার মেসেজ। তুমিই সেই মুসকান! আমি কি ঠিক বললাম?

মেসেজগুলো পড়তে শুরু করতেই ২৪ বছরের একটা তরুণী সামনের সবাইকে অবাক করে দিয়ে জায়েদ সাহেবের দুই হাত ধরে নিয়ে চোখে চোখ রেখে হরবর করে বলে যেতেই থাকলো যে, আমি যে জায়েদকে খুঁজে চলেছি সে আপনি নন। তার বয়েস ৩০ এর কাছাকাছি ছিলো। কিন্তু আপনার প্রোফাইল ছবি দেখে মনেই হয়েছে আপনি আমার অনেক সিনিয়র। আমি বেশ কয়েকজন জায়েদ আহমেদ নামের মানুষকে মেসেজ দিয়েছিলাম। আর কেউ সেদিন আমায় উত্তর দেননি। আপনি আমার খুঁজতে থাকা জায়েদ নন। কিন্তু শুধু আপনিই উত্তর দিয়েছিলেন। আপনি আমার সেই জায়েদ না হওয়া স্বত্বেও কেনো জানি আপনার সাথেই সেদিন কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো আমার। আমার মনেই হয়েছে, আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আপনার সাথে আমার জায়েদকে নিয়ে কথা বলা যাবে। কথা আর এগোলো না। সেদিন আমাকে আপনার অন্যরকম ভুলভাল কেউ মনে হয়েছিলো, তাইনা?

জায়েদ সাহেব মুসকানের হাত না ছাড়িয়ে নিয়েই উত্তর দিলেন, তেমনটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। তবে কেনো জানি পরে আমিও তোমাকে খুঁজেছি। অপেক্ষা করেছি এক মুসকানের, যে ঠাকুরগাঁয়ের কাউকে খুঁজে চলেছে। আমি এখন একা মানুষ, একা থাকি। সকল বন্ধু বান্ধব কলিগ আত্মীয় স্বজন সবার থেকে দূরে আলাদা হয়ে গেছি। সবাই কেমন জানি শুধু স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলে। আমার ভালো লাগে না। বলো, কথা না বলে কি আসলে বাঁচা যায়? তাই হয়তো অজানা অচেনা একজন মুসকানের অপেক্ষা করেছি, যদিও তুমি আরেকবার ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়েছিলে। আমি উত্তর দেবো কি দেবো না তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। উত্তর লিখেও আর সেন্ড করা হয়নি। তুমি আমার অনেক অনেক বয়েসে ছোট। আমি তোমার সাথে মেসেজে মিসবিহ্যেভ করার কারনে তোমাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চাইতেও পারিনি, কেনো আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে, “আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?”। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জায়েদ সাহেব নীরবতা ভেঙ্গে মুসকান’কে বললো, “তুমি আমার বন্ধু হবে? মাঝে মাঝে মেসেজ দেবে, “তোমার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?”। আমি আবার নতুন করে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নবানে তোমায় জর্জরিত করে দেবো। মেসেজে আর আমাকে আপনি সম্বোধন করতে পারবে না। মুসকান’কে এভাবে পেয়ে যাবো তা আমার কল্পনাতেও ছিলোনা।

ততোক্ষণে মুসকানের অন্য বন্ধুরা সবাই মিলে একটু দূরে আড্ডা দিচ্ছে। ওরা যেন, ইচ্ছে করেই মুসকানকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। মুসকান উত্তরে বললো, তোমায় আমি কি বলে ডাকবো?

জায়েদ সাহেব উত্তরে বললো, বন্ধুকে বন্ধুরা বন্ধুর নাম ধরে ডাকে। আমাকে জায়েদ বলেই ডাকবে। আর আমি তোমাকে মুসকান বলেই ডাকবো। তারপরই বললো, তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? অর্থাৎ সেই জায়েদকে?

মুসকানের চোখ ছলছল করে উঠলো। জবাব দেবে কি দেবে না। দিলেও কি দেবে? সে তো ভালোবাসে জায়েদকে, যে ছিলো একজন তরতাজা ৬ ফিট লম্বা একজন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। হঠাত করেই হারিয়ে যায়। কতোবার জায়েদের ফোনে ফোন করেছে, কখনও রিং বাজেনি। বন্ধই পেয়েছে দিনের পর দিন..। সবশেষ খোঁজার জায়গা হিসেবে ফেসবুক বেছে নেয়। তারপর জায়েদ সাহেবকে উত্তর দিলো, আমি যাকে ভালো বাসতাম এবং এখনও বাসি তার নাম জায়েদ আহমেদ। সে ছিলো একজন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। আমার থেকে প্রায় পাঁচ ছয় বছরের বড় ছিলো। আর এখন আমার সামনে যে বন্ধু দাড়িয়ে আছে, তার নামও জায়েদ আহমেদ। একটু সুভ্রতা এসেছে, এই আরকি। আর সময় পেলে কোনো একদিন সেই জায়েদ আহমেদের কথা বলবো। কতো কতো স্মৃতি…

মুসকানকে হঠাত ফিরে পাবার আনন্দ এবং তরুন জায়েদের হারিয়ে যাবার কষ্ট ষাট বছরের জায়েদ সাহেবের মনটা সত্যিই খারপ করে দিলো। জায়েদ সাহেব সব বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, – চলো, আজ আমিই তোমাদের লাঞ্চ করাবো। কোথায় যাওয়া যায় বলো তো? তুমি থাকো কোথায়? আর তোমার বন্ধুরা?

মুসকান বললো, আমরা সবাই মিলে ঝিকাতলায় একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি। ইউনিভার্সিটির হলে সিট মেলেনি। তাছাড়া হলে থাকতে ভালোও লাগে না। একদিন মাত্র ছিলাম।

জায়েদ সাহেব মুসকানকে বললেন, সবাইকে ডাকো। বসুন্ধরা সিটিতে যাবো। সেখানের ফুট কোর্টে লাঞ্জ করবো। যে কোনো একটা মুভির কিছু অংশ দেখবো। এরপর আমিই তোমাদের বাসায় ড্রপ করে দেবো।

মুসকান বললো, এতোকিছু করার কি দরকার?

জায়েদ সাহেব বললো, যা বলেছি তাই ফাইনাল। আর কোনো কথা নয়। এটা মেসেঞ্জার নয় যে উত্তর দিলাম কি দিলাম না। বিশ্বাস করলাম কি করলাম না। ওদের সবাইকে ডেকে প্রস্তাবটা দাও।

মুসকান সবাইকে ডেকে ব্যাপারটা জানাতেই সবাই হইহই করে উঠলো। বন্ধুরা বললো, এখন বেলা প্রায় ১২টা। গেলে এখনই রওয়ানা দিলে ভালো হয়।

গতমাসে জায়েদ সাহেব ছেলেকে ফোনে বলেছিলো, একটা ছোট গাড়ি কিনবে। কিন্তু ছেলে তার এক বন্ধুকে ফোন করে বিশাল ফোর হুইল নিসান পাঠিয়ে দিয়েছে, সাথে একজন ভালো দেখে ড্রাইভারও আছে। এক গাড়িতেই সবার জায়গা হয়ে গেলো। রওয়ানা দেয়া হলো বসুন্ধরা সিটিতে। ‘হাওয়া’ মুভি চলছে। ৬টা টিকেট কাটা হলো। তারপর ফুট কোর্টে সবাই মিলে লাঞ্চ সেরে নিলো।

মুসকানের বাকি চার বন্ধু মিলে একটা প্ল্যান করে নিয়েছিলো টিকেট কাটার সময়েই। তারা চারজন মুভিটা দেখবে, কিন্তু মুসকান আর জায়েদ সাহেবকে বাইরে রেখে যাবে। তারা যেন ইচ্ছে মতো ঘুরতে পারে আর একে অপরকে সময় দিতে পারে।

হঠাত একজন বন্ধু মুসকানকে বললো, তোমরা দুইজন এখানে বসো। আমরা ভেতরে দিয়ে সিট চেক করে আসি। তারপর তোমাদের নিয়ে যাবে। মুসকান বললো, না না না – একসাথে গেলে সমস্যা নেই। বন্ধুরা বললো, আমরা গেলাম। ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই থেকো। ওরা চারজন মুভি দেখতে সিনেপ্লেক্সে ঢুকে গেলো।

দশ মিনিট পেরিয়ে যায়, বিশ মিনিট পেরিয়ে যায়, ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে যায়… ওদের কারোরই ফিরে আসার খবর নেই। মুসকান ব্যাপারটা বুঝে নিলো যে, ওরা কেউই আসবে না। ইচ্ছে করেই আমাদের একান্তে ছেড়ে দিয়ে গেছে। মনে মনে মুসকান খুশিই হয়। জায়েদ সাহেব মুসকানকে জিজ্ঞেস করে, মুভিটা কি দেখা হবে না? মুসকান মুচকি হেসে দেয়…

জায়েদ সাহেবই এবার কিছুটা বুঝতে পারে। এটা ওর বন্ধুদের প্রিপ্ল্যান ছিলো।।

জায়েদ মুসকানকে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমার ব্যাপারে কি কিছু জানো?

মুসকান উত্তরে জানায়, তোমার নামছাড়া আমি আর কিছু জানিনা। আর এখন সামনাসামনি যতোট দেখছি। শুধু এটুকুই।

জায়েদ সাহেব বলতে শুরু করেন, – আমি এখন একা একটা এপার্ট্মেন্টে থাকি, তাও সেটা টপ ফ্লোরে অর্থাৎ ১২ তলায়। লিফট ছাড়া আমি সিড়ি বেয়ে কখনও আমার ফ্ল্যাটে যাইনি। সিড়ি বাইতে গেলে আরো আরো অনেক ওপরে চলে যাবো, হাহাহা। আমি সরকারী চাকরি করতাম। তারপর বেশ কিছুদিন বেসরকারি চাকরিও করেছে। আমার দুই ছেলে মেয়ে। ওরা আমেরিকায় থাকে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, গুগুলে বড় একটা জব করে। মেয়েটাও সেখানের কোনো একটা ব্যাংকে চাকরি করে। আমাকে ওরা আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়। আমিই যেতে চাইনা। তবে বেড়ানোর জন্য অল্প কয়েকদিনের জন্যে যাবো বলে মনোস্থির করেছি। আর স্ত্রী গত হয়েছেন তিন বছর হলো। ওর নাম ছিলো, জুবেদা। আমি বিয়ের পরেরদিন থেকেই একান্তে মুসকান বলে ডাকতাম। ও হাসলে ওর গালে টোল পরতো। কি অদ্ভুত ব্যাপার, তাইনা? আমার সামনে এখন যে কিশোরী মুসকান বসে আছে, তার গালেও টোল আছে। তুমিও মুচকি হাসো। এমনটা কি করে সম্ভব? মুসকান, তুমি কি আবার হারিয়ে যাবার জন্যে ফিরে এসেছো?

–তোমার কেনো এমনটা মনে হলো? আমি কি তোমার সাথে একটা সেলফি নিতে পারি?

জায়েদ সাহেব বললেন, আমি তো সেই জায়েদ নই।

কথাটা শুনে মুসকানের চোখের কোনো মনে হয়ে এক ফোঁটা পানি জমতে শুরু করেছে। মুসকান বলে, তুমি আমার বন্ধু জায়েদ। আমার সেই ব্যাডমিন্টন জায়েদ আর কোনোদিন ফিরবে কিনা, জানা নেই। তুমিই তো বললে, আমরা বন্ধু। এবার কিছু বলবে?

জায়েদ সাহেব এবার কিছু না বলে দাড়িয়ে মুসকানকে বা হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কয়েকটা সেলফি তোলে। তারপর মেসেঞ্জারে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়ে বলে, এবার আর আমি জায়েদ হারাবো না। অন্তত ছবি হয়ে হলেও থেকে যাবো। তোমার একটা বই দাও তো। আমার নাম্বারটা লিখে দেই। মুসকান বলে, নাম্বার বললে তো আমি আমার মোবাইলেই সেভ করে নিতেই পারি। জায়েদ সাহেব বলেন, আমি আমার নাম্বারটা একটা ছোট লেখার সাথে দিতে চাই। একথা শুনে মুসকান তার একটা বই এগিয়ে দেয়।

জায়েদ সাহেব ছোট্ট একটা ভুমিকা সহ লিখে দেয় –
আজ যদিও বৃষ্টির দিন নয়। তবুও বৃষ্টি নিয়ে লেখা কয়েকটা লাইনই তোমায় দিলাম। বৃষ্টির দিনতো আবার আসবে, আসতেই হবে। সেদিন তোমার বন্ধুর এই কবিতা মনে রেখে ভিজতে পারো। তোমার জায়েদ ফিরে আসবে…

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম…
ভেজা আঁচলে বেঁধে রেখো তোমার স্বপ্ন
কথা দিলাম দেখা দেবো

জায়েদ – ০১৯১১৩৪০০২২

লেখাটা দেখে মুসকান হা হয়ে যায়। বলে, তুমিও কি লেখালেখি করো? তিন লাইনে অসাধারণ কথা বলে দিয়েছো। আমার মনে হচ্ছে, সত্যিই সেদিন জায়েদ ফিরে আসবে। উত্তরে জায়েদ সাহেব বলেন, আমি অল্প স্বল্প দুই তিন লাইনের লেখা লিখে থাকি। বড় তেমন কোনো কবিতা লিখতে পারিনা। আর তুমি তো উপন্যাস লিখে বসে আছো, “আপনার বাসা কী ঠাকুরগাঁও?”।

এদিকে মুভি শেষ হয়ে গেছে। সবাই বেরিয়ে আসছে। জায়েদ সাহেব ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলে গাড়িটা পার্কিং থেকে বের করে সামনের দিকে নিয়ে এসে দাঁড়াও। আমরা আসছি। মুসকানকে সাথে নিয়ে সে নীচে নেমে যায়। আর বলে, তোমার বন্ধুদের ফোন দিয়ে নীচে গাড়ির কাছে চলে আসতে বলো। মুসকান তাই করে।

সব বন্ধুরা ফিরে এসেছে। জায়েদ সাহেব মুসকানকে বলে, তোমাদের ঠিকানাটা ড্রাইভারকে বলে দাও। সেই ঠিকঠাক চলে যাবে। মুসকান ড্রাইভারকে ঠিকানাটা বলে দেয়।

প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। জায়েদ সাহেব ড্রাইভারকে বলে, গাড়িটা রবীন্দ্র সরোবরের দিকে নিয়ে যাও। সবাই মিলে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা আর সাথে চা হলে মন্দ হয় না। তাছাড়া তোমরা বন্ধুরা আমা্কে ফাঁকি দিয়েছো। কারো সাথেই পরিচয় হয়নি।

কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না। ড্রাইভার রবীন্দ্র সরোবরে নিয়ে গাড়ি থামালো। সবাই একটা চায়ের টেবিলের কর্নারে গিয়ে বসলো। সাতটা চায়ের অর্ডার দেয়া হলো। চা এসে গেলো। জায়েদ সাহেব এককাপ চা হাতে নিয়ে ওয়েটারকে বললো, গাড়ির সামনে যে দাড়িয়ে আছে, তাকে দিয়ে আসো।

এবার বাকি কাপগুলো থেকে মুসকান প্রথম কাপ জায়েদ সাহেবের হাতে দিলেন। আর সব বন্ধুদের বললো, ইনি আমার বন্ধু জায়েদ। বাকি একটা একটা করে কাপ একেক বন্ধুর হাতে দিয়ে দিয়ে নাম বলতে লাগলো, লাকি, নীপা, হেনা, সপ্না। সবার সাথে এবার নামেও পরিচয় হয়ে গেলো। চা পর্ব শেষ হবার পর জায়েদ সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বললেন। ওখান থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই মুসকানদের বাসা চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে মুসকান জায়েদ সাহেবকে বলে, কয়েক মিনিট বাসায় বসে যাও। জায়েদ সাহেব বলেন, আজ আর নয়। পরে কোনো একদিন নিশ্চয়ই পিকিনিক করতে চলে আসবো। জায়েদ সাহেব লাকি, নীপা, হেনা, স্বপ্না সবার সাথে হ্যান্ডসেক করে বিদেয় নিলেন। মুসকানের সাথে হ্যান্ডসেক করে বিদেয় নিতে গিয়ে হাতটা ছাড়ছেনই না। বলেই চলেছেন, মেসেজ দিও… হারিয়ে যেও না… বইমেলায় প্রতিদিন আমার পক্ষে আসা সম্ভব হলেও ওখানে আর যাবো না। আগামীতে তোমার দেখা পেতে চাইলে দেখা হবে তো? মুসকান মুচকি হাসি দিয়ে বলে, হুম।

রাত প্রায় ১২টা। আজ জায়েদ সাহেবই মেসেঞ্জারে মেসেজ দিলেন –

  • কেমন আছো? আমি ঠাকুরগাঁয়ের জায়েদ নই। তোমার শুভ্র বন্ধু জায়েদ।
  • হুম, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
  • আজ অনেক ভালো আছি। এভাবে মুসকান ফিরে আসবে তা যে আমার অনেক বড় প্রাপ্তি।
  • আমিও তো জায়েদকে পেয়ে গেলাম।

এভাবে অনেকক্ষণ ওদের মাঝে কথা হলো। রাত তখন প্রায় তিনটা।

মুসকান মেসেজ দেয়,

  • ভালো থেকো। শুভরাত্রি।

ফিরতি মেসেজে জায়েদ সাহেবের উত্তরটা ছিলো –

  • যদি মনে হয়
    হঠাত ঘুমভাঙ্গা গভীর রাতে
    আমি আছি
    একটু আগে দেখে তোমার স্বপ্নের মাঝে!

মুসকান একটা লাভ রিয়েকশন দিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে…

আর ওদিকে জায়েদ সাহেব পুরোটা পর্দা সরিয়ে দিয়ে সারা আকাশকে ঘরে ডেকে এনেছে আর ভাবছে… মুসকান এভাবেই ফিরে আসে?

#পর্ব৩ – ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩ইং, বুধবার

সেদিন বইমেলা থেকে শুরু করে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স এ আমার আর মুসকানের মাঝে যতোটুকুই আলাপ হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে মেয়েটা ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এবার মাস্টার্স এ পড়ছে। আগামী বছরের মধ্যেই আশা করা যায় পাস করে বের হয়ে যাবে। যদিও খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলায় আমার নিজেরই আপত্তি রয়েছে তবুও জানতে চেয়েছিলাম, বাসাভাড়া খাবারদাবার, ইউনিভার্সিটির খরচ মেটাও কিভাবে। মুসকান খুব সহজেই উত্তর দিয়েছিলো, বড় ভাইয়া অনেক বড় একটা কোম্পানীতে জব করেন। তিনি আমাকে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা দেন, আর আমি সপ্তাহের প্রতি তিনদিনে তিনটে করে মোট ছয়টা টিউশনি করি। আর এই টাকাটা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যাই। মা’কেও মাসে অল্প কিছু টাকা মোবাইলে রিচার্য করিয়ে দিতে পারি যাতে করে সব আত্মীয় স্বজনের সাথে কথা বলতে পারেন। যদিও ভাইয়া মা’কেও প্রতিমাসে হাজার দশেক টাকা পাঠান। আমি এক অজ পাড়াগায়ের মেয়ে। ছোট বেলায় বাবা মারা গিয়েছেন। মা তার নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে আমাদের ভাইকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ভাইয়া তো স্ট্যবলিশ হয়েই গেছেন। দেশের বাড়িটাও এখন পাকা করা হয়েছে। আমাকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। আমি পাশ করে বের হয়ে যাবো তো, ইনশাআল্লাহ। একটা চাকরিও নিশ্চয়ই ম্যানেজ করে নেবো। তারপর মা’কে আমার কাছে এনে রাখবো। ভাইয়াও হয়তো মা’কে তার সাথে রাখতে চেয়েছেন, কিন্তু ছেলেরা বিয়ে করে ফেললে তাদের জন্যে এই কাজটা মনে হয় কঠিন হয়ে যায়। আর এই যে আমার উপন্যাসটা দেখছেন, সেটা কালিকলম প্রকাশনাই তাদের নিজ দায়িত্বে আমার মতো আনকোরা নতুন কারো লেখা প্রকাশ করিয়ে দিয়েছেন। সব শুনে আমি বলেছি, তোমাদের দেশির বাড়িতে তোমার মা’কে দেখার জন্যে হলেও একদিন বেড়াতে যাবো। আমার মতো তোমার এমন বন্ধু থাকতে পারে সে নিয়ে কি তোমার মা চিন্তায় পড়বেন? একথা শুধু মুসকান তার গালে টোল মুসকান হাসি দিয়েছে।

ভোরের লাল আভা পূর্ব দিগন্তে দেখা দিয়েছে। আজ সারারাত জায়েদ সাহেবের ঘুম আসেনি অথবা ঘুমোয়নি। শুধু আকাশের ওপারের আকাশ দেখার চেষ্টা করেছে… আর ঘরের সমস্ত ডায়েরি কাগজপত্র বের করে করে ফ্লোরে রেখে দিয়েছে। তার লেখা সব কবিতাগুলো খুঁজে পাওয়া চাই। পুরোনো ডায়েরিগুলোতে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নেয়। মুসকানকে একটা শুভ সকাল মেসেজ দেয়।

  • কথা বোলো সময়ে অসময়ে, জ্বরে কাতরালে
    উত্তর দেবো,
    জানাবো, আমি কে?!

    শুভ সকাল
  • সারারাত ঘুমোওনি কেন?

জায়েদ সাহেব ধারনাই করেননি যে মুসকান এতো ভোরে ওটে, নাকি মেসেঞ্জার নোটিফিকেশন শব্দে জেগে গেছে। যাই, হোক, জায়েদ সাহেব মেসেঞ্জারে কথা বাড়ায়।

  • ভেবেছি অনেক কথা। তুমি তো উপন্যাস লেখো। তুমি আরেকটা উপন্যাস লিখবে। যে উপন্যাসের শিরোনাম আমি দিয়ে দেবো। আমি অবশ্য ঠিকও করে ফেলেছি। শুনবে?
  • বলো
  • “জায়েদ ফিরে এসেছে”। একটু ছেলেমি টাইপের নাম হয়ে গেলো মনে হয়। আর যদি ফিরে না আসে তবে “জায়েদ হারিয়ে যেতেই একবার দেখা দেয়” – এই নামটা দিয়ে দিও।
  • আমার মনে থাকবে।
  • ওহ, তোমাকে আরেকটা কথা বলি। আমি অনেক আগে কিছু কবিতা লিখতাম। সেগুলো খুঁজলে হয়তো পেয়ে যাবো। এই ধরো শ দুয়েক তো হবেই। এখন কয়টা খুঁজে পাবো, তা জানিনা। কবিতার বই কি ছাপানো যায়? আমি আমার আজ রাতে সবগুলো পুরোনো ডায়েরি বের করে বসে আছি। এখন আর দেখার ধৈর্য নেই। তোমার বন্ধুরা কি আজ আসবে? তাহলে তোমাদের দিয়ে ডায়েরিগুলো থেকে কবিতাগুলো খুঁজে বের করাতাম।
  • কেনো নয়? নিশ্চয়ই ছাপানো যায়। তবে তোমার কাব্যগ্রন্থের নাম আমি দিতে চাই। বলো তো তোমার কাব্যগ্রন্থের জন্যে কি নাম ভেবেছি? বলতে পারলে আজ আমি নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে এসে তোমায় খাওয়াতে আসবো। কবিতা খুঁজে বাছতে বন্ধুদের নিয়ে তো আসছিই।
  • “মুসকান – ফিরে এসেছে”।
  • একদম মিলে গেছে। তুমি কি মন পড়তে জানো নাকি? আমি রান্নার আয়োজন করি। আমার বন্ধুদের খবর দেই। বলো কি খেতে চাও?
  • কাচকি মাছের চচ্চড়ি, আলুভর্তা, আর পাতলা মুসুরির ডাল। এটুকুতে আমার চলে যাবে। তোমাদের বন্ধুদের জন্য আমি অর্ডার দিয়ে খাবার আনিয়ে নেবো। ঠিক বারোটায় আমি ড্রাইভারকে গাড়িসহ পাঠিয়ে দেবো। তোমরা তো আর আমার বাসা চেনো না।
  • ঠিকানা দিলেই তো চলে আসতে পারবো।
  • আগে চিনে যাও। পরে হয়তো অনেক সময় পাবে। গতরাতেও একটা কবিতা লিখেছি। ওয়েট… তোমাকে পাঠাচ্ছি। এখনই পড়ে দেখবে? নাকি আরো কিছুক্ষণ ঘুমোতে চাও?
  • দাও। কবিতাটা পড়েই ঘুমোবো। তারপর উঠে বন্ধুদের ডাকবো এবং রান্নার আয়োজন করবো।

তবে শোনো –

  • চোখ আমায় ভুল দেখায়, ভাবায় – বারেবার
    কান আমার কথা শোনে ভুলভাল
    বিষিয়ে দেয় মন আমার
    মিটিয়ে দেয় পদচিহ্ন, ভালোবাসার!
    হোঁচট খায় অর্ধেক পথের ‘পরে
    মুখ থুবড়ে পড়ে রয় আমার আমি
    আর পালাই আমি অবিশ্বাসের ঢেঁকি বিশ্বাস করে…

    পিছু ছাড়েনা আমার
    যা চোখ দেখিয়েছে উলটো করে রেটনায়
    কান শুনিয়েছে, বাজিয়েছে ঢোল কানের ভেতর
    কানের পর্দায়
    বলো, পালাই কি করে নিজের থেকে নিজে?

    চোখ দিয়ে দিলাম অন্ধকে
    অন্ধ দেখুক
    কান পাঠালাম অসীমে বনবাসে
    জাহান শুনুক

    আমি এখন দেখতে পাই তোমাকে
    মনের চোখ দিয়ে – নয় তা ভুলভাল
    শুনতে পাই শুধু বুকে মাথা রেখে
    অনুভবে, অনুরণনে…
  • তুমি তো অসাধারণ লেখো। জায়েদ দেখছি সত্যিই ফিরে এসেছে… এবার রাখছি। নিজের শরীরের যত্ন নিও। আর এভাবে রাত জাগবে না।

এই নাও, আরেকটা ছোট্ট কবিতা তোমায় দিলাম।

  • আমি বারবার তোমার
    নাম বদলে দেবো
    আমার মতো করে
    সাজাবো তোমায়
    যে সাজার সাজ হবে
    নির্মল বন্ধুত্ব
    এক চিমটি আদর
    এক চিমটি ভালোবাসা

    শুধু এক আকাশ থাকবে স্বপ্ন উড়াবার
    পথ থাকবে একটাই পাশাপাশি হাটবার
  • শুধু এক আকাশ থাকবে স্বপ্ন উড়াবার
    পথ থাকবে একটাই পাশাপাশি হাটবার


    কি চমৎকারভাবে বলেছো, বন্ধু আমার। আমিও তোমায় একটা কথা বলি –

    কতোটা মায়ায় বাঁধলে পরে, ছেড়ে যাওয়া আর চলেনা;
    কতোটা বয়েস পেরিয়েও তোমার, প্রেমে পড়া বারণ না


    আজ তোমার বাসায় “হাওয়া মুভিটা” দেখবো। সেদিন তো বন্ধুদের চালাকির জন্যে আমাদের মুভিটা আর দেখা হয়নি।
  • সমস্যা নেই। Netflix এ দেখা যাতেই পারে। এখনকার মতো রাখছি। সকালের জন্যে নাস্তা বলতে তো ঘরে কিছু নেই। কয়েকটা খেজুর খেয়ে ঘুন্টা তিনেক ঘুমোবো। ভেবোনা, আমি তার আগেই ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। দুপুরে দেখা হচ্ছে, ইনশাআল্লাহ।
  • ইনশাআল্লাহ।

কলিং বেলের শব্দে জায়েদ সাহেবের ঘুম ভাঙ্গে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে বেলা দেড়টা। দরজা খুলতেই দেখে, মুসকান ও তার সাথে ঐ সেই চার বান্ধবীরা। তারা সত্যি সত্যিই রান্না করে নিয়ে চলে এসেছে। ওরা নিজেরা ঘরে ঢুকেই ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ওদের দেখে মনে হচ্ছে যেন, নিজেরই বাসা। খাবারের পরিমান দেখে জায়েদ সাহেব বললেন, এতো খাবার এনেছো কেনো? তোমাদেরকে আমার খাওয়ানোর কথা। এই বলেই ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলে, ওপরে আসো। ড্রাইভাই ওপরে এলে জায়েদ সাহেব ড্রাইভারের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলে হাজির বিরিয়ানী থেকে তোমার জন্যে তিনটা সহ মোট আটটা ফুল প্যাকেট বিরিয়ানী আর চার লিটার বোরহানী নিয়ে আসো। টাকা আরো লাগলে আমাকে ফোন কোরো। আচ্ছা, আরো দুই হাজার নিয়ে যাও। টাকা থাকলে গাড়িতে তেল ভরে নিও। ওদেরকে তোমাকেই আবার পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। একথা শুনে মুসকান বলে, এতো খাবার তো তাহলে নষ্ট হবে। জায়েদ সাহেব বলেন, তোমাদের এই বাড়তি খাবার আমি ফ্রিজে রেখে দিয়ে ওভেনে গরম করে করে কয়েকদিনে খাবো। বাইরের খাবার খেয়ে আমার পেট পচে গেছে।

জায়েদ সাহেব অপেক্ষা করছেন, ড্রাইভার কখন হাজির বিরিয়ানী নিয়ে আসে। তারপর সবাই মিলে দুপুরের খাবার খাওয়া যাবে। একা একা তো আর খাবার খাওয়া শুরু করে দেয়া যায়না।

৩০ মিনিটের মধ্যে ড্রাইভার হাজির বিরিয়ানী নিয়ে হাজির। জায়েদ সাহেব মুসকানকে বললেন, তুমিই সবাইকে পরিবেশন করো। আর হ্যাঁ, ড্রাইভারকে বিরিয়ানীর তিনটা প্যাকেট দিও। একথা শুনে মুসকান কিছুক্ষণ জায়েদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। জায়েদ সাহেব বুঝতে পেরে ফিসফিসিয়ে মুসকানকে বলেন, ও ওর বউ বাচ্চাকে রেখে কি এসব খেতে পারবে?

মুসকান হাজির বিরিয়ানীর তিনটা প্যাকেট হাতে নিয়ে সবার আগে ড্রাইভারকে দিয়ে বাকি বন্ধুদের বললো, তোমরা নিজেরা নিজেদেরটা নিয়ে নাও। প্লেটও নিজে নিয়ে নাও। এই বলে দুটো প্লেট, ভাত রাখার বল, দুইটা কাঁচের বাটি ধুয়ে নিয়ে এসে জায়েদ সাহেবকে প্রথমে কাচকি মাছ দিয়ে খাবার পরিবেশন করার জন্যে সব রেডি করলো। জায়েদ সাহেবের প্লেট সাজিয়ে দিয়ে নিজের জন্যে বিরিয়ানী না নিয়ে কাচকি মাছ দিয়ে একটা প্লেটে ভাত নিলো। বাকি চারবন্ধু নিজেরা নিজেদের বিরিয়ানীর প্যাকেট খুলে প্লেটে না নিয়েই খেতে শুরু করে দিলো।

খাবার শেষে মুসকান তার নিজের বিরিয়ানীর প্যাকেটটাও ড্রাইভারকে দিয়ে বললো, এটাও নিন।

খাবার শেষে এবার মুভি দেখার পালা এলো। Netflix এ ‘হাওয়া’ মুভি অন করতেই হইচই লেগে গেলো। বন্ধুরা বলতে লাগলো, এটা তো সিনেপ্লেক্সে দেখা হয়েই গেছে। অন্য কোনো মুভি দেখবো। কি আর করা। জায়েদ সাহেব নীপাকে রিমোট দিয়ে বললো, তোমাদের যেটা ইচ্ছে হয়, দেখো। আমি কিছুক্ষনের জন্যে ছাদের দিকে যাবো। নিজেদের বাসা মনে করতে পারো। ফ্রিজে কোল্ড ড্রিংক্স আছে।

জায়েদ সাহেব দরজার দিকে পা বাড়াতেই মুসকানও দাড়িয়ে গেলো। বললো, আমিও আপনার সাথে যাবো। চার বন্ধুকে বাসায় রেখে জায়েদ সাহেব আর মুসকান ছাদে চলে গেলো। আশপাশের সব এপার্ট্মেন্ট বিল্ডিং এর থেকে এই বিল্ডিংটাই বেশি উঁচু। তাই দিগন্তের পর দিগন্ত দেখা যায় অনায়াসেই।

ছাদে উঠেই জায়েদ সাহেব একটা সিগারেট ধরায়। মুসকান সাথে সাথে বলে ওঠে, সিগারেট খাওয়া চলবে না। আর আজকের পরেও যদি সিগারেট খাও তবে আমি তোমার বন্ধু হবো না। সিগারেট আমার একেবারে অপছন্দ। একথা শোনার সাথে সাথে জ্বালানো সিগারেট পায়ের তলায় পিষে নিভিয়ে ফেলে। সিগারেটের প্যাকেটটা মুসকানের হাতে দিয়ে বলে, যাবার সময় বাইরে ড্রেনের ভেতর ফেলে দিও। কথা দিলাম, আমার বন্ধু চাই, মুসকানের হাসি চাই, সিগারেট নয়!

#পর্ব৪ – ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩ইং, বৃহস্পতিবার

সেদিনের জায়েদ সাহেবের বাসায় দুপুরে মুসকান ও তার চার বান্ধবীর আড্ডার কয়েকদিন পর জায়েদ সাহেব মুসকানকে ফোন দিয়ে বলে, আজ একবার দেখা করতে পারবে? মুসকান বলে, কখন দেখা করতে চাও? উত্তরে জায়েদ সাহেব বলেন, তোমার সুবিধামতো সময় এবং স্থানের কথা বলো। মুসকানও প্রতিউত্তরে বলে, তুমি যখন খুশি আমাকে ফোন দিয়ে চলে এসো। আমি কোথায় থাকবো তখনই তোমাকে জানিয়ে দেবো। আজ আমার কোনো কাজ নেই।

গত দুইদিনে জায়েদ সাহেব নিজে নিজেই তার ডায়েরিগুলো আলাদা করতে পেরেছেন যেগুলোতে তারই লেখা কবিতাগুলো রয়েছে। কবিতা রয়েছে এমন ডায়ারির সংখ্যা মাত্র সাতটা। বেশিরভাগ পৃষ্ঠায় অফিশিয়াল কাজের কথা ইংরেজিতে লেখা। শধু কবিতাগুলোই বাংলায় লেখা। তাই প্রতিটা ডায়েরি থেকে কবিতা খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হবে না কারোরই। প্রতিটা ডায়েরির বয়েস হয়ে যাওয়ায় পাতাগুলো কেমন জানি পুরোনো রঙ ধরেছে। তবে পাতাগুলো একটা অক্ষরও খেয়ে ফেলেনি। অক্ষতই রয়ে গেছে।

বেলা তিনটে বাজে। জায়েদ সাহেবে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন তেল ভরা আছে তো? ড্রাইভার মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। জায়েদ সাহেব ড্রাইভারকে বলেন, সেদিন যে ঝিকাতলায় তোমার সেই ম্যাডামদের নামিয়ে দিয়ে এসেছিলে সেই জায়গা কি তুমি এখন একা চিনে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে? ড্রাইভার এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।

জায়েদ সাহেব ড্রাইভারকে ঐ আলাদা করা সাতটা ডায়েরি দেখিয়ে বলেন, ওগুলো আগে গাড়িতে নিয়ে রেখে আসো। তারপর আমরা রওয়ানা দেবো। ড্রাইভার একবারেই সাতটা ডায়েরি হাতে তুলে নিয়ে নিচে নেমে চলে যায়। ডায়েরিগুলো গাড়িতে রেখে ড্রাইভার ওপরে চলে আসে। তারপর জায়েদ সাহেবকে নিয়ে আবার নিচে চলে যায়। তারা রওয়ানা হয়ে যায়। জায়েদ সাহেবের কেনো জানি মনে হচ্ছিলো, আজ মুসকান তার বাসাতেই রয়েছে। ঘন্টা খানিক সময়েরও কম সময়ে জায়েদ সাহেব ঝিকাতলায় পৌঁছে যায়। গাড়িতে বসেই মুসকানকে ফোন দিয়ে বলে, তুমি নিচে এসে আমার সাথে দেখা করো। মুসকান কোনো কথার উত্তর না দিয়ে লাইনটা কেটে দেয়। তারপর শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করে নিচে চলে আসে। মুসকান আজও শাড়ি পরেছে – কলাপাতা সবুজ রঙের শাড়ি আর গাড় মেরুন রঙের ব্লাউজ।

এসে জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলে, কেমন আছো? এসো আমার সাথে। জায়েদ সাহেব মুসকানের পিছুপিছু সিড়ির দিকে রওয়ানা দিতে দিতে ড্রাইভারকে বললো, তুমি সেদিনের মতো রবীন্দ্র সরোবরের আশেপাশে গিয়ে থাকো। আমি ফোন দিলে চলে এসো।

সিড়ি বেয়ে উঠার সময় মুসকান বললো, আমাদের বিল্ডিং এ কোনো লিফট নেই। আমরা চার তলায় থাকি। এরপর বললো, তুমি কি করে বুঝলে যে আমাকে বাসাতেই পাবে? একেবারে কোনো ফোন না দিয়েই চলে এসেছো! জায়েদ সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, তোমায় না পেলে ফোনে তো জেনে নিতেই পারতাম তুমি কোথায় রয়েছো। তখন সেখানেই চলে যেতাম। তবে আজকে যে আমার আন্দাজ ভুল হবেনা তা বারবারই মনে হয়েছে। প্রমান তো দিয়েই দিলাম – হাহাহা। মুসকান চিরায়ত গালে টোল পড়া মুচকি হাসি দিয়ে মেনে নেয়।

বাসায় ঢুকে জায়েদ সাহেব একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। মুসকান ছাড়া আর কেউ নেই। তিন বেড রুমের ফ্ল্যাট। মুসকান বাসাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় জায়েদ সাহেবকে। সবচেয়ে বড় রুমটায় তিনজন থাকে। তিনজনের তিনিটা বেড আলাদা আলাদা। কোনো খাট নেই। ম্যাট্রেস দিয়েই একই রুমে তিনজনের থাকার আলাদা আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা। বাকি দুইটা রুম ছোট। একটাতে নীপা একা থাকে। আরেকটাতে মুসকান। সবার বিছানাই ম্যাট্রেস দিয়ে করা। মন্দ নয়। খাট তো সত্যিই বাড়তি একটা ঝামেলা!

মুসকান ম্যাট্রেসে বসে জায়েদকে বলে, তুমিও পা তুলে বসো। আমাদের এখানে চেয়ার বা অন্য কিছু নেই গো বন্ধু। আর তোমাকে লজ্জা পেতে হবে না। জায়েদ সাহেব বসতে চাইছিলো না। তার কাছে সত্যিই লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। মুসকান একটা ধমক দিয়ে বললো, বসো! তারপরই সেই চিরায়ত গালে টোল পড়া মুচকি মুসকান হাসি।

ধমকটা কাজে দিয়েছে। জায়েদ সাহেবের যেন আড়ষ্টতা কমেছে। ম্যাট্রেসের ‘পরে পা উঠিয়েই বসেছে। কিন্তু কি কথা বলবে, তা ভেবে পাচ্ছে না। নিজের বাসায় ওরা বন্ধুরা মিলে যখন গিয়েছিলো, তখন তো তার এমনটা লাগেনি। আজ এমন লাগছে কেন? শুধু মুসকান আছে, আর কেউ নেই বলেই কি?

মুসকানও মন পড়তে শিখে গেছে। নিজেই কথা শুরু করলো। বললো, আচ্ছা জায়েদ, তোমার কি লজ্জা করছে? কিংবা ভয়? আমি মুসকান। আমি শুধু হাসতেই পারি। আমি বন্ধু, তোমার বন্ধু। আমি শুধু ভালোবাসতেই জানি। বন্ধুকে লজ্জায় ফেলতে পারিনা। এবার অন্তত আমার দিকে তাকাও। কিছু বলো। জায়েদ সাহেব মাথা উচিয়ে মুসকানের চোখের দিকে চোখ পড়তেই আবার মাথা নামিয়ে নেয়। আবার মাথা উচিয়ে বলে, তুমি সত্যিই মুসকান। প্রায় সাড়ে তিন বছর মুসকান বলে ডাকা হয়নি একান্তে। তুমি ফিরে আসবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। মুসকান, কেমন আছো, মুসকান? জায়েদ ফিরে এসেছে – এ নিয়ে কি তুমি তোমার গল্পের প্লট ভেবেছো? কোথা থেকে শুরু, কোথায় এর শেষ? ওহ, আমি তো ভুলেই গেছি, যে কাজে আজ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি, সেটাই তো ভুলে গেছি। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলে, আমাকে যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছো সেখানের বিল্ডিং এর চার তলায় ডায়েরিগুলো দিয়ে যাও, বলেই ফোনটা রেখে দেয়।

জানো মুসকান, একসময় যারা আমার বন্ধু ছিলো, একসাথে যাদের সাথে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এক রুমে থেকেছি, তারাও দেখা হলে এড়িয়ে যেতো, আর না হয় সালাম দিয়ে আপনি সম্বোধন করতো। আমি মনে মনে শুধু আহতই হয়েছি। কেউ বুঝেনি আমার সেই ব্যথা। বাড়িতে গেলে সেই স্কুলের বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারাও আপনি সম্বোধন করে কথা বলতো। অথচ ওদের সাথে তো আমার তুই-তুই সম্পর্ক ছিলো। আমার কাছে মনে হয়েছিলো, হয়তো আমার জামাকাপড় দেখে দূরে দূরে থাকতো তাই ওরা কাছাকাছি হলে আপনি করে কথা বলতো। এটা ভেবে আমি আমার পোশাকের পরিবর্তন করি। সাধারন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরে ওদের সাথে আড্ডা দিতে গেছি। তখনও তাদেরকে আডষ্ট হতে দেখেছি। বলছি, আমি তোদের জায়েদ, যাকে তোরা একসময় যদু বলেও ডাকতি। এখন কেনো আমাকে দেখে তোরা দূরে সরে যাস? আমি লেখাপড়া করে অনেক বড় চাকরি করি বলে? গ্রামের ডিসি এসপি’রা আমাকে স্যার স্যার ডাকে বলে? আমি ওদের কাছে স্যার হতে পারি, কিন্তু তোদের কাছে তো আমি সেই যদুই আছি। তোরা আমাকে চা খাওয়াবি না? তোরা আমার ওখানে কবে যাবি। আমিই তোদের সবাইকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবো। এবার তো আমায় আমার নাম ধরে ডাক, তুই করে বল। তবুও ওরা তুই করে ডাকতে পারেনি। বড়োজোর তুমি বলে সম্বোধন করেছে। আমি তো এমন বন্ধু হারাতে চাইনি। কি দোষ ছিলো আমার? আমি পড়া লেখা করেছি? বড় চাকরি করেছি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত হয়েছি? আসলে পারিপার্শিকতা বন্ধুত্বকে হার মানিয়ে দেয়। নতুনেরা এদিক থেকে জিততে শিখে গেছে। এই যে তুমি মুসকান, কি সহজেই আমার মতো একজনকে বন্ধু ভাবছো, তুমি সম্বোধন করে কথা বলছো।

এই কথাগুলো বলতে বলতেই জায়েদ সাহেব একটু চুপ হয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে বুকের বায়ে বারবার চাপ দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। মুসকানের নজর এড়ায় না। সে জিজ্ঞেস করে, – জায়েদ, তোমার কি খারাপ লাগছে? একটা বালিশ এগিয়ে দিয়ে বলে, তুমি কিছুক্ষণ শুয়ে রেস্ট নাও। বেশি খারাপ লাগলে ডাক্তার কল করি। ড্রাইভার এলে আমি কথা বলে নেবো।

জায়েদ সাহেব বলেন, তেমন কিছুনা। বরং আমি কিছুক্ষণ ঘুমোই। কিছুটা টায়ার্ড লাগছে। তিনি বুঝতে পারেন না, বুকের ব্যথাটা বাড়ছে কিনা!

ড্রাইভার এলে মুসকান তার কাছ থেকে ডায়েরিগুলো নিয়ে বলে, ভেতরে এসে বসুন। আপনার স্যার একটু রেস্ট নিচ্ছেন। আমি চা নিয়ে আসছি। আপনি চা খেয়ে যান। ড্রাইভার বলে, আমি মাত্রই চা খেয়ে এসেছি। আমি এখন চলে যাই। স্যার আবার কল দিলে আমি এসে তাকে নিয়ে যাবো। এই বলে ড্রাইভার চলে যায়।

রাত তখন ৮টা বেজে গেছে। হঠাতই জায়েদ সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার বুকের ব্যথাটা যেন বেড়েই চলেছে। পুরো বুকের ওপর যেনো অনেক ভারি কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সে মুসকানকে ডাকার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।

মুসকান ওদিকে জায়েদ সাহেবের জন্যে রাতের খাবারের আয়োজন করছিলো। এরই মাঝে দুই কাপ চাপ বানিয়ে নিয়ে ঘরে যায়। গিয়ে দেখে, জায়েদ সাহেব যেন কেমন করছেন। ইশারায় কিছু বলতে চাইছেন। দেখে মনে হচ্ছে, ঘামাচ্ছেন। মুসকান জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খারাপ লাগছে। কোনো রকমে বলে, হুম। বুকের দিকে দেখিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যথা করছে। একথা শুনে মুসকান সাথে সাথে ডাক্তারকে কল করে। বাসার সামনেই তিনি প্রাকটিস করেন। মুসকান একদিন তার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে রেখে দিয়েছিলো যদি কোনো কাজে লাগে। ডাক্তার সাহেব চলে আসেন। এসে প্রাইমারী কিছু পরখ করে মুসকানকে বলেন, উনাকে যতোটা দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। এভার কেয়ারের মতো বড় হাসপাতাল হলে ভালো হয়। মুসকান ডাক্তারের ভিজিট কতো জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন, রোগী সুস্থ্য হোক। তারপর চেক করবো এবং ভিজিট নেবো। ডাক্তারকে বিদেয় দিয়ে মুসকান জায়েদের ফোন নিয়ে তার ফিঙ্গার দিয়ে লক খুলিয়ে নিয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন দেয়। আর জানায় যে, আপনার স্যার অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ১৫ মিনিটের মধ্যেই ড্রাইভার চলে আসে। আর এদিকে আজ মুসকানের বন্ধুদের কারোরই কোনো খবর নেই। কেউই এখনও বাসায় ফেরেনি। মুসকান নীপাকে ফোন দিয়ে বলে, আমি এভার কেয়ার হাসপাতালে যাচ্ছি। পরে জানাবো। এখন কথা বলার মতো সময় নেই বলেই রেখে দেয়। সে ড্রাইভারকে বলে, আমরা আপনার স্যারকে নিয়ে এভার কেয়ার হাসপাতালে যাবো। ঐ হাসপাতাল চেনেন তো? ড্রাইভার বলেন, আমি উনাকে নিয়ে এর আগে কয়েকবার গিয়েছি। আমি চিনি। ড্রাইভার আর মুসকান জায়েদ সাহেবকে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে দেয়। মুসকানও পেছনের সিটে উঠে বসে জায়েদের মাথাটা কোলের ওপরে রাখে। আর বুকে আলতো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, এখন তোমার কেমন লাগছে? জায়েদ কোনোরকমে চোখ মেলে একটু তাকায়। চোখের কোনে পানি। কিছু বলেন না।

এভার কেয়ার হাসপাতাল চলে এসেছে। সাথে সাথে জায়েদ সাহেবকে হাসপাতালের ট্রলিতে তুলে নিয়ে ইমারজেন্সিতে নেয়া হয়। ডাক্তার মুসকানকে জিজ্ঞেস করেন, কি সমস্যা? মুসকান উত্তরে বলে, উনি বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। অনেক ঘেমে গিয়েছিলেন। কথা বলে বুঝাতেও পারছিলেন না। আপনারা ইমারজেন্সিভাবে চেক করে যা যা করা লাগে, করুন।

ডাক্তার আন্দাজ করেই নেন যে এটা হার্ট এটাকের কেস। জায়েদ সাহেবকে সাথে সাথে CCU তে রেফার করেন এবং ভর্তি করিয়ে নেয়া হয়।

ভর্তির সময় মুসকানকে রোগির নাম বলতে বলেন। মুসকান জানায়, তার নাম জায়েদ আহমেদ। এরপর জিজ্ঞেস করেন রোগির সাথে তো আপনিই এসেছেন। আপনিই কি তার লোকাল গার্জিয়ান? আপনার নাম কি? মুসকান বলে, হুম, আপাতত আমিই এখন তার লোকাল গার্জিয়ান। আর আমার নাম মুসকান।

আপনার সাথে তার রিলেশন কি লিখবো?

মুসকান খুব সহজে না ভেবেই উত্তর দেয়, লিখুন, – আমি তার বন্ধু, মুসকান মায়া। ঠিকানাঃ ৪৩/২ ঝিকাতলা, ঢাকা। মোবাইল নাম্বার – ০১৯১১৩xx৬x৮

#শেষ_পর্ব৫ – ২১ জানুয়ারী, ২০২৩ইং, শনিবার

হাসপাতালে রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। আর ওদিকে মুসকান সারারাত নির্ঘুম একটা চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। ড্রাইভার অবশ্য বলেছিলো, – ম্যাডাম, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। আমিই থেকে যাবো। কিন্তু মুসকান তার অসুস্থ্য বন্ধু জায়েদের খবর না জেনে বাসায় ফিরে যেতে চায়নি। জায়েদ সাহেবের ফোনটা মুসকানের কাছেই রয়েছে। ফোনটা আবার লক হয়ে গেছে। লক খোলা দরকার। মুসকান কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়, রোগীর সাথে দেখা করার সময় কখন দেয়া হয়? তারা জানায় যে, বেলা নয়টায় রোগিকে দেখতে যেতে পারবেন। মুসকান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় নয়টা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। আবার এসে সেই চেয়ারটায় বসে। কিন্তু এই দশ মিনিট সময় আজ কেনো যে কাটতেই চাইছে না!

ড্রাইভার মুসকানের জন্যে ডিসপোজেবল কাপে করে এক কাপ রং চা নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, আপনার স্যারের ছেলেমেয়েদের ফোন নাম্বার কি আপনি জানেন? সে জবাব দেয়, না। তারপর তার ছেলেমেয়ের নাম জানে কিনা তা জানতে চায়। তখন সে বলে স্যারের মেয়ের নাম জানি। উনার নাম রাইসা। উনারা যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন নামটা জেনেছি। ভাইয়ার নামটা মনে করতে পারছি না।

এমন সময় হাসপাতালের একজন কর্মচারি এসে জিজ্ঞেস করতে থাকেন যে, এখানে কি জায়েদ আহমেদ নামের রোগীর কোনো আত্মীয় রয়েছেন? মুসকানের মনে হতে থাকে, কেনো তার আত্মীয়দের খোঁজ করছেন? মুসকান উঠে দাড়িয়ে বলেন, আমিই উনার আত্মীয়। কোনো সমস্যা? কর্মচারিটি বলেন, আপনি CCU তে গিয়ে ডিউটি ডক্টরের সাথে দেখা করুন। মুসকান সাথে সাথেই CCU এর দিকে রওয়া হয়। সেখানে যাবার পর যাবার পর ডিউটি ডক্টর মুসকানকে আবার জিজ্ঞেস করেন, আপনি উনার কি হন? মুসকান উত্তরে আবার জানায়, আমি তার বন্ধু। আমিই তাকে গতকাল এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।

ডিউটি ডক্টর মুসকানকে জানান যে, আজ ভোরের দিকে উনার আবারও ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়েছিলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। আপানাদের দেয়া নাম্বারে ফোন দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই আমরাই নিজ উদ্যোগে ICU তেও সিফট করিয়েছিলাম। লাইফ সাপোর্টেও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি তাকে বাঁচাতে। উনার লাশ এখন হাসপাতালের হিমঘরে রাখা আছে। উনার আত্মীয়দের খবরটা দিন। বিলিং সেকশনে যোগাযোগ করুন। বিল পরিশোধ করে লাশ নেবার ব্যবস্থা নিন।

মুসকান খবরটা শুনেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সাথে সাথে সেখানে থাকা কর্মচারীরা মুসকানকে ধরে উঠিয়ে বসান। তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে মুসকান জানায় যে, সে এখন ঠিক আছে। মুসকানের মাথায় কিছুই আসছে না। জায়েদ মানেই কি হারাতে হবে? মুসকানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে গেছে। মুসকান কি এই জায়েদকে ভালোবেসে ফেলেছিলো? নাকি শুধু তাদের মাঝে বন্ধুত্বই ছিলো? জায়েদ হারিয়ে যায় – এটাই কি নিয়ম? মুসকানের বিশ্বাস হচ্ছে না যে জায়েদ আর নেই। চিরদিনের জন্য সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। জায়েদকে ফেলে রেখে মুসকান কিভাবে যাবে? জায়েদের ছেলে মেয়েকে কিভাবে খবর পৌঁছানো যায় তাও ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছে না। জায়েদের মোবাইল তার কাছেই। সে কি মোবাইলটা ড্রাইভারের কাছে দিয়ে দেবে? ছেলে মেয়েরা ফোন দিলে ড্রাইভারের কাছ থেকে শুনে নিয়ে ব্যবস্থা নেবে। মুসকানের কাছে মনে হলে, জায়েদের ফোনটা ড্রাইভারকে দেবে না। ছেলেমেয়েদের ফোন এলে সে নিজেই জানাবে।

মুসকান বিলিং সেকশনে গিয়ে জানিয়ে দেয় যে, তার ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় থাকেন। তাদের খবর দেয়া হয়েছে। তারা এসে সব এডজাস্ট করবেন। এই বলে মুসকান বাসায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ড্রাইভারকে বলে, আপনি থাকুন। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। ড্রাইভার প্রতিউত্তরে জানায়, আমি আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসছি। এই বলে ড্রাইভার গাড়ির দিকে এগোয়। মুসকান কিছু না বলে সেও গাড়িতে গিয়ে ওঠে বসে।

একদিন পর…

জায়েদ সাহেবের ফোনে ফিং বেজে যাচ্ছে। তখন বাংলাদেশ সময় সকাল প্রায় নয়টা। রাইসা ফোন করেছে। মুসকান ফোন ধরে হ্যালো বলার আগেই রাইসা বলে, আব্বু আমরা আগামী সপ্তাহে ঢাকা আসছি। এবার তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে আসবো। এবার মুসকান হ্যালো বলে। রাইসা জিজ্ঞেস করে আপনি কে? আমার আব্বুর ফোন আপনার কাছে কেনো? আব্বুকে দেন। মুসকান কোনোরকম বারতি কথা না করে উত্তর দেয়, – আমার নাম মুসকান। আমি আপনার বাবার বন্ধু। তিনি ফোন ফোনটা আমার কাছেই ছিলো। গত পরশুদিন উনার ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়েছিলো। তারপর থেকে আপনার বাবার ফোন আমার কাছের রয়েছে। যাই হোক, আমরা তাকে এভার কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। সেখানে ভর্তি করিয়েছি। তারপরেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ভোরের দিকে তার নাকি আরেকবার হার্ট এটাক হয়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। উনার লাশ এখন সেখানকার হিমঘরে রাখা আছে। আপনার বাবার ফোন লক করা বিধায় আমি আপনাদের নাম্বার জানতে পারিনি। অপেক্ষায় রয়েছিলাম আপনাদের কলের। এই কথা শোনার সাথে সাথে রাইসা ঐ প্রান্তে ফোনেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ফোন ছাড়ছে না। কেঁদেই চলেছে। বেশ কিছুক্ষন পর রাইসা বলে, ভাইয়াকে আমি এখনই জানাচ্ছি। সে ফোন দিতে পারে। আমরা যতোটা দ্রুত সম্ভব ঢাকা চলে আসছি। রাইসা মুসকানকে বলে, আপনার ফোন নাম্বারটা আমাকে দিন। মুসকান তার ফোন নাম্বার বলে দেয়। নাম্বার নেবার পরেই রাইসা ফোনটা রেখে দেয়।

মুসকানের কিছুই ভালো লাগছে না। সে জায়েদ সাহেবের ডায়েরিগুলো একটা একটা করে নিয়ে দেখছে আর কেঁদে চলেছে। এ কেমন চলে যাওয়া তোমার? একটা ডাইরির মাঝে থেকে একটা কাগজ বের হয়ে পরে যায়। কাগজটা ডায়েরির কোনো পাতা নয়। এটা নতুন একটা কাগজ। লেখাটাও নতুন।

আমার বয়েসি মানুষদের সময়ের গতি
বেড়ে যায়, আর
সে সময়গুলোর রঙ ধূসর থেকে ধূসরতর হতে থাকে।
ধুসর রঙ নবীনদের ভালো লাগবার কথা নয়। কিন্তু,
আমার মুসকান হেসেছে।
এই হাসি কতোদিন দেখা হবে আমার?
সময় যে তার গতি বাড়িয়েই চলেছে…

জায়েদ – ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩ইং, বৃহস্পতিবার। মুসকানের বাসায় যাবার সময় গাড়িতে বসেই এ কেমন ভাবনা আমার লিখতে হবে? মুসকান, আমার এই লেখা তুমি পড়লে একদম মন খারাপ করবে না। জায়েদ হারায় না, জায়েদ ফিরে আসে মুসকানের হাসি দেখবে বলে…

লেখাটা পড়ার পর মুসকানের দু’চোখ যেনো আর মানছেই না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। পাশের রুম থেকে অন্য বন্ধুরা এসে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তবুও কি কান্না থামে? মুসকান মনে মনে ভাবতে থাকে, জায়েদ কি বুঝে গেছিলো যে তার যাবার সময় হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতেই বন্ধুদের বলে, তোরা একটা একটা ডায়েরির ভেতর থেকে কবিতা খুঁজে খুঁজে বের করে প্রতিটার ছবি তুলে আমাকে Whatsapp এ পাঠিয়ে দে। আমি জায়েদের কবিতাগুলো নিয়ে আগামী বইমেলা ২০২৪ এ একটা কাব্যগ্রন্থ বের করবো। জায়েদ এভাবেই বেঁচে থাকবে আমার মাঝে, আমাদের মাঝে।

জায়েদ হারায় না, জায়েদ ফিরে আসে মুসকানের হাসি দেখবে বলে…

________________________________________সমাপ্ত