অবশেষে মোটামুটি একটা রুম,এটাস্ট বাথ সম বাসা খুঁজে পেল। তবে বাড়িওয়ালা নাছোড়বান্দা। তিন মাসের বাড়া অগ্রিম নিয়ে নিল। মৃন্ময়ীর এই বাসাটা সব দিক দিয়ে ভালো মনে হয়েছিল।পাঁচ মিনিট হাঁটলেই বড় রাস্তা। তাই ঝামেলায় না গিয়ে বাসাটা নিয়েই ফেলল।বাসার জন্য কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে গিয়ে ও বেশ কিছু টাকা খরচ করে ফেলতে হয়েছে। বাসায় থিথু হওয়ার পর একটা চাকরি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন অফিসে ধর্ণা দিতে লাগলো। কিন্তু সবখানে নো ভেকেন্সি কার্ড ঝুলানো দেখতে দেখতে যখন মৃন্ময়ী মনের দিক থেকে ভেঙে পড়ছিল তখন হঠাৎ করে এক গার্মেন্টস থেকে তার ডাক আসল।অনেক জায়গায় মৃন্ময়ী চাকরির দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিল।তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে মৃন্ময়ী সে গার্মেন্টস এ যেতে সময় ব্যয় করল না।
গার্মেন্টস এ পৌঁছে মৃন্ময়ী নিজের নাম ঠিকানা পিয়নের মারফত অফিসের ভিতর পাঠিয়ে দিল।কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে মৃন্ময়ীর ডাক আসল।দুরুদুরু মনে মৃন্ময়ী যখন রুমে ঢুকল তখন দেখল সৌম্য চেহারার এক প্রৌঢ ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছে। কিছু কিছু লোক আছে পৃথিবীতে প্রথম দেখাতেই অনেক আপন এবং শ্রদ্ধা লাগে চেয়ারে বসে থাকা সে ভদ্রলোক ও তদ্রূপ। উনাকে দেখেই মৃন্ময়ীর ভালো লেগে গিয়েছিল।আর ভদ্রলোক ও প্রথমেই মা বলে সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করল পড়াশোনা কতদূর করেছে।যদিও দরখাস্তে লেখা ছিল তবু্ও তিনি জিজ্ঞেস করলেন পড়াশোনার কথা। কারণ উনার ও মৃন্ময়ীর শান্ত সুন্দর বিচক্ষণতার চেহারা দেখতে পেয়ে মৃন্ময়ী কে উনার গার্মেন্টস এর সেক্রেটারি পদটা দেওয়ার আগ্রহ দেখালেন।সাথে সাথে এও বলে দিলেন কঠোর শ্রম দিতে হবে ফ্লোরের কাজ আনুষঙ্গিক অনেক কিছু একসাথে দেখতে হবে উনার সেক্রেটারি হিসেবে। বেতন ও মোটামুটি দেওয়া হবে।
অনেক ভোরে উঠার অভ্যাস ছিল মৃন্ময়ীর।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।যদিও জাহাজে তার ভালো ঘুম হয়নি তবু ও সূর্য উঠার আগেই মৃন্ময়ীর ঘুম ভেংগে গিয়েছিল। জাহাজে ভালো কেবিন পাওয়ার জন্য ও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।কারণ যখন মৃন্ময়ী গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন দু দিনের মধ্যে কেবিন পাওয়া মুশকিল ছিল।কিন্তু জাহাজের নিয়ম অনুযায়ী কিছু ভি আই পি কেবিন রেখে দেওয়া হয় ভি আই পি দের জন্য।তাই সেদিন মৃন্ময়ী নিজের পরিচয় যখন দিল জাহাজের ম্যানেজার তৎক্ষনাত মৃন্ময়ীর জন্য এই কেবিন বুক করে পাশে লিখে রেখেছিলেন মৃন্ময়ীর পূর্ণ পরিচয়।তাই তো চেকার সে সময় মৃন্ময়ী কে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। অবশ্য মৃন্ময়ী একসময় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ভি আই পি মর্যাদায়।
সেদিন যদি দৃঢ প্রত্যয় এ গার্মেন্টস এর চাকরি টা না নিত আজকের এই পজিশনে মৃন্ময়ী কোনদিন ও আসতে পারতো না।গার্মেন্টস এ যোগদানের পরদিন থেকে নতুন এক জীবন শুরু হলো মৃন্ময়ীর জীবনে।সেদিনের পর থেকে অবশ্য আর পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি মৃন্ময়ী কে। একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে মৃন্ময়ী উপরের দিকে উঠছিল।এর মধ্যে কঠোর অধ্যাবসায় করে রাতের সিফটে লেখাপড়া করে সে মাস্টার্স ও কমপ্লিট করে ফেলেছিল।আর গার্মেন্টস এর সে সৌম্য শান্ত মালিক হাতে কলমে মৃন্ময়ী কে গার্মেন্টস এর সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে গড়ে তুলছিল একদিন যেন সে সফলতা পেতে পারে। এর মধ্যে অবশ্য মৃন্ময়ীর জীবনের কষ্ট কর কাহিনি তিনি ধীরে ধীরে জেনে গিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি মৃন্ময়ীকে নিজের মেয়ের মতো দেখতে শুরু করলেন।অবশ্য এর পিছনে ও কারণ ছিল।ভদ্রলোক এর একটা সাজানো পরিবার ছিল।যেখানে এক কন্যা এক ছেলে আর শান্ত শিষ্ট স্ত্রী নিয়ে সুখীই ছিলেন।কিন্তু উনার কপালে সে সুখ চিরস্থায়ী হলো না।একদিন সবাই যখন উইকেন্ডে বেড়াতে বের হলেন পথে বড় রকমের অ্যাকসিডেন্ট এ উনি সবাই কে হারালেন।
এরপর পুরো এক বছর উনি মেন্টালি আপসেট ছিলেন। সময় একদিন মানুষের শোক ভুলিয়ে দেয়। উনিও ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে নিজের কষ্টের কথা ভুলে যেতে লাগলেন।ফলে দিনে দিনে উনার গার্মেন্টস ব্যাবসা অনেক বড় আকার ধারণ করল। এর মধ্যে তিনি মৃন্ময়ীর মাঝে নিজের মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন।
কখন যে মৃন্ময়ী ও ভদ্রলোক কে নিজের পিতার আসনে বসিয়ে ফেলেছে টের পায়নি।দিনে দিনে দুজনের মধ্যে পিতা কন্যার সম্পর্ক তৈরি হলো।
এভাবে বেশ ভালো ভাবেই মৃন্ময়ীর জীবনটা ধীর গতিতে চলে যাচ্ছিল।অবসরে রজতের কথা মনে আসলেও সে মাথা থেকে রজতের চিন্তা ফেলে দেয়।কারণ রজত এখন সংসারী হয়েছে।এক ছেলের পিতা হয়েছে। অবশ্য মৃন্ময়ী এত কিছু জানত না যদি না সেদিন রজত মৃন্ময়ীর কাছে এসে কান্নাকাটি না করত।রজত ভুল করে ফেলেছে বলে বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে মৃন্ময়ী কে বুঝাতে চাইল।পুরাতন সম্পর্ক টাকে আবার নতুন করে পেতে চাইল রজত।কিন্তু মৃন্ময়ী কঠিন স্বরে বলে দিল রজত যেন আর কোনদিন তার কাছে না আসে।রজতের এখন বউ বাচ্ছা আছে মৃন্ময়ী অন্য একটা মেয়ের সংসার ভাংতে পারে না।তাই দৃঢ স্বরে রজত কে যখন বকা দিল তখন রজত মৃন্ময়ী এর এই রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেল।কারন শান্ত শিষ্ট মেয়েটি এখন আর আগের মতো নেই।তার মধ্যে শান্ত স্বভাবের সাথে ব্যাক্তিত্ব যোগ হয়েছে।কথা বার্তায় চলনে বলনে আভিজাত্যের ছাপ পড়েছে। তাই রজত মৃন্ময়ীর এই রূপ দেখে কিছু বলার সাহস না পেয়ে ফিরে গেল।যদিও মৃন্ময়ী এখন ও রজত কে ভুলতে পারেনি তবু্ও কঠিন ভাবে সে নিষেধ করে দিল আর কোনদিন যেন রজত মৃন্ময়ীর সাথে দেখা করতে না আসে।
না আর কোন দিন রজত মৃন্ময়ী মুখোমুখি হয়নি।এমনি করে আজ মৃন্ময়ীর জীবন থেকে আপন মানুষ ছাড়া পঁচিশ টা বছর চলে গেল।দেখতে শুনতে মৃন্ময়ী এখনো অনেক যুবকের রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো সুন্দরতা মৃন্ময়ীর মাঝে এখন অব্দি আছে কিন্তু মৃন্ময়ী সংসারের ভিতরে নিজেকে আর জড়াতে চাইল না।
মনে পড়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর সেই দুর্যোগের কথা। হঠাৎ করে সে রাতে যখন বুকে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে মৃন্ময়ীর মালিক ধর্মপিতা হসপিটালের বেডে ছটপট করছিল তখন তাকে বাঁচাতে কি যুদ্ধই না করেছিল ডাক্তার আর মৃন্ময়ী মিলে।পুরো পনের দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মৃন্ময়ী তার ধর্মপিতা কে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনল। পুরোপুরি ভালো হতে প্রায় দু মাস লেগেছিল।
চলবে…