কেবিন দেখে মৃন্ময়ী বেশ খুশি হলো। সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। সব থেকে বেশি ভালো লাগলো কাঁচ দিয়ে ঘেরা সুন্দর জানালা।দৃষ্টি সীমা অনেক দূর পযন্ত যাচ্ছে।যদিও বরিশালে বাসে করে যেতে পারত কিন্তু ইচ্ছে করে মৃন্ময়ী জাহাজে করে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছে।এতে করে বেশ কিছু অধিক সময় মৃন্ময়ী হাতে পাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। মনের মাঝে কত স্মৃতি জমা হয়ে মৃন্ময়ীর মনে ক্রমাগত যুদ্ধ করে চলছে। কত পাহাড় পর্বত চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে আজ এই মৃন্ময়ীর জন্ম হয়েছে।জীবনে কত কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।কত ঝড় ঝাপটা কঠিন হৃদয়ে বহন করতে হয়েছে।নির্বাসনে দিতে হয়েছে প্রতিনিয়ত নিজের ভালো লাগার মুহুর্ত গুলো কে। তবুও নিজেকে ভাঙ্গতে দেয়নি কখনো। ধীর চিত্ত নিয়ে সর্বদা ঝড়ের মোকাবেলা করেছে। মৃন্ময়ী জানে না বাড়িতে গিয়ে কার কার সাথে দেখা হবে।মা বাবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। সবাই তাকে কিভাবে নিবে জানে না মৃন্ময়ী।তবুও নাড়ীর টানে চলেছে বাড়ি অভিমুখে। ভাবতে ভাবতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল মৃন্ময়ী টের পেল না।জাহাজের হুইসেলের শব্দে আপন জগতে ফিরে আসল।
রাতে কিছু খাবে না আগেই বলে রাখাতে কেউ আর বিরক্ত করতে এলো না।সাথে কিছু ফল মুল নিয়ে এসেছিল।মৃন্ময়ী তাই খেয়ে নিয়ে ম্যাগাজিন বইটা হাতে নিয়ে বসল।সমানে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টোতে লাগল।কিন্তু ঝাপসা চোখে কোন অক্ষরই মৃন্ময়ী দেখতে পাচ্ছে না। জীবনে মৃন্ময়ী অনেক কঠিন সময়ে ও চোখের জল ফেলেনি। কিন্তু এখন তো আর কান্না করতে হবে না। তবে কেন চোখে জল আসছে।
মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের কথা। সব কিছু গুছিয়ে মৃন্ময়ী এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। রজতের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মৃন্ময়ীর জেদের কাছে হেরে গিয়ে অবশেষে রাজি হয়েছিল মৃন্ময়ী বিদেশে কেয়ারটেকার এর চাকরি নিয়ে যাবে। আজ সেই ক্ষন উপস্থিত।দুজনের মনেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে কি হবে অনাগত দিনগুলো। কিভাবে থাকবে একে অপরকে ফেলে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।বাস্তবতা সবাইকে মেনে নিতে হয়।রজত কে ও মেনে নিতে হলো মৃন্ময়ীর বিদেশে চাকরি করার প্রস্তাব।
বিদেশে কেয়ারটেকার এর চাকরি টা বেশ কয়েকমাস মৃন্ময়ী ভালো ভাবেই করল।একজন বৃদ্ধ মহিলার দেখাশুনা করতে হতো।বেতন ও বেশ ভালোই দিত।বিদেশের চাকরি টা যখন মৃন্ময়ী বেশ খুশি মনে করতে লাগলো তখন হঠাৎ করেই মাস ছয়েক পড়ে মৃন্ময়ীর জীবনে আবার ঝড় আসল।এর মধ্যে অবশ্য রজতের সাথে মৃন্ময়ীর সপ্তাহে দু তিনবার কথা বার্তা হতো। কিছু টাকা জমাতে পারলেই মৃন্ময়ী দেশে ফিরে এসে আবার পড়াশোনা চালিয়ে যাবে এরকম একটা প্ল্যান মৃন্ময়ী করে রেখেছিল।কিন্তু বিধি বাম।ঝড়টি সামলানো মৃন্ময়ী এর জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। কারণ যে মহিলার সেবা করত একদিনের জ্বরে সেই মহিলা মারা গেল।মহিলাটির বয়স ও কম ছিল না।তাই জ্বর এর ধাক্কা সামলাতে পারল না।মৃত্যুবরন করে মৃন্ময়ী কে পথে বসিয়ে গেল।বিদেশ বিভুঁই দেশ সাহায্য করার ও কেউ ন। এর মধ্যে বিদেশের মাটিয়ে মৃন্ময়ী আগের চাইতে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিল।প্রথমে যে মহিলার সেবা করত সে পরিবারের সবাই ভালো মনের ছিল বলে মৃন্ময়ী কোনদিন অসুবিধায় পড়েনি।কিন্তু মহিলার মৃত্যুর পরে সে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। যেখানেই চাকরির খোঁজে যায় সেখানেই কামুক চাহনি দেখে চাকরি করবে না বলে বাসায় ফেরত আসে।মাস দু মাস চাকরি যোগাড় করতে না পেরে মূলধন খরচ হয়ে যেতে লাগলো। প্রমাদ গুনা শুরু করল মৃন্ময়ী।বেশিদিন এভাবে সেদেশে থাকতে পারবে না।কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।এদিকে রজত ও মৃন্ময়ী কে দেশে ফেরত না এসে সেখানে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলল।
অবশেষে মৃন্ময়ী মাস চারেক পড়ে মোটামুটি একটা চাকরির সন্ধান পেল।যদিও বেতন আগেরকার মতো নয় তবু ও চালিয়ে নিতে পারবে বলে মৃন্ময়ী চাকরি টা নিয়ে নিল।এই চাকরি টা অবশ্য অন্য রকমের ছিল।আগের চাকরি তে শুধু বৃদ্ধ কে দেখাশুনা করতে হতো কিন্তু এই চাকরি তে সারাদিন ঘরের কাজ করতে হতো। ফলে এত বেশি ক্লান্ত থাকত রজতের সাথে কথা বলার সময় ও কম পেত।ফলে দুজনের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি শুরু হতে লাগলো । তবু্ও মৃন্ময়ী সম্পর্ক টা যেন ভেঙে না যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত।
এসব কথা চিন্তা করতে করতে মৃন্ময়ীর এক্টুখানি চোখ লেগে এসেছিল।কিন্তু জাহাজের অধিক মাত্রায় দুলুনিতে তন্দ্রা ভেঙে গেল । বুজতে পারল না জাহাজের কি সমস্যা হলো। কিছুক্ষণ বাইরে মানুষের কথা বলার শব্দ পেল।এরপর সব চুপচাপ। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমুতে পারছে না শুধু মৃন্ময়ী।বাড়িতে পা দেওয়ার পর সবাই কিভাবে মৃন্ময়ী কে গ্রহণ করবে বুঝতে পারছে না।সে ও কি বলে কথা শুরু করবে সেটা এখনো চিন্তা করেনি। পরশুদিন ম্যাগাজিন হাতে পাওয়ার পরে এবং দুপুরের সেই টেলিফোনে খবর টা পাওয়ার পরেই মৃন্ময়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সে বাড়ি যাবে। রাস্তাঘাট ও নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে।অবশ্য এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।নিজের গ্রামের নাম তো জানে।জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। সে নিয়ে ভাবনা নেই।এসব চিন্তা করতে করতে আবার চোখ লেগে আসল।
ঘন্টা খানেক ঘুমানোর পড়ে মৃন্ময়ীর আবার ঘুম ভেংগে গেল।অবশ্য এবার ঘুম ভাংগলো সেই বিভীষিকাময় স্বপ্নটা দেখে।সেই রাতের পর থেকেই মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে মৃন্ময়ীর ঘুম ভেংগে যায়।স্বপ্নে দেখে মৃন্ময়ী দৌড়াচ্ছে আর পিছনে নরখাদক প্রায় ধরে ফেলছে মৃন্ময়ী কে।এর পরই ঘুম ভেংগে যায়।আর মৃন্ময়ী আহত পাখির মতো থিরথির করে কাঁপতে থাকে। স্বপ্নে মৃন্ময়ী কে ধরার আগে ঘুম ভেংগে গেলে ও সেদিন কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি মৃন্ময়ী। তার সমস্ত সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল মালিক তার পত্নীর অনুপস্থিতিতে। এখনো মনে উঠলে মৃন্ময়ী নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।এরপর থেকে মৃন্ময়ীর উপর অত্যাচার নিত্য ঘটতে থাকল।অবশেষে মৃন্ময়ী বিদেশে থাকার কথা আর চিন্তা করতে পারল না। দেশে ফিরে আসল প্রায় শুন্য হাতে।
মৃন্ময়ীর উপর অত্যাচার এর কথা রজত কে বলার পরে রজত মৃন্ময়ী কে তার একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য করতে পারবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দিল।দিশেহারা মৃন্ময়ী কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।বারবার মনকে বুঝাতে লাগলো হেরে যাবে না। আকাশ ছোঁয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল তার সব কিছু শেষ হয়ে গেলে ও সে নতুন করে আবার উঠে দাঁড়ানোর দৃঢ প্রত্যয় মনের মাঝে বাঁচিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছেকে ব্যক্ত করল দৃঢ মনোবলের সাথে। দেশে এসে মৃন্ময়ী কমদামি একটা হোটেলে উঠল দু চারদিনের জন্য। কারণ বিদেশ থেকে আসার সাথে সাথে তো বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না। তাই দেশে আসার পরদিন থেকে মৃন্ময়ী চাকরি এবং বাসা দুটোই হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করল।
চলবে…