মিস মৃন্ময়ী মিত্র এই নামেই টিকেট কাটা হয়েছে। চেক করে দেখুন তো একবার।কোন কেবিন আমার নামে বুকিং দেওয়া আছে? খুব অবজ্ঞা করে চেকার চোখ তুলে কন্ঠস্বরের অধিকারী কে দেখতে গিয়ে মারাত্মক ভাবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে গিয়ে কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিল।আনমনেই চেকার নিজের হাতে ছোট্ট করে চিমটি কাটল।তার সামনে অপরুপ সুন্দরী, মার্জিত, স্মার্ট, গাম্ভীর্য পুর্ণ রমণী কে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য চেকার মিজান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মিজান তোতলাতে তোতলাতে বলল, জ্বী ম্যাডাম দে খ ছি।
বুকিং খাতা বের করে চেক করতেই নামটা দেখে চেকার মিজান আর একবার চমকে উঠলো। তার সামনে কিনা নামকরা বিশাল গার্মেন্টস শিল্পের মালিক মৃন্ময়ী মিত্র দাঁড়িয়ে আছে। মিজান নিজেকে স্থির করতে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সামনে রাখা গ্লাসের পানিটা এক নিশ্বাসে ঢক ঢক করে খেয়ে একটু স্থিমিত হয়ে নিজেই ম্যাডামের ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে সামনে এগোতে লাগলো। মৃন্ময়ী কিছু না বলে চেকারের পিছন পিছন যেতে লাগলো। ১০৫ নাম্বার রুমের সামনে এসে মিজান ম্যাডাম কে দাঁড়াতে বলে নিজে রুমের ভিতরে গিয়ে সব কিছু ঠিক আছে কিনা নিজে একবার চেক করে নিল। সবগুলো একবার ভালো করে চেক করে সন্তষ্ট চিত্তে ম্যাডাম কে ভিতরে যেতে বলে চাবিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে প্রস্থান করল।
মৃন্ময়ী অফিস বাসা কাউকে জানায়নি।নিজেই টিকেট করেছে। নিজের গ্রামের বাড়ি যাবে বলে। অবশ্য বাসায় যে কাউকে বলতে হবে সে রকম নিকট জন বলতে মৃন্ময়ীর কেউ নেই।গোটা চারেক চাকর বাকর আর বৃদ্ধ ধর্ম পিতা।এ কয়জন কে নিয়ে মৃন্ময়ীর জগৎ। তাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না মৃন্ময়ী। শুধু বাসার প্রধান কেয়ারটেকার কে বলল সে কয়েকদিনের জন্য গার্মেন্টস এর কাজে বিদেশ যাচ্ছে। প্রায় সময় মৃন্ময়ী বিদেশে আসা যাওয়া করে। তাই এই নিয়ে কার ও তেমন ভাবান্তর হয়নি কারো মধ্যে।
এতটা বছর পরে প্রায় পঁচিশ বছর হবে নিজ গ্রামের বাড়ি বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা ভার্সিটি তে।সে অব্দি আর বাড়ি মুখো হয়নি মৃন্ময়ী। কিভাবেই বা হবে।সেদিন মৃন্ময়ী এক প্রকার কাউকে না জানিয়ে রাতের গভীরে বাড়ি থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসেছিল। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ছিল তার। লেখাপড়া শিখে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে।মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে মৃন্ময়ী ভাই বোনদের মধ্যে তৃতীয় ছিল।বড় বোনের এস এস সি পাশ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।মধ্যে খানে ভাই।এরপর মৃন্ময়ী। মৃন্ময়ী এর পরে আরও তিন জন ভাইবোন আছে।দেখতে শুনতে সবাই বেশ সুন্দর বলা যায়।উজ্জ্বল রং চোখ, খাঁড়া নাক সব মিলিয়ে সবাই মা বাবার মতোই সুন্দর হয়েছিল।তাইতো একটু বড়ো হতে না হতেই ঘটক বাড়ির মধ্যে বিয়ের জন্য আনাগোনা করতে লাগলো। মৃন্ময়ী অনেক জোর করে এইস এস সি পযন্ত বিয়েটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল।এরপর আর পরিবারের সাথে লেখাপড়া করার জিদ বজায় রাখতে না পারায় সেদিন মৃন্ময়ী রাতের অন্ধকারে ঘর ছাড়া হলো সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে।
অজানা শহরে এসে মৃন্ময়ী অনেক কষ্টে তার ছোট বেলার বান্ধবীর ঠিকানা খুঁজে বের করল।বাড়ি থেকে আসার সময় সে ঠিকানা টা অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছিল বান্ধবীর মায়ের থেকে। ভাগ্যে ভালো ছিল মৃন্ময়ীর বাসা খুঁজে নিতে বেগ পেতে হলোনা। তবে মৃন্ময়ীর বান্ধবী সেদিন মৃন্ময়ী কে দেখে খুব বেশি খুশি হতে পারেনি।একান্নবর্তী পরিবারের বউ হয়ে মৃন্ময়ী কে সাহায্য করার দুঃসাহস সে দেখাতে সমর্থ ছিল না। তাই তো নিজের কাছে মৃন্ময়ী কে দু দিনের বেশি রাখতে পারল না।অবশ্য এই দুদিনেই বান্ধবী তার দেবর রজত কে দিয়ে মৃন্ময়ী এর জন্য হোস্টেলে থাকার সু বন্দোবস্ত করেছিল।রজত ও অবশ্য বউদির বান্ধবীর জন্য কিছু সহযোগিতা করতে বিরক্ত প্রকাশ করেনি।বউদির সুন্দরী বান্ধবী বলে কথা। তাই অতি সহজে মৃন্ময়ী থাকার একটা ঠিকানা পেয়ে গেল রজতের সাহায্যে।
কয়েক মাস নিশ্চিন্তে চলতে পারার মতো টাকা আর মায়ের একটা গলার হার মৃন্ময়ী সাথে করে নিয়ে এসেছিল।ভেবেছিল চাকরি করবে পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।ভালো একটা ভার্সিটি তে মৃন্ময়ী ভর্তি হয়ে গেল।চাকরি পেতে বেশ বেগ পেতে দেখে সহপাঠীরাই কয়েকটি টিউশনি যোগার করে দিয়েছিল।।সব দিক দিয়েই মৃন্ময়ীর সৌভাগ্য ছিল বলে অনায়াসে ভার্সিটি তে ভর্তি টিউশনি পাওয়া কোন কিছুতেই আটকালো না। তদুপরি রজতের মতো একজন ভালো বন্ধু জুটলো। যে কিনা সব কাজেই মৃন্ময়ী কে সাহায্য করতে পিছ পা হতো না। অবশ্য রজত ও ভালো স্টুডেন্ট ছিল। সে মাস্টার্স শেষ পর্বে আছে।একই ভার্সিটি তে। তাই ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী আর রজতের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হতে লাগলো। এত বড় বিশাল শহরে এক প্রকার গার্ডিয়ান এর মতো ও রজত মৃন্ময়ীর সব কিছু দেখাশোনা করত। ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী ও রজতের মধ্যে গভীর প্রণয়ের সূত্রপাত হতে বেশি সময় লাগলো না।
মানুষের জীবন সব সময় ভালো যায় না। মৃন্ময়ীর জীবনে হঠাৎ করে ঝড় নেমে আসল। কঠিন পরিশ্রম করতে গিয়ে কঠিন অসুখে পড়ল মৃন্ময়ী। কয়েক মাস অসুখের সাথে যুদ্ধ করে মৃন্ময়ী সুস্থ হলো বটে কিন্তু এর মধ্যে তার যা কিছু টাকা জমিয়েছিল তা তলানিতে এসে টেঁকল। টিউশনি সব একে একে চলে গেল।মাত্র দেড় বছর ভার্সিটি তে পড়ে পরবর্তী লেখাপড়া চালানোর মতো তার আর টাকা পয়সা রইল না।কিছুদিন হন্যে হয়ে অফিসের দ্বারে দ্বারে চাকরি খোঁজে বেড়াতে লাগল।কিন্তু কিছুতেই কোন কিছু যোগাড় করতে পারছিল না।এদিকে রজতের ও এখন পযন্ত চাকরি হয়নি যে সে মৃন্ময়ী কে সাহায্য সহযোগিতা করবে।মৃন্ময়ী জানে রজত তাকে অনেক বেশি ভালবাসে।মৃন্ময়ী ও রজত কে নিজের চাইতে বেশি ভালবাসে। তাইতো সে রজতের সাহায্যে করতে না পারাকে খারাপ ভাবে নিল না।
এভাবে কতদিন আর চলতে পারবে ভাবতে ভাবতে মৃন্ময়ী যখন প্রায় ভেঙে পড়ছিল সে সময় পেপারে এক বিজ্ঞাপন এ নজর পড়ল। বিদেশে কিছু মেয়ে কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে এক এজেন্সি। ভালো বেতন দেবে সাথে থাকা খাওয়া ফ্রী এবং নিয়ে যাওয়ার সমস্ত খরচ অফিস বহন করবে। মৃন্ময়ী এই বিজ্ঞাপন দেখে আর কোন কিছু চিন্তা করা ভুলে গেল।কারণ সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। পরিবার তাকে ত্যাগ করেছে।এমতাবস্থায় সে বাড়ি ও ফিরে যেতে পারছে না।তাই রজত কে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে ফেলল মৃন্ময়ী।
চলবে…