এটা একটা মালেক মামার গল্প!
আমার বয়েস তখন ছয় সাত বছর হবে। সম্ভবত সালটা তিয়াত্তর কিংবা চুয়াত্তর ছিলো। ঘরে খাবার নেই। সারাদিন আমরা না খেয়ে আছি। কান্না করেছি। মায়ের কিছু করার নেই। ঘরে কোনো খাবার নেই। থাকি খিলগাঁ রেলওয়ে কলোনীর ঠিক বাইরে কোনো এক বস্তিমতো টেনসেড বাসার এক রুমে। না খেয়ে তো অনেকদিনই থেকেছি, কিন্তু কোনো কোনো মূহুর্ত বা ক্ষণ মনে থাকে সারাজীবন। সেদিনের ভাসা ভাসা স্মৃতি আজও মনে গেঁথে আছে।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে মালেক মামা এসে হাজির। ঘরে খাবার নেই, মায়ের কাছ থেকে একথা শুনে তিনি আমাকে সাথে করে নিয়ে রেল লাইনের ওপরে গড়ে ওঠা বাজারে গেলেন। কিছু চাল কিনলেন, কিছু সব্জি তরি তরকারি কিনলেন, আর মাংস। আমি আজও ভাসাভাসা দেখতে পাই, বাজারের কাউকে সেদিন ১০ টাকার নোট দিয়েছিলেন আমার হাত দিয়ে।
সম্ভবত আমাদের সেই মালেক মামা পুরো মাসের বাজার করে দিয়েছিলেন। না খেয়ে কাঁদতে হয়নি বেশ কিছুদিন। এবার পরিচয় করিয়ে দেই, কে এই মালেক মামা।
আমার জন্মের আগে কিংবা ঠিক অব্যবহিত পরে পুরোনো ঢাকায় পাশাপাশি কাছাকাছি কোনো বাসায় ছিলেন এই মালেক মামা। অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশি ছিলেন। তখন আমার বাবার সাথে তার মামা মামা ডাকের সম্পর্ক ছিলো। সেই ছোটবেলা থেকে আমরাও মানে আমি আর আমার ছোট ভাইও তাকে মালেক মামা বলে ডাকতাম। অর্থাৎ তিনি আমাদের সকলের মালেক মামা হয়ে গেলেন। উনি চাকরি করতেন বিমানে। তার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো। কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা হেল্প করার জন্যেই হয়তো জীবনে আসেন। বাবার চাকরির বেতন দিয়ে সংসার চালাতে অনেক টানাটানি হতো। এই মালেক মামাই আমাদের হেল্প করতেন। কিছুদিন পরপর হঠাত হটাত তিনি কোত্থেকে যেনো উদয় হতেন। আমার মায়ের হাতের রান্না উনার অনেক পছন্দ ছিলো। বাজার করে নিয়েই আসতেন। মা রান্না করতেন। উনি খেতেন। তারপর কিছুক্ষণ আমাদের সাথে সময় কাটিয়ে চলে যেতেন। মায়ের হাতের রান্না খাবার ছলে হয়তো হেল্প করতেই তিনি আসতেন। খবর রাখতেন নিয়মিত…
এই মালেক মামার কথা আমার মনে আছে সেদিন থেকে অর্থাৎ যেদিন আমরা দুই ভাই সহ বাবা মা ক্ষুধায় কেঁদেছিলাম। উনি এসেছিলেন। বাজার করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এর আগের কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই।
এই মামা, আমাদের মালেক মামা আমাদের জীবনে হঠাত হঠাত প্রায়ই এসে হাজির হতেন। আমার মনে আছে, যখন ওসমানী মিলনায়তনের পেছনে উঠোন ওয়ালা রেলওয়ে কলোনীতে ভাড়া থাকতাম তখন কোনো এক ঈদে তার ছেলের কিছু অব্যবহৃত নতুন জামাকাপড় দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটা সাদা সার্ট ও প্যান্ট ছিলো। সাইজ একটু বড় ছিলো। বাবা নিজে কেটে ছোট করে নিজ হাতে সুই সুতা দিয়ে শেলাই করিয়ে ধুয়ে পাশের বাড়ি থেকে কয়লার ইস্ত্রি নিয়ে এসে ইস্ত্রি করিয়ে নতুন (!) জামায় আমাদের ঈদ হয়েছিলো। ঈদ মানে খুশি। আমরা দুইভাইও অনেক খুশি হয়েছিলাম। আমি তখন রেলওয়ে স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি। সেই স্কুলটা ছিলো বর্তমান ওসমানী মিলনায়তনের পেছনে ওসমানী উদ্যানে যে পুকুর আছে সেখানে। পাশেই মেতর পট্টি ছিলো। তারা প্রতিদিন সকালে বালতি বালতি গু নিয়ে ঐ পুকুরে ফেলতো। ঐ এলাকার প্রতিটা টয়লেট ছিলো বেশ উচু করে বানানো। নীচে বালতি থাকতো। পেছন দিয়ে মেতরেরা সেই বালতি থেকে গু ঢেলে নিয়ে চলে একসাথ করে সেই পুকুরে ঢালতো। আমরা গন্ধ সহ্য করেই স্কুল করতাম। টিফিন পিরিয়ড যখন বন্ধুরা বল খেলতাম, কতোবার যে ঐ গুয়ের পুকুরে বল গিয়ে পড়েছে আর কিভাবে যে সেই বল পুকুর থেকে তোলা হয়েছে সে আরেক কাহিনী।
ঊনাশি সালে আমার বাবা সরকারি বাসা পায়। আমরা মিরপুর ১৪ তে চলে আসি। সেপ্টেম্বর মাস ছিলো। কলোনীতে তখন কারেন্টের কানেকশন ছিলোনা। এখনও মনে আছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সে কি কুয়াশা আর বিল্ডিং এর সামনের ঘাসে শিশির জমা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে উঠেছি। বাবার সাথে অফিসের স্টাফ বাসে করে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। আমার বাবা চাকরি করতেন আবদুল গণি রোডে অবস্থিত খাদ্য ভবনে, যা স্কুলের একদম কাছেই। আবার অফিস ছুটির সময় বাবার সাথে চলে আসতাম। আমার স্কুল ছুটির পর আমাকে প্রায়ই ঘন্টাখানেক বাবার অফিসে কাটাতে হতো। একদিন তার সাথে নীচতলায় রেকর্ড রুমে যাই। সেখানে অনেক গুলো র্যাকে ফাইল সাজানো থাকতো। ধুলো আর মাকড়সার জালে ভর্তি ছিলো। একদিন আমি একটা কাঠের রুলার দিয়ে সবগুলো ফ্যানের পাখা ঘুরিয়ে দিলাম। দুই একটা বাদে প্রায় সবগুলো ফ্যানই কিছুক্ষণ পরেই গেলো। আমি তাতেই খুশি। পরেরদিন স্কুল থেকে অফিসে গিয়ে দেখি তখনও দুই একটা ফ্যান ঘুরছে। আমি ভেবে পাইনা, কিভাবে তখনও ঘুরছে। ছোট মানুষের মনের প্রশ্নের উত্তর নেই। বড় হয়েও এর উত্তর অনেকদিন খুঁজেছি। অবশেষে একটা যুক্তি দাড় করাই। আর তা হলো, অনেকদিন ফ্যানগুলো না চলতে চলতে সেগুলো ঘোরার অনুপযোগি হয়ে গেছিলো। হয়তো কারেন্টের সুইচ দেয়া ছিলো এবং আমি জোর করে রুলার দিয়ে পাখা ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম আর সেটা কারেন্টের কানেকশন থাকার কারনে ঘুরেই চলেছিলো। যাই হোক, আবার মালেক মামার কথায় আসি।
মিরপুরে চলে আসার পর আমাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। মা একটা সরকারি চাকরিতে জয়েন করে। বাবা মা দুইজনের আয়ে এখন অন্তত আর না খেয়ে থাকতে হয়না। আমাদের সেই মালেক মামার সহযোগিতারও দরকার পড়েনা। কিন্তু মালেক মামা ঠিকই আসতেন। আমার মার হাতের রান্না খেতে, বিশেষ করে হাসের মাংস খেতে। অবশ্য হাসটা মালেক মামাই বাজার থেকে কিনে নিয়ে আনতেন।
আমি একসময় স্কুল কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার বাবার এক কলিগের থেকে একটা ঘড়ি ধার করে এনে দেয়া হয়েছিলো। আমি সেটা হাতে দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, এবার এই পুরোনো ঘড়ি হাতে দিয়েই পরীক্ষা দেন। ভালো রেজাল্ট করলে দামী দেখে একটা ঘড়ি কিনে দেবো। একটা মজার কথা বলি। আর তা হলো, আমার বাবা আমাদের দুই ভাইকে আপনি সম্বোধন করতেন। কেনো করতেন তা আজও জানিনা।
পাশ করলাম। এলো সেই খুশির দিন। বাবা আমাকে সাথে করে নিয়ে বায়তুল মোকাররমে তার পরিচিত এক ঘড়ির দোকানে গেলেন এবং আমাকে ১২০০ টাকা দিয়ে একটা ঘড়ি কিনে দিলেন। পরে জেনেছিলাম, সেই মালেক মামা এই টাকাটা আমার বাবাকে দিয়েছিলেন। পরে শোধ দেয়া হয়েছিলো কিনা, জানিনা।
মাঝখানে অনেকদিন মালেক মামাকে আসতে দেখিনা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তিনি হঠাত একদিন বাসায় এসে হাজির। এতোদিন আসতে পারেননি বা দেখা করতে পারননি তার কারন ছিলো, তাকে কোলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে পোস্টিং করা হয়েছে। বাংলাদেশে এসে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। এবার তিনি আমার মা’কে অন্যরকম একটা প্রস্তাব দিলেন – ছেলেদের সাথে মামা ডাকটা স্ট্যাবলিশ করলে কেমন হয়। অর্থাৎ তিনি তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথাটা ইঙ্গিতে জানালেন। তারপর যাবার সময় আমাকে বললেন, মামা তুমি ইন্ডিয়া বেড়াতে চলে আসো। ঘুরে দেখার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। আমি পাসপোর্ট করালাম। টুরিস্ট ভিসার আবেদন করলাম। আমাকে সাত দিনের ভিসা দেয়া হলো। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মামা বললেন, সমস্যা নেই। ওখান থেকে তিনি ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নেবার ব্যবস্থা করাতে পারবেন। মামার ছুটি শেষ হয়ে যাওয়াতে আগেই তিনি চলে গেলেন। বলে গেলেন, তুমি একাই চলে আসতে পারবে। প্লেনে উঠবে আর নামবে। দমদম এয়ারপোর্টে তো আমি থাকবোই।
এলো সেই দিন। আমি রওয়ানা হলাম। প্লেন আকাশে। কেমন যেনো কানে হালকা ব্যাথা অনুভব করছিলাম। তারপর মনে পড়ে বাতাসের চাপ কমে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। আমি পৌঁছে গেলাম ঠিকঠাক মতোই।
এবার আর মালেক মামা আমাদের বাসায় নয়। আমিই মালেক মামার বাসায় গিয়েছি বেশ কিছুদিন থাকবো বলে। তার মেয়েকে দেখে তো আমার হুশ উড়ে গেলো। মালেক মামা প্রায় ছয় ফিট লম্বা ছিলেন। তার মেয়েও বেশ লম্বা, ৫’-৫” প্রায় আমার সমান। আমি ৫’-৭” হলেও মনে হলো হাতির পাশে তালপাতার একজন সেপাই। তবে আন্তরিক মনে হলো। এই প্রথম মালেক মামার মেয়ে সোমা’র সাথে আমার দেখা। বিকেলে বেড়াতে বের হলাম। সেখানে ও ওর বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়।
পরেরদিন সোমা’র মাথা ব্যাথা থাকায় আমি একাই বিকেলে বের হই সেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। এই ঘটনাটা ছিলো আমার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা। সবাই মিলে হোটেলে চা নাস্তা খাই। আমি ভেবেছিলাম বিলটা আমিই দেবো। সবার খাবার শেষে যখন আমি খাবারের বিল দিতে যাই তখন শুনি ওরা ওদের যার যার বিল দিয়ে ফেলেছে। আমারটা বাকি। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইলাম। আমি আমার বিল দিলাম। হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ওদের থেকে বেদেয় নিলাম। এটাই ওদের কালচার! আমার মন নষ্ট হয়ে গেছিলো। দেশে তো আমরা বন্ধুরা কখনই যার যার বিল তার তার দেয়ার রেওয়াজ দেখিনি। কে আগে মানিব্যাগ বের করবে সেই প্রতিযোগিত হতো। যেখানে আমি গিয়েছিলাম অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য বেড়াতে, আর তিক্ত ঘটনাটা ঘটার কারনে আমার মন ভেঙ্গে যায়। কখন দেশে ফিরে আসবো সেই চিন্তা। এরপর যে পাঁচদিন ছিলাম, আমি আর ঘর থেকে তেমন বেরই হইনি। শুধু একবারে দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছিলাম। মাঝে অবশ্য একদিন সোমার সাথে দুপুরের শো’তে একটা হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। এই হলো আমার ইন্ডিয়া বেড়ানো।
আমার ফেরার আগের দিন আমি একাই বের হলাম। উদ্দেশ্যহীণভাবে ঘুরতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে খুবই পুরোনো একটা বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। আমি হাতের রেখা সংক্রান্ত কিছু বই দেখাতে বললাম।
বই দেখতে দেখতে হঠাত আমার একটা বইয়ের ওপরে নজর যায়। সম্মোহন বা হিপনোটিজমের বই। আমি কয়েক হাজার টাকার বেশ কিছু হাতের রেখার ওপর বই কিনলাম আর সাথে হিপনোটিজমের ওপরেও কয়েকটা বই। এই ছিলো আমার ইন্ডিয়াতে কেনাকাটা।
পরেরদিন ফিরে এলাম। সোমা’র সাথে বিয়ের কথাটা আর এগোয়নি। তার কারন, সোমা আমাকে বলেছিলো তার নাকি পছন্দের কেউ রয়েছে। সোমা জানতো আমার বেড়াতে আসার কারন। আমি হেসেছি আর বলেছি, আমি তো তোমাদের এখানে শুধুমাত্র বেড়াতে এসেছি। আমরা তো বন্ধু। হাত বাড়িয়েছিলাম। সোমা আমার বন্ধুত্বের হাত ধরেছিলো।
এরপরেও অনেকদিন আমাদের সেই মালেক মামা আমাদের বাসায় এসেছেন। মায়ের হাতের রান্না খেয়েছেন। ফিরে গেছেন। তারপর এমন একদিন এসে বললেন তার এখন আমেরিকায় পোস্টিং হয়েছে।
আমাদের মালেক মামা আমেরিকা চলে যাবার পর আর দেখা মেলেনি। তিনি এরপর বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা তা জানা নেই। এখন বেঁচে আছেন কিনা তাও জানিনা। থাকলেও অনেক বয়েস হয়ে গেছে। যদি আবার দেখা হয় তবে কি আমি তাকে চিনতে পারবো? তিনি পারবেন? মালেক মামা – এ ডাক নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন না। কিছু স্মৃতি কারো মাথা থেকে কখনই মুছে যায়না।
এমন মালেক মামা অনেকেরই থাকে। তারা আসে, তারা আসবে, তাদের আসতে হয়।
__________________________
মালেক মামা
আলম এম.
২৪ আগস্ট, ২০২২ইং, বুধবার