ললাট লিখন (পর্ব-২)

আরশী বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা পর্যবেক্ষণ করলো। ছবি থেকে রঙ গুলো দেওয়াল বেয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। হয়তো অতিরিক্ত রঙের ব‍্যবহারের জন্য এমন হচ্ছে। আরশী ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে ঐতিহ্যের দিকে তাকালো। ছেলেটা সেই আগের মতোই ঘুমে অচেতন। দেওয়ালের ছবিটা যে ওই এঁকেছে এতে কোনো সন্দেহ হচ্ছে না কিন্তু ছেলেটাতো বোবা কথা বলতে পারেনা ওর দ্বারা এতো সুন্দর নিখুঁত কাজ আদো কি সম্ভব? কথাগুলো ভেবে ও হাটতে হাটতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। রুম থেকে মন মাতানো ফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। নানা রকমের ফুলের সমাহার। ঘরটাকে ঘর না ফুলের দোকান বলে মনে হচ্ছে। এসবের আদো দরকার ছিল বলে ওর মনে হয় না। লোকটা এসবের মানে বুঝলে কথা ছিল। আরশীর এখন আর কান্না পাচ্ছে না। কষ্ট গুলো হৃদয় দিয়ে তেমন করে অনুভব করতে পারছে না। এই বাড়িতে কে কে আছে ওর তার কিছুই জানেনা।

এখন ভোররাত,কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে আজান হবে। কথাটা ভেবে ও আড়মোড়া দিতেই ঘাড়ে তীব্র ব‍্যাথা অনুভব করলো। ও হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল সেখানে সামান্য একটা ছিদ্র আর সেই ছিদ্র দিয়ে হালকা রক্ত বের হচ্ছে। হঠাৎ করেই ওর সেই স্বপ্নের কথা মনে হলো। সত্যিই কি ওটা স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব? প্রশ্নটা মনে হতেই ওর গা ছমছম করে উঠলো। আরশী আর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তাড়াতাড়ি রুমে আসতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। আরশী কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ খুললো না। তবে ভেতর থেকে হাতে ক্লাব দেবার আওয়াজ হচ্ছে। মানে ঐতিহ্য ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মজা নিচ্ছে। আরশীর বিরক্তি লাগলো। হাবাগোবা দেখলে কী হবে পাজির পা ঝাড়া। ও মনে মনে আচ্ছা রকম বকা দিলো। তবুও মনকে শান্ত রেখে দরজায় হাত রেখে বলল,

শুনছেন,দরজা খোঁলেন আমি ভেতরে আসবো।
আরশীর আওয়াজ প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসলো কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। বরং লাইট বন্ধ করে নীরব হয়ে গেলো। আরশী বিরক্তি নিয়ে বলল,
এদের দ্বারা এসবই সম্ভব। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় দেই।

আরশী ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে দরজার পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। কপাল চাপড়াতে মন চাইছে। ইচ্ছে করছে কপালে কেটে দেখতে সেখানে সুখের বিন্দু বিসর্গ আছে কিনা। বাকীরাতটুকু ও জেগেই কাটিয়ে দিলো। অনেক ঘুমিয়েছে এখন আর ঘুম আসবে না। লোকটা বোকা কিন্তু ভীষণ রকমের ফাজিল। এগুলোকে সকাল বিকাল নিয়ম করে থাপ্পড় দিলে সোজা হয়। আদর পেয়ে মাথায় উঠে বসে আছে। আরশী বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল। ও কিছুইতেই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ওর সহজে রাগ হয়না আবার একবার হলে থামাতে চাইনা। কিন্তু এখানে রাগ করেই বা কি হবে। কথায় বলে শশুর বাড়ি না জমের বাড়ি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ‍্য করতে হবে। ওর ভাবতে ভাবতেই দুর থেকে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসলো। দূরে গেটের সামনে কুকুর ডাকছে। আরশী সেখানেই ঠাই বসে আছে। নামাজ পড়তে হবে কিন্তু ভেতরে যাবে কিভাবে? আজান শেষে চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। আরশী এবার পাশ ফিরে দরজায় হাত রাখলো আর ওমনি দরজা খুলে গেলো। ওর আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখলো ঐতিহ্য সেখানে নেই। লোকটা গেলো কোথায় ভেবে ও বাথরুম চেক করলো কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। ও লাইট জ্বালিয়ে নিয়ে ঘরটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলো। ঘরে আসবাবপত্র বলতে সোফা, একটা খাট,ড্রেসিং টেবিল আর ছোট একটা আলমারি আছে। ও দেখতে দেখতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো কারণ সেখানে কোনো ছবি নেই। শূন্য নীল দেওয়ালটা ঝকঝক করছে। আরশীর চোখ কপালে উঠে গেলো। তাহলে কি তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিল? জীবন্ত স্বপ্ন নাকি বাস্তব? ও এসব ভাবতে ভাবতে নামাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আরশী একপা দুপা করে নিচে নেমে আসলো। নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে। বিশাল বড় ডাইনিং রুমটা কেমন মরুভুমির মতো ধু ধু করছে টেবিল ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই। বড়লোক বাড়ির ডাইনিং রুম সাধারণ এমন হয়না। চারদিকে দামি দামি আসবাবপত্র থাকবে লাইন করে সোফা থাকবে কিন্তু এখানে কিছুই নেই। আরশীর কৌতূহল বেড়েই চলেছে। ও সাবধানে পা টিপে টিপে মাঝামাঝি আসতেই রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসলো,

বউমা এদিকে আসো।

রাত্রী আলো আধারের মধ্যে হঠাৎ আওয়াজ শুনে চমকে উঠে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরে অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে ওর শাশুড়ি কিছু একটা তৈরী করছে। আরশী পাশে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,

আম্মা এতো ভোর সকালে আপনি রান্না করছেন?
ঐতিহ্যের ক্ষুধা পাইছে। কাল বিকালে খেয়েছিল আর খাওয়া হয়নি।। মারে আমার ছেলেটার বুদ্ধি খুবই কম কখন কি করে ঠিক পাইনা।রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে এখন জেগে উঠেই খাইতে চাইছে। তোমাকে ঘরে পাঠিয়ে ওকে কতবার বলেছি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই রাজি হলো না। তোমাকে একা থাকতে হলো কিছু মনে করোনা মা। তুমি দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমারও তো সখ করে নাতি নাতনির মুখ দেখে কবরে যায়। বংশের বাতি জ্বলুক। আমার জন্য তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

শাশুড়ির গলা থেকে আক্ষেপ ঝরে জরে পড়ছে কিন্তু একটা কথা আরশীর কানের মধ্যে ঝনঝন করে বেজে উঠলো। গতকাল রাতে ঐতিহ্য ওর ঘরেই ছিল ও নিজের চোখে দেখেছে এবং বেলকনির ঘটনাটা চোখের সামনে এখনো ভাসছে তাহলে উনি বললেন কেনো ঐতিহ্য ওর ঘরে আসেনি? আরশী ভাবলো ওর শোনায় ভুল ছিল তাই দ্বিতীয়বার আবারও জিঞ্জাসা করলো,

আম্মা উনি আমার ঘরে আসলেন না কেনো?
আসলে তুমি নতুন তো তাই ও তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি ভেবো না দিনদিন পরিচিত হয়ে যাবে তখন দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
না আম্মা সমস্যা হয়নি। আম্মা আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো? আর আপনি লাইট থাকতে এমন অন্ধকারের মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্না করছেন কেনো?
ছেলেটা আলো খুব একটা পছন্দ করে না।
উনি এখন কোথায়?
আমার ঘরে। তুমি নিজের রুমে যাও আমি রান্না শেষ করে যাচ্ছি।
আরশী কথা বলে নিজের রুমে দিকে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসলো। আরশী সেদিন এগিয়ে গিয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো ওর শশুর মশাই ঐতিহ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছেলটা ঘুমের মধ্যেই শব্দ করছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ও আর সময় নষ্ট করলো না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। গতকাল রাতের বিষয়গুলো মাথার মধ্যে কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। আরশী নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসতে আসতে খেয়াল করলো বেলকনির দরজা খোঁলা। খোলা দরজা দিয়ে বাতাস এসে পর্দা উড়ছে আর সেখানে একজন ছেলের ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আরশীর শরীর বেঁয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলে। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কে?

চলবে…