পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৪)

Photo of author

By Sabiha Khan

মিতালি চারদিন পর এসেছে মিরপুর থেকে। এসেই প্রতিদিনই কারো না কারো বাসায় যাচ্ছিলো। আজ কোথাও যাবে না মিতালি। আসার পর থেকে মার সাথে বসে কথা বলাই হচ্ছিলো না। আলো খুব মজা করে কাঁচা আমের ভর্তা করে দিয়েছে মিতালিকে। মিতালি আম ভর্তা খেতে খেতে বললো, মা ফ্ল‍্যাটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছো তুমি। বাবা তো ভিষণ অগোছালো। নদী রান্নাঘরে রান্না বসিয়ে দিয়েছে। মাংসটা ভুনতে ভুনতে বললো, আর সাজানো এই বয়সে। হ‍্যাঁরে মিতু, খোকা ছবি তোর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে আমেরিকা থেকে? মিতালি বললো, মা তুমি আজকাল খুব ভুলো মনের হয়ে গেছো। তোমাকে বলেছিলাম না, ভাইয়ারা আসবে কানাডা? নদীর মাংস ভুনানো শেষ তাই মাংসে পানি দিয়ে এককাপ চা নিয়ে রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া প্রাইভেট সিটিংরুমে বসে বললো, হ‍্যাঁ বলেছিলি তো। কিন্তু কবে আসলো খোকা, কিচ্ছুতো জানাসনি। মিতালি হাতটা ধূয়ে মার কাছে বসে বললো, ইচ্ছে করেই বলিনি। তোমার আদরের বউমা কানাডা আমার বাসায় এসেই নাক সিঁটকে বলেকি, ওমা এতো ছোট বাসায় তোমরা থাকো কি করে? আমিও সাথে সাথে বলে দিয়েছি, বাসাটা আসলেই খুব ছোট কিন্তু আমাদের জন‍্য ঠিক আছে, তোমার সমস্যা হলে হোটেলে গিয়ে থাকতে পারো। ভাইয়া তখন বেশ রেগে গিয়েছিলো ভাবীর উপর। অথচ জানো মা, আমাদের বেডরুমটাই ভাইয়াদের ছেড়ে দিয়ে আমরা পাশের ছোট রুমটাতেই ছিলাম। ভাইয়া এসেই আমার কাছে ছবিটা দিয়ে বললো, মাকে দিস এবং এও বলেছিলো, তোর ভাবীকে আবার দেখাসনে কিন্তু। তারপর একটু বলেছিলো, মা বানিয়েছিলো দেশে যখন গেলাম কিন্তু দিপ্তীকে তো তুই জানিস। আর মাও আছে… আমরা পড়েছি ছোটবেলায় সেটা আলাদা কিন্তু এখন আমাদের বাচ্চাদেরও সুয়েটার বানিয়ে দিতে হবে কেন? তখন বাবাকে ফোন করে বাকীটা জেনে নিয়েছিলাম। তুমি তো কিছুই বলবে না। সেটা আমি জানতাম। ফ্রেমে বাঁধিয়েই নিয়ে এসেছিলো ছবিটা। ছবিতে দেখোনি, পার্কে গিয়ে ছবিটা তুলেছে চুপিচুপি। তোমার ছেলে একদম বউয়ের গোলাম। কানাডা এসে ভাবিকে নিয়ে শুধু ঘুড়াঘুড়ি করেছে। একদন্ড সময়ও আমাকে বা ইমনকে দেয়নি। পাঁচদিন ছিলো। একদিন শুধু রাতে খাবারের সময় বলেছিলো, তোমরা নাকি এই বয়স ফ্ল‍্যাট কিনে ভূল করেছো। আরো বললো, ভাড়া বাসাতেই থাকতো মা বাবা। কি প্রয়োজন ছিলো ফ্ল‍্যাট কেনার? আমি আমেরিকাতে বাড়ি কিনছি। বরং টাকাটা পেলে কিছুটা এগিয়ে যেতাম। আমি বলেছি, বাবা মার প্রয়োজন না একটা ফ্ল‍্যাটের? আজীবন তো ভাড়া বাসাতেই কাটালো। যখনই একটা জায়গা ঠিক করলো অমনি তুই বায়না ধরলি আমেরিকা যাবি। জায়গাটা তো তোর কারণেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। তাই এখন ছোট্ট একটা ফ্ল‍্যাট কিনেছে। তাছাড়া তোর কাছে তো কোন টাকাও চাইনি রে ভাইয়া। উল্টো আমাকে বলেকি, তাই বলে ছেলেমেয়েদের সাথে পরমর্শ করবে না? একটাবার বলেওনি ফ্ল‍্যাটের ব‍্যপারে, মা বাবা আমাকে জানিস? পূরোই স্বার্থপর একটা ছেলে ভাইয়া। আমিও বলে দিয়েছি, ভাইয়া, মা বাবা অনেক করেছেন আমাদের জন‍্য। এখন শেষ বয়সে তাদের আর যন্ত্রণা দিসনা। ফ্ল‍্যাটের কথাটা ভাইয়া ভাবীর সামনেই তুলেছিলো। ভাবীর মুখটা দেখার মতো ছিলো। কারণ বসে বসে তোমার গাধা ছেলের সাথে তাল মিলাচ্ছিলো যে। ওহ্ আমার জন‍্য এই সেটটা এনেছিলো। দাঁড়াও দেখাচ্ছি। নদী চা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে মাংসটা দেখে আসলো। আর একটু পানিটা কমবে। অফিস থেকে কদিনের ছুটি পাওনা ছিলো নদীর। তাই মেয়ের জন‍্য রেখে দিয়েছিলো নদী। মিতালি এসে বললো, দেখো তোমার সোনার ছেলে কি দিয়েছে বোনকে। নদী দেখলো, একটা লকেট লাগানো পাতলা চেইন। মিতালি বললো, ইমনকে একটা ঘড়ি দিয়েছে, কিপটা কোথাকার। নদী বললো, থাক। তুই তো এমনিতেও গহনা পছন্দ করিস না। মিতালি বললো, মা, তুমি আসলে আমার চাইতেও ভাইয়াকেই বেশি ভালোবাসো। ছেলের কোন দোষই তোমার চোখে ধরা পড়ে না। যাও, ঘেমে একাকার হয়ে গেছো। গোসল করে আসো। নদী বললো, এইতো যাচ্ছি। মাংসের হাঁড়ির ঢাকনাটা খুলে দেখলো তারপর বন্ধ করে দিলো গ‍্যাস। মিতালিকে বললো, ইমন আসবে না আজ? মিতালি বললো, নাহ্ মনে হয়। আমি তবুও ফোন করছি, এই বলে মিতালি মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। নদী একা একা বললো, আহা, আমাদের সময় এসব মোবাইল ছিলো না। কতোদিন মার কথা মনে পড়েছে কিন্তু ফোনও করতে পারতাম না। মা বেঁচে থাকতে মায়ের বাসায় একটা ফোনও ছিলো না। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে কাজের মেয়েকে টেবিলে ভাত দিতে বলে তাড়াতাড়ি গোসল করতে গেলো নদী। ইমন যদি রাতে আসে? মনটা খচখচ করছে, একটু মাছের কোপ্তা আছে ডিপে, রান্নাটা করতে হবে বিকেলে। গোসল করে নামাজ পড়ে নদী এসে দেখলো, ঝাকড়া চুলের বারবী ডলটা ঘুম থেকে উঠে গেছে। নদী কট থেকে কোলে নিয়ে নাতনিকে আদর করে মিতালিকে ডাকলো। মিতালি এসে বললো, ইমন আজ আসবে না। বন্ধুদের সাথে রাতে ওর পার্টি আছে। ওমা, তুমি উঠে গেছো গুলগুলি? মেয়েকে বললো, নান্নীর কোলে থাকো, আমি তোমার খাবার আনছি। একটু পর বোতলে তৈরী করা খাবার নিয়ে আসলো। নদী বললো, সেকি রে এসব তোরা কি খাওয়াস বলতো? সব সবজি দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া একটু করে। মিতালি চামুচ দিয়ে খাবার মেয়ের মুখে তুলে দিতে দিতে বললো, মা এতো কষ্ট করতে পারবো না এখন। আপাতত যে কয়টা এনেছি শেষ হোক তারপর তো নিজের হাতেই বানাবো। তাছাড়া তেমন একটা খেতেও চায় না এসব। মেয়েকে খাবার খাইয়ে আলোর কাছে দিয়ে নদীকে মেয়ে বললো, মা, আমি আমার মেয়েকে খাবার খাইয়েছি এবার তুমি তোমার মেয়েকে খাবার খাইয়ে দাও। নদী হাসতে হাসতে বললো, তুই কবি বড় হবি রে মিতুসোনা। খাবার প্লেটে নিয়ে আগের মতো সব মিশিয়ে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে নদী আর মিতালি বান্ধবীদের সাথে টেলিফোনে কথা বলছে আর খাচ্ছে। কি চমৎকার সেই দৃশ্য। নদীর চোখে পানি আসছে, কারণ বারবার খোকার মুখটা ভেসে উঠছে। খোকাকেও তো এভাবেই খাইয়ে দিয়েছে নদী।

চলবে…

সাবিহা খান, লন্ডন