পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৩)

Photo of author

By Sabiha Khan

শেষ পযর্ন্ত নদী এবং মোস্তাক মেনে নিয়েছিলো খোকার বিয়েটা। ঠিকই তো বলেছে খোকা। আবেগ দিয়ে তো জীবন চলে না। শুধু বিয়েটা দেশে নিতে অনুরোধ করেছিলো দিপ্তীর বাবা মাকে। উনারা কথা দিয়েছিলেন তাই হবে। কিন্তু কবে আসবে, কিভাবে কি হবে কিছুই বলেননি। হঠাৎ করেই খোকা ফোন করে বলেছিলো, মা, বাবাকে বলো আমরা আসছি সামনের মাসে। বিয়েটা শুধু তোমাদের জন‍্যই দেশে নিতে হচ্ছে। খোকার কন্ঠে ছিলো একরাশ বিরক্ত। নদী চমকে গিয়ে বলেছিলো, কি বলছিস খোকা? এমাসের আছে মাএ একুশদিন? এতো অল্প সময়ে কিভাবে কি হবে? খোকা বলেছিলো, কাউকেই দাওয়াত করতে হবে না। কারণ আমরা আমেরিকাতেই বিয়ের জন‍্য পার্টি দিবো। দিপ্তীর আপনজনেরা তো এখানেই থাকে। তাই কিছুই করতে হবে না। শুধু বিয়েটা তোমাদের সামনে হবে। আর আমি কিন্তু টাকা পয়সা কিছুই দিতে পারবো না। এমনিতেই ওদের যাওয়া আসার টিকেট কাটতে হচ্ছে আমাকেই। আমরা মাএ চারজন আসবো। দিপ্তীর বাবা মা, দিপ্তী আর আমি। তারপরও নদী আর মোস্তাক দুজনেই, শুধুই নিকট আত্মীয় এবং দু চারজন বন্ধুদের নিয়েই ছোট্ট একটা সেন্টারে বিয়ের ব‍্যবস্থা করেছিলো। মিতালি আর নীলু আপা লেগে গিয়েছিলো বিয়ের মার্কেট করতে। নদী তার নিজের গহনা থেকেই একসেট গহনা রেখেছিলো দিপ্তীর জন‍্য। কিন্তু খোকা গহনা দেখে পছন্দ করেনি বরং বলেছে, এগুলো তো তোমার আমলের গহনা। ছি ছি মা, তুমি আজো মর্ডান হতে পারলে না। তখন বাধ‍্য হয়েই মিতালির বিয়ের জন‍্য রাখা টাকা থেকেই নতুন একসেট গহনা খোকাকে নিয়েই কিনেছিলো নদী, দিপ্তীর জন‍্য। মাএ পনের দিনের জন‍্য এসেছিলেো দিপ্তীরা। নতুন বউকে বুঝার আগেই চলে গিয়েছিলো সবাই। মিতালি গাল ফুলিয়ে বলেছিলো, এটা কোন বিয়ে হলো? না হলো আনন্দ, না হলো ভাবীকে জানা। কি বিয়ে করলো ভাইয়া? ভাইয়ার সাথে একদমই মানাইনি ভাবীকে। তাছাড়া ভাবী যেন কেমন। নদী বলেছিলো, বউমা ছোটবেলা থেকেই আমেরিকাতেই বড় হয়েছে। একটু তো তফাৎ থাকবেই ব‍্যবহারে। মিতালি বলেছিলো, মেট্রিক পাশ করে গিয়েছে দেশ থেকে, এতো ছোটবেলাতেও যাইনি। তোমার কাছে পরের মেয়ে আজীবন ছোটই থাকবে কেবল আমিই বুড়ি হয়ে গেছি। গাল ফুলিয়েছিলো মিতালি। নদী হেসে মেয়েকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলো, তুই আমাদের মিতুসোনা যে। দেড়বছর পর মিতালিরও বিয়ে হয়ে গেলো। আগে থেকেই ছেলেপক্ষের সাথে কথা পাকাপাকি করেই রেখেছিলো। মেয়ের বিয়েতে নদী মন ভরে মজা করতে পেরেছে। আত্মীয়স্বজন, কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে মিতালির বিয়েতে আনন্দ করেছিলো নদী। বিয়ের সময় নিজের গহনাগুলো দিতে সংকোচবোধ করেছিলো নদী। মিতালিকে বলেছিলো, এগুলো বদলে নতুন কিছু কিনে আনি চল মিতু। কিন্তু মিতালিই বলেছিলো, কখনোই না। ভালোই হয়েছে। তোমার স্মৃতিমাখা গহনাগুলো, আজ থেকে আমার কাছেই থাকবে। এমন সুন্দর ডিজাইন আজকাল দেখাই যায় না। নদীর চোখটা আনন্দশ্রুতে ভরে গিয়েছিলো। বিয়ের পর মিতালি কিছুদিন তাদের কাছেই ছিলো। খোকা বিয়েতে আসেনি। বারবার বলা সত্ত্বেও খোকা কোন না সমস্যা দেখিয়েছে। তখন তো তারা দাদা দিদাও হয়ে গিয়েছিলো। তাই নাতিনকে এক নজর সামনাসামনি দেখার জন‍্যও তারা অস্থির ছিলো। কিন্তু খোকা আসতে রাজীই হয়নি। বউমাকে আসতে বলাতে, দিপ্তী কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলেছিলো, এখন তারা আসতে পারবেনা, বেবী ছোট, বরং মিতালির জন‍্য তারা কিছু টাকা দিতে চায়। মোস্তাক নেয়নি খোকার টাকা। বরং হাসিমুখেই বলেছিলো, টাকা লাগবে না খোকা। তোর মা আর আমি ব‍্যবস্থা করেছি। খোকা বলেছিলো, বেশতো, বিয়ের টাকা নাইবা নিলে, মিতালির কিছু গহনার জন‍্য…. খোকাকে থামিয়ে দিয়ে মোস্তাক বলেছিলো, এখনো তো বেঁচে আছি রে খোকা। লাগলে অবশ্যই চাইবো। ভবিষ্যতে মিতালির সাথে দেখা হলে বরং কিছু কিনে দিস। পাশাপাশি দেশেই তো থাকবি। খোকা বেশ আনন্দের সাথে বলেছিলো, হ‍্যাঁ, তোমাদের বউমাও বেশ খুশী কারণ কানাডা এখনো আমাদের যাওয়া হয়ে উঠেনি। মিতালি কানাডা চলে যাবার দুইবছর পর তারা তাদের এই ছোট্ট ফ্ল‍্যাটটি কিনেছিলেন। জায়গাটা অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো টাকার অভাবে। ফ্ল‍্যাট কেনার সময়ও মোস্তাক তার গ্রামের সব জমিগুলোও বিক্রি করে দিয়েছিলো এবং ব‍্যবসা থেকে আসা সব টাকাও ফ্ল‍্যাটের পিছনেই লাগিয়েছিলো। শুধু গ্রামের বাড়িটাই পড়ে আছে এখনো। ফ্ল‍্যাট কেনার পর মোস্তাক হেসে বলেছিলো, কি গো, তোমার বাড়ির শখ পূরণ হলো তো? আমার দায়িত্ব কিন্তু শেষ, এখন আবার হঠাৎ ছেলেমেয়েদের কথায় বিদেশে বসবাস করতে বায়না ধরবে নাতো? নদী বলেছিলো, কখনোই না। দেখো, পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে কি চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। নদীদের পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে দৃষ্টিটা বহুদূর যায় কারণ পেছনের পরপর পাঁচটি বাড়ি এখনো বহুতল হয়নি। বাড়িগুলো বেশ গাছ গাছালি দিয়ে ভরা। মনটা খুব ভালো হয়ে যায়, নদী যখন পেছনের বারান্দাটায় যায়। খুব ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনেই নদীর ঘুম ভাঙ্গে। ফজরের নামাজ পড়ে, নদী আর মোস্তাক এখানে বসেই চা খায়। নদী খুব সাদামাটা করে ঘর সাজিয়েছে কিন্তু কলিগরা বাসায় এসেই হৈচৈ করে বলেছিলো, আপা, এওো সুন্দর করে আপনি বাড়িটাকে সাজিয়েছেন যে, এখানে আসলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। নদী হেসে বলেছে, আমি মানুষটাই সাদামাটা তাই আমার মতো সাদামাটা করেই সাজালাম। কিন্তু যেই এসেছে সেই প্রশংসা করেছে নদীর রুচির। খোকা এসেও বলেছিলো, দেখো, আমার মায়ের রুচি দেখো। মা বাসার প্রতিটা কোণা তুমি একদম বাঙালি ভাবেই রাখার চেষ্টা করেছো। কিন্তু মা, আমি ভাবছিলাম, তোমাদের আমেরিকায় নিয়ে যাবো। মোস্তাক বললো, এই বয়সে আর টানিস না আমাদের। দেশেই বরং সবার সাথে আমাদের ভালো দিন কাটছে। তাছাড়া এখনো তো চাকুরিটা আছে। নদীও বললো, আমারও বেশ লাগে অফিসের সবার সাথে। তাছাড়া তোর মামা, খালা, চাচারা সবার সাথেই দেখা হচ্ছে যখন তখন। ভেবেছিলাম তোরা বাইরে থাকলে খুব সমস্যা হবে আমাদের কিন্তু কোন সমস‍্যাই হচ্ছে না। বউমা ইংরেজিতে বাড়ির দাম জিজ্ঞেস করেছিলো। দাম শুনার পর বললো, এওো দাম? বাব্বা। এ বাড়ি বিক্রি করে বরং আমেরিকাতে আর কিছু টাকা লাগালেই আমাদের বাড়িটা কিনতে পারি। মোস্তাক বলেছিলো, আমরা মারা যাবার পর খোকা আর মিতুই তো এই বাড়ির মালিক হবে। তখন না হয়, তোমরা যা ভালো বুঝো, তাই করো। দিপ্তীর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিলো। মুখটা কালো করেই বলেছিলো, আপনারা আমেরিকা কিংবা কানাডা গেলে দেশে আসার আর প্রয়োজন পড়তো না আমাদের। তাছাড়া ঐসব দেশে বৃদ্ধদের জন‍্য কতোকিছুর সুবিধা আছে। বৃদ্ধদের জন‍্য আধুনিক বৃদ্ধাশ্রমও আছে। আপনাদের ভালোর জন‍্যই বলছিলাম কথাটা। দিপ্তীর কথার সাথে খোকাও সায় মিলাচ্ছিলো আর বৃদ্ধদের কি কি সুবিধা দেয় তাও বলছিলো খুব উৎসাহের সাথে। কিন্তু নদী আর কথা বাড়াতে দেয়নি দিপ্তী এবং খোকাকে। খোকাকে আড়ালে ডেকে কঠিন গলায় বলেছিলো, আমরা এখানেই থাকবো যতোদিন বেঁচে আছি। তাছাড়া উন্নত দেশের বৃদ্ধাশ্রমে যাবার কোন শখও আমাদের নেই। তাই দিপ্তীকে বলিস, আর যেন এই বিষয়ে কোন কথা না বলে কারণ তুই তোর বাবাকে তো চিনিস। এককথার মানুষ সে। এখনো তোদের জন‍্য হ্নদয়ে যে ভালোবাসার স্থানটা আছে তাতে আর আঘাত করিস না। খোকা বলেছিলো, বৃদ্ধাশ্রমে তোমাদের দিবো কেন? এটা ওখানকার সুযোগ সুবিধার কথা দিপ্তী তোমাদের বলছিলো। তাছাড়া বিদেশে যারা কাজ করে অনেসময় নিজেদের সুবিধার জন‍্যই…। এরপর খোকাও আর কথা বাড়াইনি এ ব‍্যাপারে। তবে বুঝা গেলো সেও খুব একটা খুশী নয় তাদের সিদ্ধান্তে। মিতালিও বাসাটা দেখে বাচ্চাদের মতো খুশী হয়েছে। কারণ মিতালি মায়ের বাড়ির বানানোর শখটা প্রায় ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে। যদিও বাড়ি হয়নি, তাতে কি। একটা ফ্লাট তো কিনেছে বাবা মা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নদী উঠে দাঁড়ালো পেছনের বারান্দার চেয়ার থেকে। গাছ লাগিয়েছে নদী। তার শখের বারান্দা বাগান। কাজের মেয়েকে বললো, আলো পানি আনতো, গাছে পানি দেই। বেশ গাছ লাগিয়েছে নদী। এই নিয়েই নদীর সময় কেটে যায় এখন অফিস থেকে আসার পর। ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। তাই অফিস থেকে ফেরার পর রান্না শেষেও যেন সময় আর কাটতে চায় না। ফলের গাছ, সবজি, ফুলের গাছ সব আছে। বেশ বড়ই পেছনের বারান্দাটা। সামনের বারান্দায় শুধু ফুলের গাছ লাগিয়েছে নদী। হঠাৎ মনে পড়লো, সর্বনাশ ছয়টা বেজে গেছে অথচ মোস্তাককে চা দেয়া হয়নি। মোস্তাক খুব সময় মেনে চলা লোক। একদিনের জন‍্যও অফিসে তার দেরী হয়নি। খাবারও প্রতিদিন একই সময়ে খাবে। সকালে হাঁটতেও যাবে ঘড়ি ধরেই। রাতে ঘুমাবেও একই সময়ে। নদী তাড়াতাড়ি কিচেনে এসে চায়ের পানি তুলে দিলো গ‍্যাসের চূলোয়।

চলবে…

সাবিহা খান, লন্ডন