পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-২)

Photo of author

By Sabiha Khan

নদী তাড়াতাড়ি বললো, কি করেছে তোর ভাবী? বউমা তো অত্যন্ত লক্ষী মেয়ে। মিতালি মুখ বাঁকিয়ে বললো, কতো লক্ষী বউমা তোমার, তা আমি জানি মা। তুমি সবসময়ই আমার কাছে অনেক কিছু লুকাও। ভাইয়াই আমাকে একটু বলেছে আর বাকীটা আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি। ওহ্ ভূলেই গেছি একটু অপেক্ষা করো। মিতালি পাঁচমিনিট পরেই একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নদীকে দিয়ে বললো, এই দেখো তোমার দাদা ভাইয়াকে। নদী ছবিটা দেখতে দেখতে ছবির গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, খোকা এই সুয়েটার নিয়ে গিয়েছিলো? মিতালি বললো, মা আমি যাচ্ছি। ফিরে এসে সব বলবো। মিতালি চলে গেলো তার শশুরবাড়ি। মেয়ে যাবার পর নদী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। ছবিটা বুকে চেপে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। মোস্তাক নদীর মাথায় হাত রেখে বললেন, আর কত কাঁদবে তুমি? খোকারা যাবার পর থেকেই তো মাঝে মাঝে কাঁদছো আর সুয়েটারটা খুঁজছো। আমিই খোকাকে সুয়েটারটা তোমাকে না জানিয়ে দিয়েছিলাম। নদী কাঁদতে কাঁদতে বললো, এতোদিন ধরে খুঁজছি, বলোনি কেন? মোস্তাক নদীকে বললো, দাও, আমার দাদুর ছবিটা দাও, বেডরুমের দেওয়ালে লাগিয়ে দেই। সাদা রংঙের সুয়েটারের গলায় নীল রঙটা বড্ড ফুটেছে। কি সুন্দরই না লাগছে দাদু ভাইয়াকে। ছেলেটা দেখতে একদম খোকার মতোই হয়েছে। মনে হচ্ছে ছোটবেলার খোকা। খোকারা বছর খানেক আগে দেশে এসেছিলো। মাসখানেক ছিলো। তখনই নদী এই সুয়েটার বানিয়ে খুব উৎসাহের সাথে দিপ্তীর হাতে দিয়ে বলেছিলো, বউমা দাদুভাইয়া পড়িয়ে দেখো তো মাপটা ঠিক আছে কিনা। খোকাও ঐ ঘরেই ছিলো। সুয়েটারটা হাতে নিয়ে নদীর স্মার্ট বউমা বললো, ছি, এটা কেন বানিয়েছেন আপনি? কতোগুলো সুয়েটার আছে আমার ছেলের, তা জানেন? যেমন নরম তেমনি সুন্দর। এটা কোন সুয়েটার হলো? খোকা বলে উঠেছিলো, আহ্, কি বলছো দিপ্তী? মার হাতের সুয়েটার পড়েই আমরা বড় হয়েছি। এমনকি আমেরিকা যাবার সময়ও মার বানানো সুয়েটারগুলোই নিয়ে গেছি। তুমি তো সবই জানো। দিপ্তী বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললো, দেখো, ওসব পুরানো দিনের কথা বাদ দাও। আমার ছেলের কথা আলাদা। আমি এই সুয়েটার পড়িয়ে আমার ছেলেকে বাইরে বের করতে পারবো না। মা, আপনি বরং এটা, দেশেই কাউকে দিয়ে দিয়েন। এই বলে দিপ্তী সুয়েটারটা ঢিল দিয়ে বিছানায় ফেলে বারান্দায় চলে গিয়েছিলো। খোকা তাড়াতাড়ি বললো, মা আমি পড়াবো কিন্তু নদী সুয়েটারটা হাতে নিয়ে বললো, বউমা ঠিকই বলেছে। থাক। এটা বরং আমি অন‍্য কাউকে দিয়ে দিবো। সুয়েটারটা হাতে নিয়ে নদী সোজা নিজের ঘরে এসে কাঁদছিলো। মোস্তাক সবই শুনেছিলো। কারণ তাদের বাসাটা এতো বড় নয় যে কথা শুনা যায় না। মোস্তাক নদীর হাত থেকে সুয়েটার নিয়ে বললো, তোমার পাগলামী কবে যাবে নদী? এখন বাচ্চারা বড় হয়েছে। তাদের সংসার তাদের মতো করে করতে দাও। নদী শুধুই কাঁদছিলো। কি করিনি নদী আর মোস্তাক এই দুই ছেলেমেয়ের জন‍্য। দুজনেই চাকুরি করেছে। নদী প্রতিটা পয়সা জমিয়ে রেখেছিলো একটি জায়গা কিনবে এবং সেখানেই বানাবে তার সপ্নের বাড়ি। নিজে কোনদিনও একটা দামী শাড়ি কিনেনি। কলিগরা সবসময়ই বলতেন, তাঁত আর জর্জেট ছাড়া অন‍্য কোন শাড়িই কি আপনার পছন্দ না আপা? নদী হেসে বলতো, যে পছন্দ করার সেতো তাঁতের শাড়িতেই পছন্দ করেছিলো। মোস্তাক খারাপ চাকুরি করতো না। মাঝে মাঝে কাতান বা জামদানি শাড়ি নিজে থেকেই কিনে আনলেই নদী মৃদু হেসে বলতো, কেন টাকাটা খরচ করলে খামোখা। অবসরে যাওয়ার আগে একটা জায়গা অন্তত কিনতে হবে তো। মোস্তাক হেসে বলতো, হবে হবে। অতোকিছু ভেবো না তো। ছোট একটা ব‍্যবসাও তো করছি বন্ধুর সাথে। তুমি তো সবই জানো। ওখান থেকেই হয়ে যাবে। খোকা ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা শেষ করেই বায়না ধরেছিলো, আমেরিকাতে যাবে উচ্চতর ডিগ্রির জন‍্য। নদী বেশ আপওি করেছিলো এবং এটাও বলেছিলো খোকার রেজাল্ট ভালো। তাই আপাতত দেশেই ভালো চাকুরি পেয়ে যাবে। কিছুদিন পরে না হয় আমেরিকা যাবে। কারণ কিছু টাকা জমেয়েছি, মিতালির বিয়ে,ও তিনকাঠার একটা জায়গাও পছন্দ করেছি। নীলু আপাও কিনছে ওখানে। মনে নেই তোমার? কিন্তু নদীর আপওি ঠিকেনি কারণ মোস্তাকই উৎসাহ দিয়েছে খোকাকে যাবার জন‍্য এবং নদীকে এটাও বলেছে, দেখো দেখো একদিন আমার ছেলে আমেরিকা থেকে ডলার পাঠাবে এবং সেই ডলার দিয়েই তুমি তোমার সখের বাড়িটি বানিও, বলেই হা হা করে হেসেছিলো মোস্তাক। নদী তার চাকুরীর জমানো টাকা থেকে ডলার দিয়েছে খোকাকে, পূরো একটা বছর। তারপর অবশ‍্য খোকারও একটা চাকরি হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু একটি টাকাও খোকা কোনদিন পাঠাইনি। নদী খোকাকে একদিন কতো বেতন পাচ্ছে এটা জিজ্ঞেস করাতে খোকা একটু অন‍্যরকম গলায় বলেছিলো, মা এটা বিদেশ। এখানে আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ কি আছে? তোমার কিংবা বাবার সব আত্মীয়স্বজন তো বসে আছে টাকার বস্তা নিয়ে আমার জন‍্য। নদীও ছেলের উপর অভিমান করে মোস্তাককে বলেছিলো, ছেলে কতো বেতন পাচ্ছে তা জানার অধিকারটুকুও কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? কিন্তু মোস্তাক এ ব‍্যপারে ছেলেকে কোনদিন কিছুই বলেনি। বরং নদীকে বলেছে, ঠিকই তো বলেছে খোকা, বিদেশের বাড়িতে হঠাৎ টাকার প্রয়োজন পড়লে কে দিবে টাকা খোকাকে? খোকা আমেরিকাতে যাবার বছর দেড়েক পর দিপ্তীর কথা বলেছিলো মাকে ফোনে। অথচ নীলু আপার মেয়েটাকে নদীর খুব পছন্দ ছিলো। খোকাকে তা বলার পর পরই খোকা নদীকে বলেছিলো, মা আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবো ভাবছি তাই এখানে বসবাসরত মেয়েকে বিয়ে করলে আমার জন‍্যই তা ভালো। মেয়ে যদিও অতো সুন্দর নয় কিন্তু জীবন তো কোন আবেগ দিয়ে চলে না। একটু তো বুঝার চেষ্টা করো মা। নদী বললো, মিতালির জন‍্য কানাডাতে থাকে ছেলে, পরিবারও শিক্ষিত, ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে রে। তাই ভাবছিলাম আগে মিতালির বিয়েটা দিয়ে তারপর তোর বিয়েটা হলে ভালো হতো। খোকা কিছুটা বিরক্তি ভরা কন্ঠে নদীকে বললো, মা আমার পড়াশুনা শেষ। একটা চাকুরী পেয়েছি কিন্তু চাকুরী চলে গেলেই আমাকে এদেশে থাকতে দিবে না। তাই ওসব বলো না তো। তাছাড়া মিতালির বিয়েটা এক্ষুনি দেবার প্রয়োজনটা কি? ও তো এখনো ভারসিটিই পেরুইনি। নদী বললো, তোর বাবার বন্ধুর বড় ভাই এর ছেলে। পরিচিত। ঠিক আছে, কিন্তু তোরা দুজনেই বাইরে থাকলে আমরা বুড়োবুড়ি কিভাবে দেশে একা একা থাকবো রে খোকা?

খোকা আর কিছু না বলে ঠাস করে ফোনটা নামিয়ে রেখে দিয়েছিলো। নদী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। সেই খোকা, যে বাইরে থেকে এসেই বায়না ধরতো, মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ভাত দিলে আবারও বায়না ধরতো তুমি মেখে খাইয়ে দাও মা। সারাদিন অফিস, অফিস থেকে বাসায় এসে রান্না, বাচ্চাদের পড়াশুনা সব, সব সামলাতো নদী। রাত একটা দেড়টার আগে কোনদিনও ঘুমাতে পারিনি সে। মাঝে মাঝে মনে হতো চাকরিটা ছেড়ে দিবে কিন্তু মোস্তাকের আয়ে কিভাবে সব হবে তা ভেবে ভেবে আর চাকুরী ছাড়াই হয়নি। জীবনটা এভাবেই কেটে গেছে নদীর অথচ এখন কিনা…

চলবে…

সাবিহা খান, লন্ডন