পড়ন্ত বিকেল (শেষ পর্ব-৬)

Photo of author

By Sabiha Khan

চমকে পিছনে ফিরে তাকালো নদী। তখন পড়ন্ত বিকেল। নদী দেখলো, ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে। ছেলেটির গায়ে ঠিক এই রঙের একটি শার্ট ছিলো। জিন্সের প‍্যান্ট। ছেলেটি কোন ভূমিকা না করেই সরাসরি বললো, নদী আমি তোমাকে ভালোবাসি। নদী যেন কিছুই বুঝতে পারছেনা। নদী বলে উঠেছিলো কি বলছেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি। নদীর হাতটা ধরে বলেছিলো, আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে নদী। বিশ্বাস করো, কিভাবে কি হলো, কখন থেকে হলো আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিনা এবং তোমাকেও বুঝাতে পারবোনা। নদীর মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। এই প্রথম কোন ছেলের কাছ থেকে ভালোবাসি শব্দটা সে শুনছে। মাএ কিছু সময়ের জন‍্য সে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলো। পর মুহূর্তেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাসায় এসে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ বসেছিলো সে। পরদিন বিকেলে ছেলেটি তার জানালা দিয়ে একটি সাদা খাম নদীর পড়ার টেবিলে ফেলে গিয়েছিলো সবার অগোচরে। নদী অন‍্যঘর থেকে এসে টেবিলে বসতেই খামটি চোখে পড়েছিলো। খামটির উপরে শুধু লেখা ছিলো নদী। নদী খামটি খুলতেই কিছু লাল গোলাপের পাপড়ি আর নীল রঙের একটি চিঠি পেয়েছিলো। চিঠিতে লেখা ছিলো, ভালোবাসি ভালোবাসি। পূরো পাতাটা জুড়েই। শেষে লেখা ছিলো, প্লিজ উওর দিও। সেদিন নদী সারারাত জেগেছিলো আর মাঝে মাঝেই টিঠিটা পড়ছিলো। কিন্তু কি লিখবে সে? পরদিনও ছেলেটি দুপুরে সরাসরি তাদের আঙ্গিনাতে এসেছিলো। মাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে বলেছিলো, আমি কি একটু আচার খেতে পারি? উঠোনে এতো আচার দেখে খুব লোভ হলো। মা বলেছিলো, তুমি দেলোয়ার ভাবীর ছেলে না? মাথা ঝাঁকিয়েছিলো। মা বলছিলো, এসো বাবা, ঘরে বসে খাও। ছেলেটি বলেছিলো, একটা বাটিতে দেন, বাসায় নিয়ে যাবো। মা বলেছিলো, ঠিক আছে। আমি বাটি আনছি। নদী সবই শুনছিলো এবং জানালা দিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ ছেলেটি একটি চিঠি জানালা দিয়ে নদীর টেবিলে রেখে বললো, আজই জবাব টা দিবে কিন্তু। আমি তোমার জবাবের অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় হাঁটতে আসবে তো? নইলে এখুনি কিছু বলো প্লিজ। নদী তাড়াতাড়ি বলেছিলো, প্লিজ যান এখান থেকে। মা দেখবে। তাছাড়া আপনাদের বারান্দায় আপনার বাবাকে দেখছি। যান। ছেলেটি বেশ সাহসের সাথে বলেছিলো, বেশতো দেখুক বাবা। ভালোবাসি তোমাকে এবং তোমাকেই বিয়ে করবো। নদী বলেছিলো, আমি জবাব দিবো কিন্তু এখন দয়া করে যান এখান থেকে। মা বাটি ভর্তি করে আচার দিয়েছিলো। কিন্ত পরদিন সকালেই ছেলেটির বাবা নদীদের বাসায় এসে নদীর বাবাকে যা ইচ্ছে তাই শুনিয়েছিলেন। মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমার ছেলের পিছনে। চিঠি চালাচালি করাচ্ছেন, আচার খাওয়ানোর নাম করে বাসায় পযর্ন্ত নিয়ে এসেছেন। এমন আরো অনেক নিন্মমানের কথা বলছিলেন ভদ্রলোক, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। নদী বাবা কিছুই বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাঁকিয়েছিলেন। নদী পাশের ঘর থেকে এসে তখন বলে উঠেছিলো, আপনার ছেলেই আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমি কিছুই করিনি। তাকেই জিজ্ঞেস করুন। ছেলের বাবা বললো, সে একটু আগেই ঢাকা চলে গিয়েছে। এতোটুকু মেয়ে, এতো সাহস তোমার? আমার ছেলে কদিন পরেই বিদেশে যাবে। কি ভেবেছিলে? একবার পটাতে পারলেই হলো। ব‍্যাস। একেবারে রাজরানী। নদীর মা হাতজোড় করে বলেছিলো, আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে এমন কাজ করতেই পারে না। তাছাড়া কাল আপনার ছেলেই এসে আচার চেয়েছিলো। নদীতো তার ঘরে ছিলো। থামুন থামুন। আপনাদের মতো লোকদের আমার জানা আছে। চোরের মার বড় গলা। মা কেঁদে দিয়ে বলেছিলো, দয়া করে আপনি যান ভাই। আশেপাশের বাসার লোকেরা শুনবে। চলে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক, তবে এটাও বলেছিলেন, তারা কোনদিনও নদীকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করবে না, নদী দেখতে যতোই সুন্দর হোক না কেন। মা কেঁদে বলেছিলো, তোর মতো মেয়েকে পেটে ধরেছিলাম আমি? ছি। আজ থেকে কোথাও যেতে পারবিনা আমাদের অনুমতি ছাড়া। সাতদিনের ভিতরে দেয়াল উঠেছিলো পূরো সরকারি জায়গাটায়। আশেপাশের লোকেরা চেঁচামেচি করলেও কাজ হয়নি। বলা হয়েছিলো, সরকারি রাস্তা কেবল সরকারি লোকজনেরাই ব‍্যবহার করতে পারবে। কদিনপর বেলা নদীদের বাসার পিছন দিয়ে এসে একটা চিঠি চুপ করে নদীর হাতে দিয়েছিলো। তাতে ছেলেটির ঠিকানা লেখা ছিলো এবং টেলিফোন নাম্বার ছিলো। আরো লেখা ছিলো, ছেলেটি নদীকেই আজীবন ভালোবাসবে। শুধু নদীর উওরের অপেক্ষায় আছে সে। নদী যেন বেলাদের বাসা থেকে ফোন করে তাকে। তার হাতে সময় খুব কম। সে বিদেশে যাবার আগে একবার শুধু নদীর উওরটা জানতে চায়। পরিবারের বিপক্ষে যেতে হলে তাই যাবে সে। নদী যেন উওর দেয়। নাহ্। নদী উওর দেয়নি এবং ফোনও করেনি। নদীর বাবা, নদীকে বলেছিলেন, তোর জন‍্য জীবনে আজ প্রথম অপমানিত হলাম আমি। ছি ছি ছি। বাবার ছি ছি শব্দটি এবং ছেলেটির বাবার নিন্মমানের কথাগুলো, মায়ের কান্না, সব, সব তীরের মতো নদীর মনে বসে গিয়েছিলো। আগের দুটো চিঠিই সে ছিঁড়ে ফেলেছিলো। একেবারেই মন থেকে মুছে ফেলেছিলো ছেলেটিকে। বেলাকে বলেছিলো, ছেলেটির চিঠি বেলা যেন আর তাকে না দেয়। বেলার কাছে চিঠি এসেছিলো, একটার পর একটা। বেলাই তাকে দিতে আসতো চিঠি আসলেই। কিন্তু প্রতিবারই নদী বেলাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং চিঠিও নেয়নি। অবশেষে নদীই, বেলাকে বলেছিলো, জানিয়ে দিস তাকে, আমার জবাব না। বেলা বলেছিলো, ঠিক আছে, তাহলে আমিই জানিয়ে দিবো চিঠি লিখে, আর যেন তোকে চিঠি না দেয় এবং তোর উওরটাও। এদিকে বাবা, দাদাকে এবং দুলাভাইকে বলেছিলো, নদীর জন‍্য ছেলে দেখতে। যেভাবেই হোক পাএ পেতে হবে। নদী বারবার অনুরোধ করেছে বাবাকে। কারণ তার ইচ্ছে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরী করবে। কিন্তু বাবাকে মানাতে পারেনি নদী। কাউকেই মানাতে পারেনি। পরীক্ষার পর দাদা সরাসরি মোস্তাককে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছিলো। সাথে আপা, দুলাভাইও ছিলেন। মায়ের নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পড়িয়ে নদীকে সামনে নিয়ে এসেছিলো। মোস্তাক দাদার অফিসেই চাকুরী করতো। নদীকে দেখেই মোস্তাক সম্মতি দিয়ে দিয়েছিলো বিয়ের। নদীদের বাসার কেউ নদীর মতামতও জিজ্ঞেস করেনি। দাদার বিয়ের জায়গায় পরীক্ষার দুইমাস পর নদীর বিয়ে হয়ে গেলো মোস্তাকের সাথে। বিয়ের পর নদীর একটাই অনুরোধ ছিলো মোস্তাকের কাছে, সে পড়াশুনা করতে চায়। চাকুরী করতে চায়। বাঁধ সেধেছিলেন, তার শাশুড়ি। কিন্তু মোস্তাক কথা দিয়েছিলো নদীকে। তাই ঢাকা এসেই নদীকে ভারসিটিতে ভর্তি করে দিয়েছিলো। মোস্তাক অনেক করেছে নদীর জন‍্য। নদী আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে মোস্তাকের কাছে এজন‍্য। কজন স্বামী কথা রাখে? নদী অর্নাস পাশ করেই চাকুরী পেয়ে গিয়েছিলো। তার একবছর পর খোকা এসেছিলো তাদের ঘরে। নদী কোনদিনও মোস্তাককে এই কথা বলেনি। কারণ বলার মতো কিছু কি ছিলো? তখন নদীর পৃথিবীটা জুড়ে শুধুই মোস্তাক, খোকা, চাকরি, এবং সংসার। এতোবছরেও একটিবারের জন‍্যও নদী অতীতের কথা মনে করেনি এবং মনে করার মতো সময়ও তার ছিলো না। নদী দুচোখ বন্ধ করে ছেলেটির মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। ফর্সা, লম্বাটে, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, গায়ে কালচে খয়েরী রঙের শার্ট কিন্তু কিছুতেই মুখটা মনের আয়নায় ভাসছে না। নদী পাগলের মতো চেষ্টা করছে মুখটা ভাসাতে। আসছে না, আসছে না, মনের আয়নাতে। বয়সের সাথে সাথে ছেলেটির মুখটাও ঝাপসা হয়ে গেছে। নদী প্রবলভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার ব‍্যর্থ হচ্ছে। ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি শব্দটা নদীর কানে বাজছে। নদী তখন আর নদীর ভিতরে নেই। সে তখন কিশোরী নদী হয়ে গেছে। এই পড়ন্ত বয়সেও একটা অন‍্যরকম ভালোলাগায় নদীর সমস্ত শরীরটা যেন শিহরিত হয়ে উঠছে বারবার । কতক্ষণ চলে গেছে নদী জানে না। হঠাৎ মিতালির ডাকে নদী চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো, পড়ন্ত বিকেলর শেষ আলোটুকু বারান্দায় পড়েছে। সন্ধ‍্যা হবে একটু পরেই। মিতালি মাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, মা কি হয়েছে তোমার? তোমার সমস্ত মুখ, এমন লাল হয়ে গেছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো? নদী তাড়াতাড়ি হাতের সুয়েটারের সূতাটা বাক্সে ছূঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, কি হবে আমার? কিছু নাতো। মিতালি বললো, বাবা তোমাকে ডেকে অস্থির হচ্ছে, চা খাবে। নদী তাড়াতাড়ি বেডরুমে এসে মোস্তাকের দিকে তাকিয়ে জীবনে এই প্রথমবারের মতো কঠিন গলায় বললো, চেঁচিয়ে সারা পাড়া জানান দিচ্ছো কেন? একটা বেলাকি আলোর হাতের চা খেতে পারো না? মিতালিকে বললেও তো পারতে? সবকাজে আমাকেই কেন দরকার। আমার নিজের জন‍্য একটু সময়ও কি আমি পাবো না কোনদিনও? এযেন এক অন‍্য নদী। মোস্তাক মুগ্ধ চোখে নদীকে দেখে ফিসফিস করে বললো, বাহ্, রাগলে তো তোমায় বেশ লাগে। আগে কখনোই তুমি রাগ করোনি। গালগুলোতে যেন রক্ত জমে গেছে। এখন থেকে মাঝে মাঝেই এভাবে রেগে যেও। অপূর্ব লাগছে, এই বয়সেও আজ তোমাকে। নদী বললো, তাই করবো এখন থেকে। ছেলেমেয়ে, সংসার, তুমি, আর ভাববো না এতোকিছু। আর বিয়ের এতো বছর পর তোমার মনে হলো, আমি সুন্দর? আগে চোখে পড়েনি? মোস্তাকের চোখে তখনও মুগ্ধতার ঘোর। এতোবছর পর নদীকে যেন নতুন করে দেখছে এইরূপে। এতো সুন্দর নদী? একটু কাছে আসবে নদী, বিড়বিড় করে বললো মোস্তাক। যওোসব বাজে কথা বলতে তোমার জুড়ি নেই। এই বলে নদী তাড়াতাড়ি কিচেনে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ছি ছি। আজ এতো বছর পর তার কি ভীমরতি ধরেছে? কিসব আবোলতাবোল চিন্তা করছিলো সে? সে কি ধরা পড়ে গেছে মিতালি অথবা মোস্তাকের কাছে? তাড়াতাড়ি গ‍্যাসের চূলোয় নদী চায়ের পানি বসিয়ে দিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখলো, আকাশটা আজ যেন সেই পড়ন্ত বিকেলের মতো একই রঙে সেজেছে। চারপাশে সন্ধ‍্যা নামছে। ভালো লাগছে দেখতে আকাশটাকে। ভালো লাগছে ছেলেটির কথা মনে করতে। চা হয়ে গেছে। যাক। গ‍্যাস বন্ধ করলো নদী। সে আজ অন‍্য নদী। একটুখানি সময় আজ নদী তার জন‍্য রাখতে চায়, সব দায়িত্ব ভূলে। কিন্তু কেন? সেইরাতে নীল রঙের চিঠিটা শান্ত নদীকে কি খরশ্রোতা নদীতে পরিণত করেনি? সারাটারাত কেন সে চিঠিটা পড়ছিলো একটু পর পর? তারমানে সেও কি ভালোবেসেছিলো ছেলেটিকে? প্রশ্নগুলো নদী নিজেই নিজেকে করলো। উওরটাও শুধু নদীই জানে। আযানের সুমধুর ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। নদী এক ঝটকায় যেন বাস্তবে চলে আসলো। নামাজ পড়তে হবে, ধীর গতিতে নদী হেঁটে যাচ্ছে। নদীর চোখে জল।

(সমাপ্ত)

সাবিহা খান, লন্ডন