একজন পাঠিকার চোখে

পর্ব ১: অদেখা পাঠিকা

রুমীর বয়স ষাট পেরিয়েছে অনেকদিন। চোখে চশমা, চুলে রূপোর রেখা। কিন্তু কলমে আজও ঝরে প্রেমের বৃষ্টি, সময়কে হার মানিয়ে। তিনি কোনো নামজাদা কবি নন, তবে ফেসবুকের এক কোণায় তার কবিতা ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় কিছু মনচঞ্চল পাঠকের হৃদয়ে।

প্রতিদিন সন্ধ্যা ছুঁতে না ছুঁতেই তিনি পোস্ট করেন নতুন কবিতা, নতুন কথামালা। তার টাইমলাইনে কোনো কোলাহল নেই—শুধু একান্ত কিছু পাঠক, যারা নীরবে পড়ে, অনুভব করে, আবার হারিয়ে যায়।

তবে একজন আছে—নাম তার রিমা। বয়স মাত্র বাইশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সাহিত্যপ্রেমী, একটু ভাবুক। বন্ধুদের ফটোবোমায় ঘেরা ফিডের মাঝে সে প্রতিদিন খুঁজে নেয় রুমীর পোস্ট। কোনোদিন লাইক করে না, কোনো মন্তব্য রাখে না। শুধু চুপচাপ পড়ে যায়। যেন লাইনগুলোর মাঝে লুকোনো থাকে তার নিজস্ব কোনো ব্যথা কিংবা বাসনা।

রুমী জানেন না, কোথায় থাকেন রিমা, কী করেন, বা আদৌ কেউ আছে কিনা এমন করে তাকে পড়ছে। তিনি কেবল লেখেন। লিখতে থাকেন।

কিন্তু একদিন কিছু বদলে গেল।

রাত দশটার কবিতা পোস্ট করার মিনিট দশেক পরেই একটা অচেনা ইনবক্সে নটিফিকেশন।

“আপনার লেখাগুলো… আমার পৃথিবী বদলে দিয়েছে। আমি জানি না আপনি কী ভাববেন, কিন্তু আমি আপনাকে ভালবাসি।”
— রিমা

রুমীর বুকের ভিতর কেমন যেন ধাক্কা লাগলো। এই বয়সে এসে এমন অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয় নেই। না তিনি আশা করেছিলেন এমন কিছু, না প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু রিমার বার্তায় ছিল একধরনের নৈঃশব্দ্যের স্পর্শ—যেটা শুধু একজন প্রকৃত পাঠকই দিতে পারে।

তিনি উত্তর দিলেন না। শুধু ফোনটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তবু চোখের পাতা কিছুতেই নামলো না।

পর্ব ২: আড়ালের আলো

রাতটা ঘুমের ছিল না। রুমীর চোখে লেগে ছিল একটুখানি অচেনা উজ্জ্বলতা। বয়স ছাপিয়ে প্রেম শব্দটা তার কানে যেভাবে বাজলো, তা অনেক পুরনো সঙ্গীতের মতো—ভুলে গিয়েও মন চেনে।

সকালবেলা তিনি বার্তাটা আবার পড়লেন। এবার ধীরে, শব্দে শব্দে।
রিমা নামের মেয়েটি কোনো ছলনা করে লেখেনি, সেটি তার চোখ বুঝে বললো। ইনবক্সে দেখা গেল, সে আরও কয়েকটি কবিতায় “সিন” করেছে, কিন্তু কখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

রুমী উত্তর লিখলেন না। শুধু কবিতার একটা খসড়া খুলে বসলেন।

যে চেয়ে থাকে দূর থেকে
সে হয়তো সবচেয়ে গভীর ভালোবাসে।
তার চোখে থাকে ভয়—
যদি তোমার চোখে পড়ে ফেলে,
যদি তার নিঃশব্দ প্রেম ফিসফিসিয়ে ওঠে
তুমি কি পালিয়ে যাবে?

পোস্ট করলেন না। শুধু নিজের কাছে রেখে দিলেন।

বিকেল নাগাদ আরেকটি বার্তা এলো।

আপনি যদি ভুল বুঝেন, আমি মাফ চাই।
আমি জানি, আপনি অনেক বড়, অনেক দূরের।
কিন্তু আমি তো কোথাও বলার সাহস পাইনি।
এতদিন ধরে চুপ করে ছিলাম, শুধু আপনাকেই পড়তাম।

রুমী এবার শুধু ছোট্ট একটা জবাব দিলেন—

ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়।

তারপর আর কিছু না। তিনি উঠলেন, বারান্দায় দাঁড়ালেন। সামনের গাছে কোকিল ডাকছে, কিন্তু তার বুকের ভিতর বাজছে অন্য সুর।

রিমা তখন অন্যপাশে, একটা ক্লাসরুমে। ফোনের পর্দায় রুমীর উত্তর দেখে হাত কাঁপছে তার। সে জানে না এরপর কী হবে। কিন্তু এটুকু বোঝে—এই মানুষটার শব্দই তার জীবনের শব্দ হয়ে গেছে।

পর্ব ৩: মুখোমুখি

রুমীর মনে প্রশ্নের জট। এই বয়সে এসে ভালোবাসা শব্দটা শুধু কবিতার উপাদান হয়ে ছিল এতকাল। বাস্তবের রঙে তার এমন আঁচ লাগে, ভাবেননি কখনও। সন্ধ্যার দিকে তিনি হঠাৎ একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন।

রিমা, আমি উত্তর দিতে জানি না। তবু যদি কখনো মনে করো, তোমার এই নীরব পাঠিকা সত্তাকে আমি চা খাইয়ে ধন্য করতে পারি—তাহলে বলো।

পাঠিয়ে দিলেন। আর ভাবলেন—হোক যেটা হবার।

দুই মিনিট… পাঁচ মিনিট… কুড়ি মিনিট…
তারপর রিমার উত্তর এলো।

কাল বিকেল, শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে। আমি আসব। আপনি যদি না আসেন, আমি বুঝে নেব—আপনি কবিতা হয়েই থাকতে চান, কবি হয়ে নয়।

রুমী বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শুধু বুকটা যেন অনেকটা হালকা লাগল।

পরদিন বিকেল।
রুমী পরেছিলেন একদম সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, হাতে তার সবসময়কার চামড়ার ফোল্ডার। লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন অনেক ছোট, অনেক তরুণ।

হঠাৎ একটা মৃদু গলা—

আপনি কি রুমী কবি?

রুমী মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। সামনে এক তরুণী—চোখে বইয়ের ছায়া, ঠোঁটে দেরি করা সাহস। বয়স ঠিক বাইশ তেইশ বলেই মনে হয়। মাথায় ওড়না, চোখে স্থির ভালোবাসা।

তোমার নাম রিমা?

রিমা হেসে বলল,

আপনার কবিতাগুলো আমি এখনো মুখস্থ করে ফেলিনি, কিন্তু একদিন পারব।

কথা চলতে থাকে। শহরের কোলাহল ফিকে হয়ে যায়, দুজন মানুষ এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকে—যেখানে বয়স কেবল সংখ্যা, আর ভালোবাসা মানে একে অপরের শব্দ বুঝে ফেলা।

রুমী ভাবেন, জীবনে প্রথমবার কেউ তার কবিতার ভেতরের মানুষটিকে দেখে ফেলল। শুধু শব্দ নয়, নীরবতাও।

পর্ব ৪: আকাশ ছুঁয়ে ফেলার গল্প

রিমা ও রুমীর মাঝে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। তারা প্রেমিক–প্রেমিকা নয়, আবার একে অপরের প্রেমিক ছাড়া কেউও নয়।

সেই বিকেলের পর থেকে তাদের দেখা হয় মাঝে মাঝে। চায়ের কাপে, বইয়ের দোকানে, ধীরে হাঁটা রাস্তায়।


রিমা এখন সরাসরি মন্তব্য করে রুমীর কবিতায়।
আর রুমী… রুমী লিখতে গিয়ে বারবার রিমার দিকে ফিরে যান।

একদিন রিমা বলল,

আপনি জানেন, আমি প্রথম কবে আপনার কবিতা পড়ি?

রুমী মাথা নাড়ালেন।

আমার মা মারা যাওয়ার পর। আমি খুব একা হয়ে পড়ি। হোস্টেল ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক বন্ধুর শেয়ার করা আপনার পোস্ট দেখি—

‘যারা হারিয়ে যায়, তারা দূরে থাকে না,
তারা মিশে যায় আমাদের নিঃশ্বাসে।’

তখন থেকেই আপনার লেখা আমার মা হয়ে যায়। আমার ঘুমপাড়ানি গান হয়ে যায়। আপনিও।

রুমী বুঝে উঠতে পারেন না। বলার কিছু খুঁজে পান না।
শুধু বলেন,

আমি তো ভাবিনি, আমার কবিতা কেউ এভাবে পড়বে।

রিমা হাত বাড়িয়ে বলে,

আপনার কবিতা তো আমি পড়িনি, আমি আপনাকেই পড়েছি—লাইন বাই লাইন, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।

সেই সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে সায়েন্স ল্যাবের রেলিংয়ে বসে দেখল আকাশ।
রিমা বলল,

এই আকাশ আমাদের প্রেমের মত—অথই, অসম, অথচ খুব সত্যি।

রুমী চুপ করে থাকেন। তিনি বোঝেন, এই মেয়েটি কোনো ভ্রম নয়। সে কবিতার পাতায় আসা এক বাস্তব স্পর্শ, যে তাকে আবার জীবন দিয়েছে।

পর্ব ৫: শেষ মানেই থেমে যাওয়া নয়

বছর ঘুরে গেছে।
শহরের ক্যালেন্ডারে অনেক পাতা উলটে গেছে, কিন্তু রুমীর মনে এখনো আটকে আছে সেই বিকেলটা—যেদিন রিমা বলেছিল,

আপনার কবিতাগুলো আমি মুখস্থ করে ফেলবো একদিন।

রিমা এখন মাস্টার্সের ছাত্রী। ক্লাস করে, কিছু টিউশনি করে, আর রুমীর পাশে বসে তার নতুন লেখা পড়ে। কখনও শুধরে দেয় শব্দের ভারসাম্য, কখনও বলে,

এইখানে আরও মায়া যোগ করুন।

রুমীর বয়স বাড়ছে। হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে, তবু সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি লিখেন। কারণ জানেন—পাশের টেবিলে একদিন সেই লেখা পড়ে কেউ নিঃশ্বাস ফেলবে।

তাদের সম্পর্কে কোনো সামাজিক নাম নেই। না তারা স্বামী-স্ত্রী, না প্রেমিক-প্রেমিকা, না কোনো ঘোষণাবাহক যুগল।


তবু একটা সম্পর্ক এমন আছে, যেটা “তুমি” বললেই মনে হয়, পৃথিবী থেমে গেছে একটু।

একদিন রুমী হঠাৎ বললেন,

রিমা, তুমি জানো তো, আমি চাই না আমার কবিতাগুলো আমার মৃত্যুর পর হারিয়ে যাক।

রিমা হেসে বলল,

আপনি মরবেন না। আমি বেঁচে থাকতে দেবো না মরতে। আমি আপনার কবিতাগুলোর কবর খুঁড়তে দেবো না।

রুমী অবাক হয়ে তাকালেন।
রিমা তার ফোন বের করল, দেখাল—একটি ওয়েবসাইট খুলেছে, যেখানে রুমীর সব কবিতা টাইপ করে রাখছে।

এই ওয়েবসাইটের নাম — rumikobita.com
এখানে আপনি থেকে যাবেন। আপনার লেখা, আপনার ভালোবাসা, আপনার আমি।

রুমী তখন বুঝলেন—শেষ মানে থেমে যাওয়া নয়।
তাদের এই অসম প্রেম কখনো নাম পাবে না হয়তো,
তবু তা থেকে যাবে বাতাসে, বইয়ের পাতায়, আর কারও নিঃশ্বাসে।

একদিন কেউ বলবে—

এক কবি ছিলেন, যিনি শেষ বিকেলে আবার জীবন পেয়ে গিয়েছিলেন—একজন পাঠিকার চোখে।

সমাপ্ত

© আলম