কাঠগোলাপ এবং সে

Photo of author

By Nadia Sinha

জীবনে তিক্ততা থাকাটা কি খুব বেশি প্রয়োজন? তিক্ততা না থাকলে এমন কি ক্ষতি হতো?শান্তিপূর্ণ জীবনটা কী এতোটা অমূল্য যে আমার জীবনে ধরা দেয় না?কোনো অপরাধ না করেও আজ অপরাধীর তালিকায় উর্ধ্বে। কেউ হয়তো জানে না তবে আমি জানি ওই এক্সিডেন্টটা আমার জন্য হয়েছে। আমি দায়ী সব কিছুর জন্য।
আজ আমার জন্য কোনো মায়ের কোল খালি।সেটা আমি কি করে মেনে নিব?আমার জন্য কোনো বাবা তার একমাত্র সন্তান কে হারিয়েছে।এই তিক্তাপূর্ণ সত্য আমি কি করে মেনে নিব?আমার জন্য শুধু মাত্র আমার জন্য কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানকে আদর করতে পারছে না,ভালোবাসে কাছে টানতে পারছে না,ছুঁতে পারে না, বাবা-মা ডাক শুনতে পারে না।আমার জন্য।
নাহ!আমি আর নিতে পারছি না এই তিক্তময় জীবন।আমারও একটু খানি শান্তি প্রয়োজন। খুব।আমারও একটু শান্তিময় তন্দ্রা অবশ্যক।যে তন্দ্রায় আজ নিদ্রিত ইহান।


তখন আমি সবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। কলেজে ভর্তির এক মাস আগেই আমার বড় আপু মুগ্ধতা পালিয়ে যায় কারও সাথে। যার দরুন বাবা আমাকে তার মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিলো যেনো কোনো ছেলের সাথে একটা টু শব্দও না কি। ইহান ছেলেটা প্রাণও দিয়ে দিলো আমার জন্য। আর আমি পাথর হয়ে রইলাম।
কলেজটা আমার বাসা থেকে বেশ দূরেই ছিলো। আর এই দূরত্বটাই যেন কাল হয়ে দাড়িয়ে ছিলো আমার জীবনে।
রোজ কলেজে যাওয়া আর কলেজ থেকে বাড়ি ফেরাই ছিলো আমার নিত্য দিনের কর্ম। এই নিত্য দিনের কাজেরই বাধা হয়ে দাড়ায় ইহান।
ছেলেটা আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলো। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের কলেজের পাশের ভার্সিটিতেই পড়তেন। দেখতেও বেশ সুদর্শন। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, সর্বদা চেক শার্টে দেখা যেতো তাকে। হঠাৎ একদিন ইহান হূট করে আমার পথ আটকে দাড়ায়। মুচকি হাসি উপহার দিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
“নাম কি তোমার?”
প্রশ্নটা সে স্বাভাবিক ভাবে করলেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। প্রচন্ড রেগেমেগে তার মুখের উপর জবাব দিয়ে দেই,
“আমার নাম যাতা আপনাকে কেনো বলব?কে আপনি? প্রেসিডেন্ট নাকি যে নাম বলা লাগবে? লজ্জা করে না রাস্তা ঘাটে মেয়েদের নাম জিজ্ঞেস করে বেরান?……..”
এরকম নানা কথা আমি তাকে শুনিয়ে যাচ্ছিলাম।
যেনো অটো হয়ে গেছি। থামার কোনো নাম নিচ্ছি না। আমার বান্ধবীরা আমাকে বার বার থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অতঃপর আমার কথার প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটা কিছু বললো না। চলে গেলো। আর আমি তখনও বকবক করেই যাচ্ছি।
এর মধ্যে বেশ অনেক দিন কেটে গেলো ছেলেটাকে আর দেখিনি। এ কদিনে আমি খুব অনুতপ্ত হলাম । খুব অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। সে তো নামই জিজ্ঞেস করেছে আর আমি এত গুলো কথা শুনিয়ে দিলাম। কাজ টা ঠিক করিনি। আবার এটাও মনে হতো যা করেছি ঠিক করেছি না হয় আরও বেঁকে বসতো।
সেদিনটা ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। কিয়ৎ অন্তর অন্তর কেঁপে উঠছে অম্বর। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দূর থেকেই দেখা মিললো ইহানের। তার হাতে কৃষ্ণচূড়া। খুব দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম একটি গাড়ি খুব দ্রুত তার দিকে তেড়ে আসছে। আমার ভিতরটা ধক করে উঠল আজানা এক আতঙ্কে। গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে তার দিকে আসছে আমি পাথরের ন্যায় জমে গেছি। আচমকা গাড়িটা তার খুব কাছে চলে আসে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। গাড়িটা তার উপর চরার আগেই সে খুব সাবধানে সরে দাঁড়ায়। আমার দেহে যেনো প্রান ফিরে আসে। ইহান আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে কতক্ষণ ধরে ডাকছে আমি জানি না। শেষে বাধ্য হয়ে সে আমার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দেয়। আমি হুঁশে ফিরে আসি।
“আর ইউ দেয়ার? আমি অনেকক্ষন ধরে ডাকছি তোমায়। তোমার বাস এসে গেছে।
তার সরল উক্তি। কন্ঠে যেনো আলাদাই মাধুর্যতা রয়েছে। তার কথাতেই যে কেউ বলে দিতে পারবে ছেলেটা অতন্ত্য সরল-সহজ।
আমি ইহানের দিকে একপলক তাকিয়ে বাসে চেপে বসি। ইহান পেছন থেকে ডেকেছে। হয়তো কিছু বলার জন্য। আমি সে সুযোগ না দিয়েই চলে আসি। সে জানালা দিয়ে কয়েকবার কৃষ্ণচূড়া ফুল এগিয়ে দিয়েছে। আমি নেই নি। সে বার বার বলছে “এত দিন পরিক্ষা চাপে আসতে পারিনি।রাগ করেছো সে কারনে?” বাস ছেড়ে দিয়েছে আর ইহানও অনেকক্ষণ আমার জানালার পাশে দৌড়ে এসেছে। ইহান দৌড়েও বাসটা ধরতে পারেনি। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে রাস্তায় হাঁটু গেরে বসে পরে।


ইহান হয়তো কোনো ভাবে জেনেছে আমার ফুল খুব প্রিয়। তাই সেদিনের পর থেকেই ইহান রোজ আমার জন্য গোলাপ, বেলি, ক্যালেন্ডুলা, জুঁইফুল সব ধরনের ফুল নিয়ে আসতো। যা আমি কখনো চোখে দেখিনি সে ফুলও এনেছে। আমি প্রতিবারই তা ফিরিয়ে দেই। হয় তাকে অপমান করে নয় তাকে এরিয়ে।
সেদিনও আকাশ মেঘলা ছিলো। মেঘের গর্জনে কেপে উঠছে অম্বর। রাস্তা ঘাটে তেমন লোকজনও নেই। একা একা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় আধাঘন্টা হবে।আজ বাসটাও আসতে খুব বেশি দেরি করছে। হঠাৎ দেখি ইহান আমার সামনে এসে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ নিয়ে হাজির। ছেলেটা এটাও জেনে গেছে আমার কাঠগোলাপ খুব পছন্দ।
ইহান কাঠগোলাপ গুলো আমার সামনে তুলো বলতে শুরু করে,
“অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছি তোমাকে ভালোবাসি বলার জন্য কিন্তু প্রতিবারই আমি ব্যর্থ। তবে আজ তোমাকে শুনতে হবে উত্তর যাই হোক। আমার ভালোবাসা গ্রহন করে নেও। তোমার প্রিয় কাঠগোলাপকে সাক্ষী রেখে কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী করে রাখব।”
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে দম নেয় ইহান। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাঁটা ধরলাম সামনে। ইহান আমার পিছু পিছু আসছে আর নানা কথা বলে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই এই নির্লজ্জ ছেলের সাথে কথা বলার। এত এত অপমান করি তাও চলে আসে পিছু পিছু।
সে আমার পিছু ছাড়ছে না আমি বাধ্য হয়ে থেমে যাই। তার মুখোমুখি দাড়াই।
“সমস্যা কি আপনার বার বার কেনো আমার পিছু নিচ্ছেন? আপনি কি অবুঝ? আমার আপনার প্রতি কেনো আগ্রহ নেই। তাও বেহায়ার মত চলে আসেন আমার পিছু পিছু। নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার।”
আমি বেশ তেজ দেখিয়ে কথা গুলো বলি। খানিকটা চিৎকারও করে ফেলি যার দরুন আশে পাশে পথ যাত্রী আমাদের দিকে লক্ষ্য করছে। ইহান আমার কথার তোয়াক্কা করে বলে,
“তোমাকে ভালোবাসে যদি বেহায়া হওয়ার প্রয়োজন হয় তবে আমি তাতেই আনন্দিত। স্নিগ্ধা প্লিজ বিশ্বাস করো আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি। তোমার জন্য নিজের জীবনটাও কোরবান করতে দু’বার ভাব না।”
ইহানের কম্পিত কন্ঠস্বর। তবে তাতে আমার পাথর হৃদয় একটুও নরম হয়নি। বরং তা কঠোর থেকে কঠিন পাথরে তৈরি হয়ে গেছে।
“ঠিক আছে তাহলে জীবনই দিয়ে দিন তবু আমার পিছু ছাড়ুন প্লিজ।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলি। আমার গম্ভীর জবাব। ইহান তাও যেনো দম নিলো না। ফুটপাতের লোক জন আমাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। আমার কাছেও খুব অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে।
পেছন থেকে হঠাৎ কেউ আমার ডান বাহু চেপে ধরে। খানিক পিছন ফিরেই দেখি ইহান। সে আমার বাহু ধরে কম্পিত কন্ঠে মৃদু আর্তনাদে করে বলে,
” প্লিজ….
ইহান আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই আমার মাথায় রক্ত চেপে বসে। আমি ঝাড়া মেরে তার হাতটা আমার বাহু থেকে সরিয়ে নেই। আর নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে সজোরে তার বক্ষ বরাবর অপ্রস্তুতকর ধাক্কা দিয়ে দেই। ইহান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আমার এহেন কান্ডে।
আমার ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ইহান ছিটকে পরে মেইন রাস্তায়। ঠিক সেই সময় একটি বাস ইহান কে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ছিটকে পরে ইহান।
চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে মেরে দিলাম আমি। ইহানকে ধাক্কা দেয়ার পূরো ঘটনাটা আমার মস্তিষ্ক বার বার চারন করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কি হলো এটা বুঝতো আমার কিছুক্ষণ সময় লাগলে। সম্পূর্ণ রাস্তায় র’ক্তে’র ছড়াছড়ি। ইহনের হাতের কাঠগোলাপটাও তার র’ক্তে মাখামাখি।


বাসের সাথে ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ইহান ছিটকে পরে রাস্তায়। কাঠগোলাপে পাপড়ি গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পিশে গেছে।ইহানের চশমাটাও ভেঙ্গে চুরমার। আমি বরফের ন্যায় জমে গেছি। ইহান বাসের সাথে ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই তার ক্ষত-বিক্ষত দেহটা গিয়ে পরে রডের উপরে। ইহানের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হওয়া রাস্তায় কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিলো। সেখানে রডও ছিলো। আর ইহানের দেহটা সেই রডের উপরে ছিটকে পরে আর রড গুলো গেথে যায় ইহনের পিঠে।
রড গুলো ইহানের পিঠে লেগে বক্ষস্থল ও পেটের অংশ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুলগুলো থেকে অনবরত র’ক্ত ঝরছে। সর্বাঙ্গে তার আচরে গেছো। মুখশ্রীর এক পাশ থেঁ’ত’লে গেছে প্রায়। ডান হাতের চামড়া মাংস থেকে আলদা হয়ে গেছে। যেনো কেউ ছুড়ি দিয়ে উপরে ফেলেছে। মোটা জিন্স প্যান্ট ছিঁড়ে আচরে গেছে পা দু’টো। মাথায় আঘাত লাগার দরুন মাথায় ফেটে রক্ত ঝরছে। ভয়ংকর দৃশ্য। ছেলেটা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ। আশে পাশে মানুষও ভীর করেছে বেশ। সম্পূর্ণ রাস্তায় র’ক্তে মাখামাখি। আচমকাই বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ইহানের সর্বাঙ্গ। ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ইহানের র’ক্তা’ক্ত শরীর। কাঠগোলাপের পাপড়িতে লেগে থাকা র’ক্ত গুলোও ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টি পানিতে। তার সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে আমার রঙ্গিন জীবন।
শেষ পর্যন্ত ছেলেটা তার জীবন কোরবান করে দিলো। ভাবলাও না একটি বার। আমি আর চেয়ে থাকতে পারলাম না। এই নির্মম পরিনতি আমাকে যেনো পাথরে পরিনত করেছে। যেনো অতি শোকে পাথর হয়ে গেছি। জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলাম রাস্তায়।
অতঃপর কাঠগোলাপ এবং সে চিরতরে হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।
মৃত্যু হলো আমার প্রিয় কাঠগোলাপের, মৃত্যু হলো সবচেয়ে অমূল্য অপ্রিয় অজানা কিছুর…………..


[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]