কালুখালি জংশন: হারিয়ে যাওয়া বাজীকরের সন্ধানে

Photo of author

By Asif Iqbal

ভাটিয়াপাড়া টু রাজবাড়ী ভায়া কালুখালীর এই ট্রেন দিনে দুবার আসা যাওয়া করে। এদিকের ষ্টেশনগুলো ছিল দেখার মতন। সবগুলো প্রায় একই প্যাটার্ণের। দেশ স্বাধীনের অনেক বছর পরেও ষ্টেশনের টয়লেটের সামনে হিন্দি এবং উর্দুতে মহিলা- পুরুষ “সৌচাগার” লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেছে। এমনকি রেল ক্রসিং EPR লেখা থাকতো। গতীর জন্য এই ট্রেনের বদনাম ছিল আর যাত্রীর সাথে মিলিয়ে হকারের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।

বাবার সাথে বছর তিনেক যাতায়াত করে সব মুখস্ত । নিয়মিত বিরতি দিয়ে আমি একাই এখন এই ট্রেনের যাত্রী। হাইস্কুলে পা দেওয়ার আগেই একা একা যাতায়াতের হাতে খড়ি হয়ে গেছে। তখন মানি অর্ডারের যুগ হলেও মাসের শেষে মাইনের টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কাজ আমি আনন্দের সাথে করতাম। একে ট্রেন ভ্রমনের আনন্দ আর সাথে টাকা খরচ করার স্বাধীনতা।

ভেড়ামারা থেকে কাশিয়ানী যেতে দুবার ট্রেন বদল, মানে সাকুল্যে তিনখানা ট্রেন। ভেড়ামারা থেকে পোড়াদহ, এখান থেকে গোয়ালন্দ মেইল ধরে কালুখালী জংশনে নেমে রাজবাড়ি থেকে আসা ভাটিয়াপাড়াগামী ট্রেন ধরে তবেই গন্তব্য। সেবার মাস মাইনের টাকা পকেটে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ঠিক মত কালুখালী এসে বাধলো বিপত্তি, ট্রেন লেট।

সময় কাটানোর জন্য এটা ওটা খাই, পুরো প্লাটফর্মের এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক যায়গায় মজমা শুরু হয়েছে। ঔষুধ ফষুদ বেচা বিক্রির কায়দাটা বেশ ভালোই লাগে দেখতে। দাড়িয়ে পড়লাম একেবারে সামনের সারিতে। না ঔষুধ, দাতের মাজন কিছুনা। একটা ছোট ছেলেকে চাদর দিয়ে ঢেকে পেটের মধ্যে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদছে। কিছুক্ষন আগে একে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এরই মধ্যে রক্তারক্তি কান্ড।এ আবার কি খেলা- কে জানে?

আর ছুরি চালানো লোকটা সবার কাছে টাকা চাইছে দুই টাকা এক টাকা। যে যা পারেন এই ছেলেটার চিকিৎসার জন্য। বুঝলাম না, নিজেই ছুরি মেরে আবার মানুষের কাছে টাকা চাইছে কোন আক্কেলে? ভয় দেখাচ্ছে টাকা না দিলে পকেটে আগুন লেগে যাবে।আমি দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। তিনি আট টাকা ফেরত দিলেন।

সবাইকে বললেন, টাকা না দিয়ে গেলে নাকি অজ্ঞান হয়ে যাবে। পাশে একজন ধুপ কর মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। আমার পকেটে অনেকগুলো পাচ শত টাকার নোট। মাইনের টাকা বাড়িতে কিভাবে নেবো- যদি আগুন লেগে যায়। আর অজ্ঞান হয়ে গেলে? লোকটা ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুএকজন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। উনি ঘুরে ঘুরে সবার কাছ থেকে এক টাকা দুই টাকা নিচ্ছেন। কাছে আসতেই পকেটের সব টাকা লোকটার হাতে দিয়ে দিলাম। মধ্য আশির দশকে দুই হাজার টাকা-মানে অনেক টাকা।

লোকটা টাকা হাতে নিয়ে দেখে বললেন “তুমি কিছুক্ষন আগে দশ টাকা দিলে-আমি আট টাকা ফেরত দিলাম না?

আমি বললাম হ্যাঁ,

তাহলে আবার দিচ্ছ কেন, আর দরকার নাই। বলে টাকাগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়ে বললেন “এখানে দাঁড়াও কোনো ভয় নাই।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে মজমা শেষ, ট্রেনের হুইশেল শোনা গেলো। চাদরের নীচের ছুরি খাওয়া ছেলেটা দিব্যি হেসে হেসে পাউরুটি আর মিষ্টি চিবোচ্ছে। তাহলে এতক্ষন যা হয়েছে সব ভাওতা, মিথ্যে?

এবার বাজীকর লোকটা আমার কাধে হাত দিয়ে বলল “ভাইডি,আমরা মানুষের কাছে কথা বেচে খাই,এই ধান্ধা করে পেট চালাই। এক-দুই টাকার বেশি আমরা নেই না। তুমি এত টাকা পাইছো কই?

আমি বললাম- আব্বার বেতনের টাকা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

-এতটুকু মানুষ একা একা,সাথে এতগুলো টাকা দিয়ে পাঠানো ঠিক হয় নাই

আমি বললাম “আমি অনেকদিন ধরেই একা একা চলাচল করি।

ট্রেন এসে পড়লো। বাজীকর লোকটা আমাকে গার্ডের রুমে নিয়ে-বললেন “বড় বাবু, এই ছেলেটা কাশিয়ানী যাবে। কাছে অনেকগুলো টাকা। অনেক মানুষ দেখেও ফেলেছে। পুরো বিত্তান্ত শুনিয়ে বললেন “ছেলেটাকে আপনি সাথে নিয়ে যান। একা একা কোথায় কে মেরে টাকাগুলো কেড়ে নেয়।

বড় বাবু বললেন- টিকিট আছে। আমি বললাম “জি আমি হাফ টিকিট করি, সব সময়।

ট্রেনের ছাড়ার সময় লোকটা বলল “ভাইডি ভালোভাবে বাড়ি গিয়ে টাকাগুলো মায়ের হাতে দিও, আর আমাদের মত বাজীকরদের কথায় এমন বোকামী করোনা। পেটের জন্য কত মিথ্যা বলি। আমরা তো ভালো মানুষ না।

ট্রেন চলতে শুরু করে। এত ভালো কথার পরেও লোকটাকে সেদিন নিষ্ঠুর মনে হয়েছিলো।

তারপর অজস্রবার এই ট্রেন, কালুখালি জংশন পেরোই। সেদিনের সেই ছুরি খাওয়া ছেলেটির বয়স আমার মতই বেড়েছে। বাজিকর বেঁচে আছে কিনা, থাকলে বয়স পেরিয়েছে অনেক। কালুখালী ষ্টেশনে নেমে প্রতিবার খুঁজি। নাম ধরে নয়,রেলের ধারে,প্লাটফর্মের আনাচে কানাচে। নাই কোনোদিন আর তাকে দেখিনি।

দীর্ঘদিন এই লাইনের ট্রেন বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়েছে। পুরনো দুজন হকার এখনো জীবিত আছে। যাদের আমি দশ বছর বয়স থেকে চিনি। এখনো নতুন হকার আসে, নোতুন মোড়কের পসরা নিয়ে।

কিন্তু সেদিনের সেই বই বিক্রেতা,ছন্দ কবিতা পড়ে যে বই বিক্রি করতো। বৃদ্ধ ঘোলাটে চশমায় পেছনে দড়ি বেঁধে চেঁচাত ‘রামদিয়ের রাম বাবুর মটকা। আয়নাল মিয়ার পান,ট্রেনের কামরার এক পাশ থেকে অন্যপাশে যার সুঘ্রাণ ছড়াতো। আরও কত মুখ।

আর সে বাজীকর? আমি তার অসংখ্য মিথ্যে কথার চাইতে তার মহানুভবতাকেই মনে রেখেছি। তার টাকার দরকার ছিলো, সে লোভী ছিলো না। আমি কোনোদিন্ সেই বাজীকরকে দেখিনি,আজও খুঁজি নিতান্ত একজন সৎ মানুষকে। যাকে কোনদিনও বলা হবে না- আমি আপনার কথা মনে রেখেছি, আপনি আসলেই ভালো মানুষ।