- জুলেখা বাদশাহর মেয়ে।
- আনোয়ার হাকিম।
ছোট বেলায় আধো আধো বোলে পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছবি প্রধান অনেক গল্প পড়িতে হইত। পড়িতাম আর নানারুপ কল্পনা করিতাম। তখন সব কিছুই মধুর আর রঙ্গীন লাগিত। সেইরুপ একটি গল্প হইলোঃ জুলেখা বাদশার মেয়ে। তার ভারী অহংকার। একদিন সে বাগানে গেল। দেখিল একটি মেয়ে ফুটফুটে চাঁদের মতো। জুলেখা কহিল,”কে তুমি ?এখানে কেন”? মেয়েটি কহিল,”আমি ফুলপরী। ফুলদের ঘুম ভাঙাই”। জুলেখা রাগিয়া গেল। কহিল, “আমার বাগানে আর আসিবে না”। মেয়েটি চলিয়া গেল। পরদিন জুলেখার বিবাহ। বাগানে ফুল ফুটিল না। পাখিরা গান গাইল না। জুলেখা কাঁদিতে লাগিল। এমন সময় ফুলপরী আসিল। কহিল, “তুমি কাঁদিতেছ কেন”? জুলেখা কহিল, “আজ আমার বিবাহ। কিন্তু আমার বাগানে কোন ফুল ফুটিল না, পাখিরা গান গাহিল না। তাই মনের দুঃখে আমি কাঁদিতেছি। তোমাকে চিনিতে পারি নাই। তুমি আমাকে মাফ করিয়া দাও”। ফুলপরী হাসিয়া উঠিল। সাথে সাথে বাগানে ফুল ফুটিল, পাখিরা গান গাহিল। জুলেখার মনও খুশীতে ভরিয়া উঠিল।
ছবির সহিত বড় বড় হরফে মুদ্রিত এই গল্প পড়িয়া কত কি যে ভাবিতাম,কত কি যে মনে হইত তাহা বলিয়া বুঝানো যাইবেনা। এই গল্পের মোরাল কি ইহা লইয়া বিন্দুমাত্র ভাবিতাম না। বাবা, মা বুঝাইতেন যে অহংকার করা ভাল না। আজ এতকাল পর ইহার সহিত দৃশ্যমান কাব্যনাট্য মিলাইতে গিয়া সর্বত্র বিষম লাগিতেছে।
আজকাল আগের মত আর রাজা, বাদশা নাই। থাকিলেও অতি অল্প। যাহারা আছে তাহারাও আগের সেই চমক, ঠমক লইয়া নাই। গুটি কয়েক অবশ্য আজো আছেন। তবে ইহাদের ইমেজ ঘৃণার উদ্রেক করে। সে যাহাই হোক, ইহা লইয়া আমার বিশেষ মাথা ব্যাথা নাই। আমি আন্তর্জাতিক জগত লইয়া মাথা ঘামাই না। দেশীয় সার্কাস দেখিয়াই কুল পাইতেছি না। আজকালকার জুলেখারা রুপে আঙ্গুর, মেকআপে ডানা কাটা। ইহাদের বংশে কেহই রাজা, বাদশা তো দূরের কথা নায়েব, কোতোয়াল পর্যন্তও ছিলনা। ইহাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ত পুষ্টি দুর্যোগে ছিল হতশ্রী আর শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনগ্রসর। তাহাতে কি? ইহারা এখন এক চিমটি পরিমাণ পুষ্টি পাইয়া আর এক চিমটি পরিমাণ শিক্ষা নামক এ প্লাস পাইয়া মেকআপ আর রুপের ঘুটা দিয়া বেশ করিয়া খাইতেছে। কম্পিটিটিভ মার্কেটে ইহাদের বেশুমার কদর। এক শ্রেণীর বেনিয়া ফকির ইহাদের ফেরি করিয়া বেড়াইতেছে। ইহাদের কাউকে অবিবাহিত কুইন বানাইয়া আবার কাউকে বিবাহিত প্রিন্সেস আখ্যা দিয়া ওপেন মার্কেটে ছাড়িয়া দিয়াছে। ইহাদের পিছনে অঢেল লগ্নি করিতেছে, বিভিন্ন প্লাটফরম খুলিয়া, বাহারি খেতাব ইত্যাদি দিয়া লগ্নিকৃত অর্থ পকেটস্থ যেমন করিতেছে তেমনি ইহাদের রস নিংড়াইয়া লইতেছে।আগেই বলিয়াছি আজকাল আমাদের এ ভূ-খন্ডে রাজা-বাদশা না থাকিলেও ভূঁই ফোঁড় অজস্র জুলেখার নিত্য জন্ম হইতেছে।প্রচারের গুণে আর যৌবনের ঝিলিকে জুলেখা আর পরীরা এখন একাকার হইয়া আকাশ জুড়িয়া ফানুস হইয়া শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। দেহজ তৈল শেষ হইয়া যাইবার আগেই বৈরি বাতাসে ইহাদের দুলন মাত্রা ও পতন যাত্রা শুরু হইয়া যায়। ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে ইহারা যতদিন অনুকূল বাতাসে থাকে ততদিন চারিদিক আলোকিত করিয়া রাখে। নীতি বাক্যের ফুল ঝুড়ি আর কীর্তির সার্কাস দেখিয়া আমজনতা চরম পুলক অনুভব করে আর চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া জিহ্বা লালায়িত করিয়া অজান্তেই বলিয়া উঠে, বাহ,বেশ তো। কতক কাল পর অংকের গড়মিলে বা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে পড়িয়া এই সব জুলেখা আর পরীদের আমল নামা জন সম্মুখে উদয় হয়। ইহার জন্য কোন গোয়েন্দা গিরি করিতে হয়না। সাংবাদিকদের কাহারো নিকট ধর্ণা দিতে হয়না। ইহারা নিজেরাই, ক্ষেত্র বিশেষে ইহাদের অতি নিকটস্থ বা সন্নিহিত আপন জনরাই এই সব তথ্য- চিত্র অডিও ভিডিও আকারে মার্কেটে ছাড়িয়া দেয়। জুলেখারা বাদশার মেয়ে। তাহাদের ভারি অহংকার।স্বভাবতই তাহাদের বাগানে পরীদের আগমনে ইহাদের গোস্বা,অপমান হইবারই কথা। পরীরাও কম কিসে? যাদুর স্পর্শে ইহারা বিরান ভূমিতে উৎপাদ উৎকীর্ণ করিতে পারে, পতঙ্গ আকৃষ্টকারী মন্ত্রে যে কাউকেই ধরিয়া, পোড়াইয়া, চিড়িয়া, ছিড়িয়া, ছাড়িয়া যাচ্ছেতাই করিতে পারে। অতএব জুলেখা আর পরীরা এখন সবাই শক্তিশালী। ইহাদের নিজ নিজ বলয় রহিয়াছে। সেই বলয়ে ইহারা ততদিনই সুরক্ষিত থাকে যতদিন ইহাদের সাপ্লাই সাইড অফুরান থাকে।রাজতন্ত্র,সামন্ততন্ত্র বিদায় লইয়াছে। গণতান্ত্রিক হাওয়া একচেটিয়া খেলিয়া যাইতেছে। তাই একজন জুলেখা আর একজন পরীর মধ্যে পার্থক্য ক্রমান্বয়ে কমিয়া আসিতেছে। ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে যাহাদেরই অভিষেক হইতেছে তাহাদের মধ্যেই “কাহারো সহিত শত্রুতা নহে, সবার সহিত বন্ধুত্ব” জাতীয় আঁতাত লক্ষ্য করা যাইতেছে। করোনা অনেক কিছুই করিতে নিষেধ করিতেছে কিন্তু ইহারা ধরিতেছে, করিতেছে, খেলিতেছে, ছাড়িতেছে জাতীয় গোল্লাছুট খেলিতেছে। এখন জুলেখাদের বাগানে পরীরাও আসে। জুলেখারাও ইহাদের ডাকে সাড়া দেয়।ফুলের বাগানও বর্ষব্যাপী হর্ষোৎফুল্ল থাকে। কিয়ৎকাল ‘কোথাও কোন দুঃখ নাই’ জাতীয় একটা আবহ বিরাজমান থাকে। পাবলিক ইহাতে চিত্তসুখ, রতিসুখ পায়।বস্তুতঃ জুলেখা আর পরীদের হর্ষ-বেদনায় পাবলিকের বিনোদনে তেমন কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়না।পাবলিক ইহাদের হাসি-কান্না আর কেচ্ছা-কাহিনীতে সাংবৎসর বেজায় আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকে। ইহারা লাইভে আসিয়া কত কথা যে বলে তাহার ইয়ত্তা নাই। দম্ভে,হাসিতে, হুমকিতে, ধমকিতে ইহাদের জুড়িনাই। আবার চোখের অশ্রু ঝড়াইয়া বিলাপ, প্রলাপ,শ্রাব্য,অশ্রাব্য বকাবাদ্য করার ক্ষেত্রেও ইহাদের অপুষ্ট রুচির প্রমাণ মেলে।
এখন আবার ছেলে বেলার গল্প প্রসঙ্গে ফিরিয়া আসি। তখনকার সেই গল্পের মোরাল ছিল অহংকার করা ভাল না। পরিণাম অশুভ। আগে জাতপাত ছিল। এখন নাই। অহংকার এখন গ্লামার জগতের অলংকার। পতন অনিবার্য জানিয়াও ইহাতে কর্ণপাত করা আর বোকামির খেসারত দেওয়া সমার্থক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাই, কে কাহারে লইয়া কোথায় ডুব মারিয়া, মোন্থণ করিয়া কি আহরণ করিতেছে, কোথায় কি স্থাপন করিতেছে ইহা জানিতে কাহারো ফেলুদা হইবার দরকার হইতেছেনা। সময়েই ইহা আপনা হইতে উদ্ভাসিত হইতেছে। ইউটিউবের কল্যাণে এই সব জুলেখা আর পরীদের অডিও, ভিডিও ক্লিপিংস তাই লক্ষ ভিউ পাইতেছে। পাবলিকের বিনোদন চাহিদা যেমন ইহাতে পূরণ হইতেছে তেমনি ইউটিউবারদের থলের আকারও স্ফীত হইতেছে। আর জুলেখা, পরীরা রোলার স্কেটারে চড়িয়া কখনো অসীম আকাশে ভাসিতেছে, কখনো মাটির কাছাকাছি নামিয়া কাদা ছোড়াছুড়ি করিতেছে। সবই তো ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের খেলা।