ভোরে বাগানে হাঁটছি। লামিয়ার চোখ পড়তেই মোবাইল কান থেকে সরিয়ে নিল।
আমি না দেখার ভান করে অন্যপাশে হাঁটতে গিয়ে টয়ার সাথে রীতিমতো ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচলাম।
টয়া এলোমেলো চুলে ঘুমঘুম চোখ তুলে আমাকে দেখে হেসে বলল, শুভ সকাল মইন ভাই।
— টয়া, তুমি এতো ভোরে?
— অবাক কাণ্ড না? আমি নিজেও নিজেকে দেখে অবাক। আমি এতো সকালে কিভাবে উঠলাম। হাউ?
পেছন থেকে কংকা হেঁটে এসে বলল, কিরে টয়া আজ এতো সকালে? তোর তো নয়টার আগে ঘুমই ভাঙ্গে না!
— সেটাই তো, আজ এমন অঘটন কেন ঘটলো তাই তো বুঝলাম না।
টয়া হেলেদুলে সামনে এগিয়ে গেলে কংকা বলল, মামা মামীর সাথে থাকে তো যত বাজে অভ্যাস সব ওর মধ্যে আছে। দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, ঝাব্বাঝুব্বা পোষাক পরা, কোনো রান্না না পারা, ছেলেদের সাথে মেশা, সবার সাথে বেয়াদবের মতো কথা বলা, সব বদঅভ্যাস।
লামিয়া এসে বলল, টয়া বেয়াদবের মতো কথা বলে না, উচিত কথা বলে।
— আসছে টয়ার ভয়ে থাকা আমজনতা। আমি কি তোর মতো? টয়া বেয়াদব সুতরাং সে বেয়াদব। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।
— তাহলে টয়ার সামনেই বলতি।
— আমার অযথা ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই। জানেন মইন ভাই, টয়ার মামা-মামী আস্ত একটা ক্রিমিনাল। সবকিছুতে নিজের স্বার্থ দেখে। আমাদের সাথে আনতে ওর মামীকে কত যে অনুরোধ করতে হলো। এমন স্বার্থপর মানুষ তারা যে কি বলবো।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, টয়া মামা- মামীর সাথে থাকে?
কংকা আবার বলল, নিজ পরিবার নেই বলে টয়া ভালো শিক্ষা পায় নি।
কংকা চলে গেলে আমি লামিয়ার দিকে তাকাই। টয়া মামা-মামীর সাথে থাকে?
— জ্বি ভাইয়া, তবে কংকা যেভাবে বলল ওতো ভয়ংকর জীবন টয়ার না। আপনি টয়াকেই জিজ্ঞেস করুন।
টয়ার দিকে এগিয়ে যাই আমি। ওর চলন বলনে কেউ বলবে না সে অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা। বরং ওকে দেখলে মনে হয় অন্য দশের চেয়ে সে বেশি প্রশ্রয় পায় পরিবারে।
টয়াকে কিছু বলার আগেই সে বলে ওঠে, এ বাগানের দেখাশোনা কি আপনিই করেন মইন ভাই?
— না, একজন মালি আছে। তবে আমিই বেশিরভাগ সময় দেই।
— আপনি খুব সৌখিন মানুষ। আচ্ছা আপনি কি ফুলেদের সঙ্গে কথা বলেন?
আমি হেসে বললাম, না তো? এমন আজব প্রশ্ন মাথায় এলো কেন তোমার?
— না মানে অনেকে কাব্যিক ঢংয়ে বলে না ফুল,পাখী লতা, পাতা আমার বন্ধু, আমি তাদের সাথে কথা বলি।
— আমি কাউকে বলতে দেখিনি।
টয়া দাঁত বের করে হেসে বলে আসলে আমিও দেখি নি। আপনার সাথে কাব্যিকতা চালাতে চেয়েছিলাম। আপনি নিষ্ঠুরভাবে ব্রেক টেনে ধরলেন।
— টয়া, একটা প্রশ্ন ছিল…তুমি… তোমার…
— বলে ফেলুন মইন ভাই। মামার সাথে থাকি সে ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন তো?
আমি কী বলব বুঝছিলাম না। টয়ার গম্ভীর মুখ দেখে বিব্রত হয়ে পড়ি।
–আমিই উত্তর দিচ্ছি। হ্যাঁ আমি মামার সাথে থাকি। তবে এটা দুঃখের কিছু নয় আমার জন্যে।
আব্বু আম্মুর ডিভোর্স হয়েছে ছোট বেলায়। আব্বু প্রথমেই আমার দায়িত্ব নেয়নি পরে আম্মুর বিয়ে হলে আমাকে মামার কাছেই থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকেই পরিচিত অপরিচিত সবাই আমার দিকে করুনার চোখে তাকাতো। আমার ভালো লাগতো না। তাই নিজেকে এমনরূপে সাজালাম যেন করুনা করা তো দূর সবাই রীতিমতো ভয় পায় আমাকে। কেউ করুনা দেখালে আমি রীতিমতো ঘেউ ঘেউ করে উঠি।
কংকাও আমাকে ভয় পায়। তাই আমার পেছনে সবার কাছে আমাকে অসহায় প্রমাণ করে একধরনের আনন্দ নেয়। আপনার কাছেও কংকা এ কথা বলেছে তাই না?
আমি ইতস্তত করে বলি না… মানে.. ও রকম…
- শুনুন, মামা মামী আমাকে অনেক আদর করে।
— কিন্তু এখানে আসার ব্যাপারে তোমার মামী নাকি অনেক ঝামেলা করেছে?
— হ্যাঁ করেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাবা-মাই তাদের মেয়েকে নতুন কোনো পরিবেশে পাঠাতে বাধা দেয়। মামী নিজের মেয়ের বেলায়ও তেমনি করতো। আপনিও কি মুমুর বেলায় করতেন না?
— হুম, তা করতাম…. সরি!
— আরে বাদ দেন তো! মজার কথা শুনেন, আন্টির সাথে গতকাল আড্ডা দিয়ে কত কি জেনেছি? আন্টির মনটা এখনও বাচ্চাদের মতো। সমুদ্র দেখার শখ, কত আফসোস তার মনে! আন্টি যে ভালো গান গাইতে পারে তা কি আপনি জানেন?
— ছোট মা গান জানে? আমি খুব অবাক হলাম।
— হুম। খুব মিষ্টি সুর।
মুহূর্তে আমার মনে অপরাধ ঘিরে ধরলো। সে রাতে নিজের মূলয়্যান, নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কত কি ভাবলাম। অথচ ছোট মায়েরও কত শখ থাকতে পারে তা কখনো মাথায়ই আসে নি। তথাকথিত সৎ মা ভেবে আমি সবসময় দূরে থেকেছি কিন্তু মানুষ টা দূরে থেকেও আমার যত্ন নিয়েছে।
— একটা কথা বলি? যদিও কথাটা কংকার মতো কুটনা মার্কা হবে।
আমি মৃদু হাসলাম।
— মুরগীর রান কিন্তু আমিও খাই না। পরিবারের বড়রা ছোটদের আদর করে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইজ করে। এতে আপন-পর বা আদর-অনাদর ইস্যু আসে না।
আপনার পরিবারের প্রতিটা মানুষ চমৎকার। তারা ভালোবাসতে জানে। আপনি নিজেকে মেলে ধরুন তবে তা অনুভব করতে পারবেন।
মনের মাঝে অভিমানী জলকণা পুষে রাখলে ঝলমলে দুপুরও ঝাপসা মনে হয় মইন ভাই।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
টয়া সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ চাপা শব্দে উহ্ বলে নীচে বসে পড়ে।
আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে?
ব্যথায় মুখ লাল হয়ে গেছে তবু বলে কিছু হয় নি। ইটের কোনায় পা লেগেছে একটু।
–ঠাণ্ডা পানির নীচে পা রাখলে ব্যথা কমবে। এসো এদিকে।
টয়ার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর হাত ধরে বাগানের কল ছেড়ে ওটার নীচে পা রাখতে বলি।
টয়া চুপ হয়ে আছে তবে মুখ এখনো কুঁচকে রেখেছে।
–বেশি ব্যথা হচ্ছে? বরফ দিবে? চলো, ঘরে চলো।
ওর পায়ের আঙ্গুলে হাত রাখতে গেলে টয়া ঝটপট পা সরিয়ে নেয়।
— না না, মইন ভাই আমি ঠিক আছি।
বোকার মতো কি করতে যাচ্ছিলাম ভেবে আমি লজ্জিত হই।
— সরি.. আমি আসলে…
— না না ভাইয়া, সরি বলছেন কেন? এতো অস্থির হবেন না। এমন অল্প ব্যথায় কাতর হওয়ার মেয়ে আমি নই। তাছাড়া এতো যত্ন পেয়েও আমি অভ্যস্ত নই।
আমি টয়ার দিকে তাকালে সে চোখ সরিয়ে নেয়। মুখে হাসি টেনে গলার জোর বাড়িয়ে বলে, আমি অনেক স্ট্রং মেয়ে তো তাই কেউ এতো অস্থির হয় না আমাকে নিয়ে।
— হুম তোমার জায়গায় মুমু হলে কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল করে ফেলতো।
— আর আপনি অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করতেন। মুমু আপনার যত্নশীলতার কথা আমাদের বলেছে।
— না ওরকম কিছু না। আসলে মুমুকে একটু বেশিই আদর করি হয়তো। দেখো না কেমন আহ্লাদী হয়ে গেছে।
–আহ্লাদী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আদর পায় বলেই তো আহ্লাদী।
এখন বেটার ফিল করছি ভাইয়া, আমি যাই।
— চলো তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাই।
— না না ভাইয়া আমি পারবো।
টয়া খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেলে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি বাগানের মাঝে।
আনমনে ভাবি কংকা সারাক্ষণ ছোট মাকে অপরাধী বানাতে চায় অন্যদিকে টয়া বার বার পারিবারিক বন্ধনের গভীরতা বোঝাতে চায়। মামার কাছে বড় হলেও টয়ার চিন্তাধারা কত পজেটিভ অথচ আমি কংকার এক কথায় আমার পরিবারকে নিয়ে কত না প্রশ্ন সাজালাম। কেন? তারা কেবল সৎ বলে?
আমার নিজের তো আপন কেউই নেই। বন্ধু বান্ধব নেই, কোনো মেয়ের প্রতি ভালোলাগাও নেই। কাউকে ভালোবাসবো, আমার একার সুখের সংসার হবে এমন চিন্তাও মাথায় নেই। তবে কী আমি বাবার স্বভাবই পেয়েছি? স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক!
এতোদিন ভাবতাম মুমু মাহিন তার মায়ের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছে সে ভালোবাসা আমি পাইনি।অনেক বেশি অবহেলিত আমি। আমাকে কোলে করে বা পাশে বসিয়ে কেউ কিছু শেখায়নি।
কিন্তু আজ নিজের কাছে নিজেকে খুব হীন মনে হচ্ছে। পরিবারের সাথে থাকছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি কিন্তু তারপরও নিজেকে অবহেলিত ভাবছি। অথচ পরিবারে আমার সিদ্ধান্ততে সব হয়।
কেন আমি নিজেকে পরিবারের অংশ ভাবতে পারি না? আমার মনে এতো অভিমান কার বিরুদ্ধে? নিরবে কাজ করে যাওয়া অসহায় ছোট মায়ের বিরুদ্ধে? যার কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছিল না। নাকি ছোট ভাই বোনগুলোর উপর যারা আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।
রাতে শোবার সময় টিভির শব্দ পাচ্ছিলাম। পানি খেতে বেরিয়ে দেখি টয়া আর লামিয়া টিভি দেখছে।
আমাকে দেখে টয়া ডেকে বলে ভাইয়া আসেন, আমাদের সাথে মুভি দেখেন।
— না থাক তোমরা দেখো।
— আহা আসেন তো।
মনে মনে ইচ্ছে যে একেবারে হচ্ছে না তা না। অপেক্ষায় ছিলাম টয়ার জোর দিয়ে বলার। হলোও তাই।
কিছুক্ষণেই লামিয়া হামি তুলতে তুলতে বিদায় নিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। টিভির সামনে রয়ে গেলাম আমি আর টয়া।
টয়ার পাশে বসে টিভি দেখা অস্বস্তিকর নয় তবুও আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রতিদিনের মতো ট্রাউজার ফতুয়া পরে আছে টয়া।
লম্বাচুলগুলো একপাশে ছড়িয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ আগে হয়তো গোসল করেছে। বার বার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছে। আমার চোখ বার বার ওর চুলে আটকে যাচ্ছে। অন্ধকার রুমে আধভেজা চুলে টিভির আলোয় টয়ার মুখটা অসম্ভব মায়াবী লাগছে।
কেমন হচ্ছে ব্যাপারটা? ভারী অন্যায়। টয়া টের পেলে খুবই লজ্জাজনক হবে। ভাববে একটু হেসে কি কথা বললাম ওমনি মুমুর ভাই প্রেমে পড়ে গেল!
ছি! মুমুর কাছেও লজ্জা পাবো আমি। ঝটপট দাঁড়িয়ে বলি, তুমি থাকো টয়া আমার ঘুম পেয়েছে।
টয়াকে রেখে রুমে চলে আসি।
সকালে নাস্তায় বসলে টয়া টেনে টেনে বলে, মইন ভাইয়ের জন্য স্পেশাল বুটের হালুয়া হচ্ছে না কেন?
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কংকা বুটের হালুয়া খাওয়াবে বলেছিল।
কংকা ভারী মুখে বলে, এতো রান্না একা হাতে সামলেও কাউকে সুনাম করতে দেখি না…
টয়া ফিক করে হেসে বলে, তোর রান্না এতো মজার ছিল যে সব চেটেপুটে খেতে গিয়ে সুনামের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জানিস আমার মন কি চায়? তুই সারাদিন এমন রান্না করবি আর করবি আর আমি বাইরে থেকে ঘুরে এসে আয়েশ করে পা নাচিয়ে নাচিয়ে খাবো আর খাবো। আহা…
ছোট মা বলল, কংকা, তোমার রান্না খুব ভালো হয়েছিল। দারুন রান্না পারো তুমি। তুমি মেহমান এখানে, ঘুরতে এসেছো তাই কর। আর রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না।
কংকা বলল, মইন ভাই তো আমাদের কোথাও নিলেন না।
আমি বললাম, দুপুরের পর সবাই তৈরী থেকো একটা রিসোর্টে নিয়ে যাবো।
দুপুরে ফিরে দেখি সব দরজা লাগিয়ে তৈরি হতে ব্যস্ত। মুমুটাই বরং সবার আগে রেডি। সবুজ শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছে মুমুকে। কি রে বাকি সব রেডি হয় নি?
–হয়েছে। ওরা মাকে রেডি করছে।
— মাহিন কি ঘরে?
–না। মাহিনের রুমে কংকা রেডি হচ্ছে। ও নিরিবিলি তৈরি হতে চায়। সবাই আজ তোমার দেয়া শাড়ি পরেছে।
দরজা খুলে লামিয়া বের হয়। গোলাপি শাড়িতে লামিয়াকে আরো মিষ্টি লাগছে। ভাইয়া সারপ্রাইজ আছে।
— তাই নাকি, কি?
আমি ভাবলাম টয়াকে শাড়ি পরা দেখবো এটাই সারপ্রাইজ বুঝি। কিন্তু না, টয়া মাকে সাথে করে বের হলো।
মা কামিজ ওড়না পরেছে। আমার সামনে লজ্জায় মরে যাচ্ছেন যেন।
টয়া বলল, ভাইয়া কেমন সারপ্রাইজ হলো? আন্টি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না। দেখেন আন্টিকে কত সুন্দর লাগছে।
আমি হা হয়ে ছোট মাকে দেখছি। সত্যি ছোট মায়ের বয়স কমে যেন অর্ধেক হয়ে গেছে।
ছোট মা লজ্জায় নত মুখে বললেন, এতো করে বললাম ছেলেটার দুদিন পর বিয়ে হবে এখন এসব মানায় না। ওরা শুনলই না।
আমি হেসে বললাম মাহিনের বিয়ের চিন্তা এখনই করছেন কেন? সে তো বাচ্চা ছেলে। তার আগে মুমুকে বিয়ে দেব।
ছোট মা আরো লজ্জা পেলেন যেন। হেসে বললেন, আমার বড় ছেলে রেখে ছোট ছেলের বিয়ে দেবো কেন?
টয়া বলল, আন্টি যুগ পাল্টেছে। এখন বউ শাশুড়ী কামিজ পরে একে অন্যের গলা ধরে মুভি দেখতে যায়। আপনিও যাবেন।
সব হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে গেলেও আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। ছোট মায়ের বড় ছেলে আমি, কথাটা মনের মাঝে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।
টয়া পেছন থেকে ডাকে, মইন ভাই!
আমি চমকে ওর দিকে তাকাই। ছোট মাকে অবাক চোখে দেখতে গিয়ে টয়াকে খেয়াল করিনি। টয়া ওর ফতুয়ার উপর কিভাবে যেন আঁচল উল্টো করে সামনে এনে শাড়ি পরেছে। পায়ে ক্যাডস, চুলগুলো দুই বেণী করা।
— আপনার দেয়া গিফটের মর্যাদাহানি করিনি তো?
— মোটেও না। তোমাকে সুন্দর লাগছে। বরং মুমুর মতো শাড়িতে তোমাকে বেমানান লাগতো।
— সত্যি বলছেন? আপনার খারাপ লাগছে না?
— না।
টয়ার চোখ দুটো কেন যেন হালকা দুলে ওঠলো। আমার মনের ভুলও হতে পারে।
বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেল টয়া।
মাহিনের রুম থেকে নীল শাড়ি পরে কংকা বের হয়। আমি একপলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেই। কংকাকে অবশ্যই সুন্দর লাগছে তবে তা দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। মন না টানলে কোনো সৌন্দর্য চোখে পড়ে না।
বেশি দূর না রিসোর্টটা। শহরের ভেতরেই। সবাইকে ইজিবাইকে উঠতে বলে আমি রিক্সায় বসি। ইচ্ছে করে বাইক নেই নি। টয়া যদি শাড়ি পরে আমার পেছনে ওভাবে পা ছড়িয়ে বসে ভয়ংকর হবে ব্যাপারটা। টয়াকে কিছু বলাও যাবে না।
রিক্সায় বসতেই চমকে উঠি যখন দেখি আমার পাশে কংকা বসেছে।
— কংকা তুমি?
শাড়ি ঠিক করতে করতে কংকা বলল, ওখানে জায়গা হচ্ছে না। তাই সবাই বলল আপনার সাথে বসতে।
আমি আর কিছু বললাম না। ভালো লাগছিল না। মনে মনে আমি টয়াকে আশা করেছিলাম।
শহরের ভেতর দিয়ে এগুতেই রিক্সা চালককে কংকা হঠাৎ উল্টো রাস্তায় যেতে বলল। আমি জিজ্ঞেস করায় বলল শহরটা একটু ঘুরে দেখি।
–কিন্তু এটা তো পরেও দেখা যাবে।
— বেশিক্ষণ না অল্প সময় ঘুরবো।
কংকা তোতাপাখির মতো বকবক করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ নিজের সুনাম।
আমার অস্বস্তি ও বিরক্তি দুটোই বাড়ছে। কংকার সাজগোজ চোখে পরার মতো। বিভিন্ন মোড় থেকে পরিচিতরা লম্বা সালাম দেয়া শুরু করেছে। অলরেডি দুবার কল এলো বিয়ে করেছি কিনা জিজ্ঞেস করে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। রিকশা চালককে ঘুরাতে বলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকলাম। খুব বাজে হলো ব্যাপারটা।
মুমুরা রিসোর্টের গেইটে অপেক্ষা করছিলো। তাদের দেখে নিজেকে কেমন দায়িত্বহীন মনে হল। সবার চেহারা মলিন হয়ে আছে।
মুমু বলল, এতো দেরী করলে ভাইয়া?
কংকা বলল, মইন ভাই আমাকে শহর ঘুরে দেখাচ্ছিল।
আমি সাথে সাথে টয়ার দিকে তাকাই। মোবাইলে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে টয়া।
সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে যে যার মতো ছড়িয়ে হাঁটতে থাকে। কংকা আমার সাথে সাথে হাঁটছিল। ওর ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগছে না। কেমন কথা ঘুরাতে জানে মেয়েটা?
কংকাকে সবার সাথে যেতে বলে আমি দূরে সরে আসি। একাই দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
মুমু এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। ইতস্তত করে বলে, ভাইয়া কংকা কিন্তু আমাদের বান্ধবী না, রুমমেট। আমরা আসবো প্ল্যান করায় ও আসতে চাইলো তাই মানা করতে পারি নি।
আমি তাকিয়ে থাকি মুমু কি বোঝাতে চাইছে তা বোঝার জন্য।
–কংকা অনেক সুন্দরী, অনেক গুণী ;কিন্তু ও…..
— তুই কি বোঝাতে চাইছিস খুলে বল।
মুমু আঙ্গুল ডলতে ডলতে বলে, তুমি কি কংকাকে পছন্দ করো? মানে ওকে …
— তোর কেন এমন মনে হচ্ছে?
— না মানে কংকা বলল…
— কি বলেছে কংকা?
— তুমি রিক্সা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলে। একটু আলাদা ঘুরতে চেয়েছিলে…
এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে ছিল এবার সপ্তমে চড়লো। শক্ত চোয়ালে বললাম তোর বান্ধবীর মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস আছে নাকি?
— আছে। প্রায়ই বলে।
— ওকে আমার সাথে বসতে কেন পাঠিয়েছিলি?
— আমরা পাঠাই নি। ও নিজে থেকেই গেছে।
— তুই যা এখান থেকে। ফালতু টেনশন নিবি না। আমি কাউকে পছন্দ করি না, বুঝলি?
আমি বিরক্ত মনে আনমনে হাঁটি।
টয়াও কি ভাবছে আমি কংকাকে নিয়ে আলাদা ঘুরতে গেছি?
টয়াকে একবারের জন্যেও একা পেলাম না। লামিয়ার সাথে যখন হাঁটছিল তখন এগিয়ে গেলাম। দুজনের উদ্দেশ্যে বললাম, কংকা তোমাদের কি বলেছে জানি না তবে ওকে নিয়ে আলাদা ঘুরার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
টয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে অন্যদিকে চেয়ে বলে, ব্যাপার না। সুন্দর মানুষদের সঙ্গ ভালো লাগতেই পারে।
খুব জরুরি কিছু দেখলো এমন ভান করে টয়া চট করে সরে গেল।
লামিয়া হেসে বলল, ভাইয়া এতো টেনশন করছেন কেন? একজনের ভালোলাগা থেকে অন্যজনেরও ভালোলাগা তৈরি হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে প্রেম হয়। প্রেম তো খারাপ কিছু না।
আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়ে মানুষের মাথায় এতো আবোলতাবোল ব্যাখা ঘুরে কেন?
টয়া কি অভিমান করেছে? কিন্তু কেন?
আমারই বা টয়াকে নিয়ে এতো ভাবাভাবির কি আছে?
চলবে…
ঝিনুক চৌধুরী