ঝাপসা দুপুর (পর্ব-১)

বাবা যেদিন দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তখন আমার বয়স আটের আশেপাশে। মা খুব সাধারণ জ্বরে হুট করেই মারা গিয়েছিল। আমার দেখাশোনার জন্য যে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন তা কিন্তু নয়। আট বছর বয়সেই আমি অনেক পরিপাটি ছেলে ছিলাম।

বিয়ের সময় ছোট মায়ের বয়সও খুব বেশি ছিল না। হয়তো উনিশ কি বিশ হবে। তিনি আমাকে অনাদর করে নি কিন্তু অতি আদরও করে নি। হয়তো আমার বয়সটা কোলে নিয়ে আদর করার মতো ছিলো না।

বাবার সংসারে খুব একটা ভালো ছিলো না আমার মা। ছোট মা যে খুব ভালো ছিল তাও নয়। বাবা কাউকে সম্মান করতে জানতেন না, স্বার্থপর মানুষ ছিলেন। আমার দুই মা ই নীরবে সংসার করে গেছে।

ছোট মায়ের সংসারে আমার দুটো ভাই বোন। আমার খুব আদরের। আমি আদর পাইনি তো কি হয়েছে আমার ভাই বোন কেন অনাদরে থাকবে?

পাঁচ জনের সংসারে আমরা তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বিপে বাস করতাম। বাবার দ্বীপ, ছোট মায়ের দ্বীপ, আমার দ্বীপ। মুমু আর মাহিন ছোট মা আর আমার দ্বীপে ঘুরে বেড়াতো।

বাবা যখন মারা যায় তখন আমি অনার্সের পাশাপাশি বাবার ব্যবসা অনেকটাই নিজের আয়ত্তে করে নিয়েছি। শহরে আমাদের একটা মার্কেট আছে। সেটার ভাড়া ছাড়াও আমাদের নিজেস্ব চা- পাতার ব্যবসা রয়েছে।

বললাম না বাবা স্বার্থপর মানুষ ছিলেন। তিনি একবারও চিন্তা করেন নি তার অবর্তমানে আমি যদি আমার সৎ মা আর ভাইবোনদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দেই তবে তাদের কি হবে।

বাবার কাছে ছোট মা বাসার কেয়ার টেকারের মতো ছিলো তবে বেতন বিহীন। আমাদের রান্নবান্না, মুমু মাহিনের পড়াশোনা ,ঘরবাড়ি দেখে রাখা এসব কাজ ছাড়া আর কোনো ভূমিকা তার ছিলো না। রান্নার বাজারও বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী হতো।

বড় হতে হতে আমার কাছেও ছোট মা কেবল কেয়ার টেকার রূপে আবর্তিত হয়। আমি যেহেতু আমার ভাইবোন দুটোকে ভালোবাসি তাই ওদের তাড়িয়ে দেয়ার কথা আমার মাথাতেও আসে নি। তবে ছোট মা সবসময় আতংকিত মুখ নিয়ে চলতো।

সবই কয়েকবছর আগের কথা। বাবার অবর্তমানে আমাদের মোটামুটি ভালই চলে যাচ্ছে দিন। মাহিন এখন ইন্টার দেবে আর মুমু ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স তৃতীয় বর্ষে।

কদিন হলো মুমু তার তিন বান্ধবীকে নিয়ে বাসায় এসেছে। আমাদের বাসাটা ছোট একটা টিলার উপর মৌলভিবাজার শহরে। যে কেউ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে চলে আসে। সবুজে ঘেরা কোলাহলমুক্ত বাসা আমাদের।

সেদিক থেকে মুমুর বান্ধবীরা পুরোবাড়ি যেন মাতিয়ে রেখেছে। মেয়েমানুষ মানেই সারাক্ষণ হৈচৈ, মাতামাতি। আমি সকালে বেরিয়ে পড়ি দোকানের উদ্দেশ্যে। দুপুরে আর রাতে একা বসে খাওয়া ছাড়া নিজের রুমেই আমার বসবাস। এভাবেই অভ্যস্থ আমি। আমার একমাত্র সঙ্গী বই। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের মাঝে মুখ গুজে রাখতাম বলে তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই।

আমার একা খেয়ে চলার অভ্যস্ততা যেন মুমুর বান্ধবীরা পাত্তাই দেয় না। সব মেয়েদের মাঝে যথেষ্ট অস্বস্তি নিয়ে খেতে বসতে হয় প্রতিদিন। ওদের চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দে এখন অবশ্য এতোটা অস্বস্তি আর হয় না।

মেয়ে বলতে আমি কেবল ছোট মা আর মুমুকে চিনি। আমার জগৎ নারী বিহীন। কলেজ লাইফেও কোনো মেয়েদের সাথে মিশি নি। মুখচোরা মানুষ আমি।

মুমুর বান্ধবীগুলোর সাথে আমি না মিশলেও তারা মিশতে বাধ্য করছে। তাদের সাবলীল কথাবার্তা আমারও মন্দ লাগছে না। তিন বান্ধুবী তিন স্বভাবের। টয়া মাথার চূরায় একটা খোপা করে আজুবা মার্কা আলখাল্লা পরে সারাক্ষণ ফোনে একে তাকে ধমকাতে থাকে। আমার উপরও জোর জবর চালায়। এটা খাবো, ওটা খাবো, জলদি খেতে আসেন, আমাদের সাথে মুভি দেখেন সবকিছুতেই তার অধিকার জড়ানো। লামিয়া একেবারের চুপচাপ। শুধু মিষ্টি করে হাসতে জানে। আর কংকা যে কিনা চোখে পড়ার মতো সুন্দরী সাথে গুণী মেয়ে। ঘরের কোনো না কোন কাজ করায় ব্যস্ত থাকে। আর আমার বোন মুমু আহ্লাদ করা ছাড়া আর কিছু পারে কিনা সন্দেহ।

আজ রাতে খাবার সময় কংকা খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। ছোট মা সবসময়ই আমার থেকে দূরে থাকেন। আমার প্লেটে মুরগির রান তুলে দিলে আমি হেসে বলি কংকা ওটা মাহিনকে দাও, ওর রান খুব প্রিয়।

কংকা বলল, মাহিন তো প্রতিদিনই খাচ্ছে দেখলাম, মুমুও নিজের পাতে তুলে নেয় আপনাকে তো কখনও খেতে দেখি না। কেন?
হঠাৎ এমন প্রশ্নের কি উত্তর দেবো আমি বুঝছিলাম না। শেষ কবে রান খেয়েছি আমার মনেও নেই। আমি শুধু জানি মুমু মাহিনের মুরগীর রান খুব প্রিয়।

কংকা আবার প্রশ্ন করলো, আপনার শখ করে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না? যা দেই তাই চুপচাপ খেয়ে ওঠেন কেন?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আমার মাথায় কখনো আসে নি। আমার কি সত্যিই কোন কিছুর শখ নেই? কেন? শখ পূরণ করার কেউ নেই বলে?

কংকা আমার কোনো উত্তর না পেয়ে ছোট মায়ের দিকে তাকায়।

কংকার সাথে আমার দৃষ্টিও ছোট মায়ের দিকে যায়। দেখি তিনি অপরাধী মুখে কাচুমাচু হয়ে আছেন।

কংকা আমার পাতে মুরগির রান দিয়ে বলে, নিজের অধিকার নিজেকে বুঝে নিতে হয়। নইলে সব পেয়ে বসে।

হঠাৎ ডাইনিংয়ে নিরবতা নামে। কংকা যা বোঝাতে চাইছে এখানে বসা সবাই তা বুঝতে পেরেছে। মুমু মাহিন মাথা নিচু করে খেয়ে ওঠে।

সে রাতে আমার ঘুম আসে না। পরিবারে আমার মূল্যায়ন কতটুকু মাথায় ঘুরতে থাকে। বর্তমানে এ পরিবারে আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অথচ আমি যেন পরিবারের সাথে সংযুক্ত নই। অনাহূত মেহমানের মতো।

মুমু মাহিন কী আমাকে ভালোবাসে কেবল তাদের সব আবদার পূরন করি বলে?

আমাকে নিয়ে কি তারা আদৌ কখনো ভাবে?

পানি খেতে রুম থেকে বের হলে দেখি ছোট মায়ের রুমে মুমু, টয়া আর লামিয়া বসে আড্ডা দিচ্ছে। টয়া যথারীতি মোবাইলে কাকে যেন আগামীকাল কি কি করনীয় মুখস্থ করাছে।

মুমু ছোট মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর লামিয়া ছোট মায়ের চুলে বিনুনি করে দিচ্ছে। কংকাকে কোথাও দেখলাম না। ছোট মায়ের প্রতি কংকার রুষ্টতা আজ স্পষ্ট ছিল।

ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে প্রতিদিনের মতো বাগানে হাঁটতে বের হই। লামিয়াকে দেখি মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসে।
–কি লামিয়া,আমাকে দেখে লাইন কেটে দিলে কেন? তুমি তোমার মতো কথা বল।
— না না ভাইয়া। এমনি কথা শেষ তাই।
কংকা এগিয়ে এসে বলে, মঈন ভাই নাস্তায় কি খাবেন?
— প্রতিদিন যা খাই তাই খাবো।
— না না আমি আপনার জন্য আজ স্পেশাল কিছু বানাবো। আপনি হালুয়া খান?
— তা খাই।
— কিসের হালুয়া খাবেন?
— যে কোনো একটা করলেই হবে।
— আহা, আপনার স্বাদ আহ্লাদ হীন জীবন দেখে খুব কষ্ট লাগে। আপনার জীবনে স্পেশাল কেউ চাই, যে শুধু আপনার খেয়াল রাখবে। বুঝলেন!

নাস্তার টেবিলে বসে দেখি টয়া ছোট মাকে আমাদের সাথে জোর করে বসিয়েছে।
ছোট মা অস্বস্তিবোধ করছেন।

কংকা বলল, আন্টির যখন অভ্যাস নেই কেন জোর করছিস?

টয়া বলল, অভ্যাস হতে সময় লাগে না। পরিবারের কর্তি কেন আলাদা খাবে? তোদের বাসায় কি এই রীতি?

কংকা গরম চোখে টয়ার দিকে তাকায়। আমার দিকে ফিরে বলে, ভাইয়া কেমন হয়েছে হালুয়া?
— হুম বেশ মজা।
— আরেকটু দেই?
— দাও।
— আপনার এতো প্রিয় অথচ মুমু জানেই না। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম তিনিও দেখি জানে না। কিন্তু মাহিনের কি প্রিয় সেটা ঠিকই জানে।

আমার চোখ সাথে সাথে ছোট মায়ের দিকে গেল। দেখলাম ছোট মায়ের মুখ লাল হয়ে গেছে। মুমুও বিব্রত বোধ করছে।

মুমুকে জিজ্ঞেস করলাম, মাহিন কোথায় রে?
— ভাইয়া, ও আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে।
— এতো সকালে?

কংকা কথার মাঝে বলল, আগামীকাল বুটের হালুয়া করে খাওয়াবো।

টয়া বলল, ভেরি গুড, ওয়েল ডান কংকা। এভাবেই আগুন জ্বালিয়ে যা। ভাইয়া চলেন আমি আপনার সাথে শহর ঘুরতে বেরুবো। আমার তো আর আগুন জ্বালানোর গুণ নেই কংকার মতো।

কংকা ফোঁস করে ওঠে। আগুন জ্বালানো মানে কি বোঝাচ্ছিস?
— মানে চুলোর কাজ তুই ভালোই পারিস। আমরা তো আনারী। ভাগ্যিস চুলার ধারে কাছে যাই না, নইলে এমন সুন্দর ছিমছাম বাড়িটায় আগুন লেগে যেত।

কংকা গজগজ করে বলল, তুই পারিসটা কি? পশু পাখি নিয়ে কি সংগঠন খুলেছিস। কাজের কাজ তো কিছু না সারাদিন শুধু একে ওকে দৌড়ের ওপর রাখিস।

টয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগ গোছোতে গোছাতে বলে, ওটাকে ম্যানেজম্যান্ট বলে ডিয়ার। আমি যাদের চালাই তারা বিনে পয়সায় শুধু মাত্র ভালোবেসে কাজ করে।

কংকা বাঁকা হেসে বলে, কুত্তা বিলাই এর প্রতি ভালোবাসা, হেহ্!

কংকার দিকে ঝুঁকে টয়া বলে, ভালোবাসতে জানি কংকা, সেটা মানুষ হোক আর পশু পাখি। অনেকেই আছে ভালেবাসার নাম করে মগজে সুক্ষভাবে বিষ ঢালতে ওস্তাদ হয়।

টয়া হনহন করে বেড়িয়ে গেল। যেতে যেতে বলে গেল আমি বাইরে অপেক্ষা করছি মইন ভাই।

কংকা ফোঁস করে চেয়ার সরিয়ে রুমে ঢুকে গেল।

আমি আক্কেল গুডুম হয়ে ডাইনিং এ বসে পুরো যুদ্ধটা দেখলাম। এছাড়া আমার কি বা করার ছিল। এসব মেয়েলি ঝগড়া দেখে আমি অভ্যস্ত নই। দু একটা বন্ধুর কাছে তাদের প্রেমের বা সংসারিক ঝগড়া শুনেছি তবে তা খুবই কিঞ্চিৎ। আমার অতি অনাগ্রহের কারণে ওরা আমাকে বলতেও চায় না।

ছোট মা উঠে গেলেন কংকাকে সামলাতে। মুমুকে মনে হলো বেশ অনিচ্ছায় উঠে গেল মায়ের পিছে পিছে।

লামিয়া হেসে বলল, অবাক হবেন না ভাইয়া। রুমে সবসময়ই কংকা আর টয়ার ঝগড়া চলে। আমরা দেখে অভ্যস্থ।
— তোমাদের সমস্যা হয় না?
— হলে থাকার এটা একটা মজা। ওখানে মানিয়ে নেয়া, মেনে চলা, প্রতিবাদ করা, সমঝোতা করা সব শেখা হয়ে যায়।

লামিয়া তার চিরাচরিত মিষ্টি হাসিটি দেয়।

লামিয়া মেয়েটা চুপচাপ হলেও বেশ বুদ্ধিমতী। সবকিছুর পজেটিভ ব্যাখা দাঁড় করায়।

মেইন দরজায় দাঁড়িয়ে টয়া বলে, মইন ভাই, আপনি কি আমাকে ভয় পান?
— না তো, কেন?
— তাহলে এতোক্ষণ হয়ে গেল আসছেন না কেন?

আমি ঝটপট দাঁড়িয়ে বলি, চলো।

আমার বাইকের পেছনে বসেছে টয়া। জিন্স ফতুয়া পরে দুপা ছড়িয়ে বসেছে। একটু অস্বস্থি হচ্ছে আমার। ছোট শহর। সবাই মোটামুটি চেনে আমাকে। কি না কি ভাববে তাছাড়া এমন পোশাকের মেয়ে আমার পেছনে বসা দেখে ভীমড়ি খাবে সব।

টয়া মোবাইলে যথারীতি দাঁত কিড়মিড় করে কাকে কি যেন বলছে। কল রেখে আমাকে বলে, ভাইয়া, আপনি প্রেম ভালোবাসা সাপোর্ট করেন?
— কি? বাইকের শো শো বাতাসে টয়ার কথা স্পষ্ট শুনতে পাই না।
টয়া গলা উচিয়ে বলে, আপনি প্রেম ভালোবাসা সাপোর্ট করেন?
— আমার সাপোর্ট করা না করা দিয়ে কি আসে যায়? তুমি কেন জানতে চাইছো?
— না মানে আমার বন্ধু তার গালফ্রেন্ডকে খুশি করতে গিয়ে আমার কাজ করেনি। এখন সরি সরি বলছে, শালা।
আমি মনে মনে হাসি।
— আপনি হাসছেন কেন?
— কই, নাতো!
— আমি মিরোরে আপনাকে দেখছি।

আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু তারপরও আমার হাসি পেয়ে যায়।
— ভাইয়া, আপনি ভাবছেন আমার মতো টমবয় মার্কা মেয়ে প্রেম ভালোবাসা কি বুঝবে, তাই না? মানি প্রেমে তেমন সুবিধা করতে পারিনি তবে আমি প্রেম বিরোধী নই মোটেও।

টয়ার কথার ধরনে আমি আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারি না। জোরে হেসে বলি সুবিধা করতে পারো নি মানে?

টয়া ভ্রু কুঁচকে মিররে আমার দিকে বিরক্তি চোখে তাকায়। বলে, ছেলেটা ভালোই ছিল। চুপচাপ মিশুক। আমি তাই একটু পাত্তা দিলাম। কিন্তু বেটা আমার বয়ফ্রেণ্ড কম বাপ বেশি হওয়ার চেষ্টা করলো। এভাবে কথা বল কেন, এমন পোষাক পর কেন, এদের সাথে মিশো কেন? আরে বাপ রে…. আমিও বলে দিয়েছি, চান্দু, তোমার পথে তুমি চল আমার পথে আমারে ছাড়ো। আলবিদা..
— আমি হো হো করে হেসে উঠি।

টয়া মিররে আমাকে সরু চোখে দেখে বলে, মইন ভাই আপনার হাসিটা কিন্তু চমৎকার, সবসময় এমন হাসিখুশি থাকতে পারেন না?
আনমনা হয়ে আমি ভাবি, শেষ কবে এমন হেসেছি?
— মইন ভাই, যাই ভাবেন না কেন আমি কিন্তু ওতোটাও ঝগড়াটে মেয়ে নই।
— আমার কিন্তু তোমাকে ঝগড়াটে মেয়ে মনে হয় নি। তুমি ভালো কে ভালো মন্দকে মন্দ বলতে জানো। তোমার মধ্যে লোক চালানোর ক্ষমতা আছে। আমাদের মুমুটা তোমার মতো হলে ভালোই হতো।
— হ্যাঁ, মুমুটা একটু আহ্লাদি কিন্তু ভালো মেয়ে। একেবারে সরল সোজা। চিন্তা নেই হাসনাত ভাই ওকে সামলে নেবে বলেই টয়া জ্বিব কাটে।

আমি মিররে ওর দিকে তাকাতেই সে পেছনে সরে যায়।

বাইক পাশে সাইড করে টয়ার দিকে ঘুরে তাকাতেই সে বলে, তেমন সিরিয়াস কিছু না,ভাইয়া। আপনি টেনশন নেবেন না। চলেন।
— আমার দোকান এখানে, তাই থেমেছি। মুমুর ব্যাপারটা আমি জানি। হাসনাতের পরিবারের খবর নিয়েছি। ভালো পরিবার।
টয়া অবাক চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বলে, আপনাকে যেমন ভেবেছিলাম আপনি তো তার চেয়েও ভালো মানুষ দেখছি।
— তাই। এতো অল্প কারণে আমি ভালো মানুষ?
— আপনি চুপচাপ থাকেন হয়তো সহজে মিশতে পারেন না কিন্তু সঙ্গ পছন্দ করেন। নইলে আমাদের মতো আধপাগল মেয়েদের সাথে বসে প্রতিদিন খেতেন না। আপনি যতটা গম্ভীর তারচেয়ে মনের দিক থেকে অনেক বেশি একা। নিজেই সে দেয়াল তৈরী করেছেন। তবে আপনি সংকীর্ণ মনের নন। আমার পোশাক বা আমার চলাবলায় আপনি এখনও কিছু বলেন নি।
— আমার সম্পর্কে এতোকিছু এনালাইসিস করে ফেলেছো?
— ভুল বলেছি কি?
— না। আমি আসলে একা বড় হয়েছি বলে তেমন মেশা হয়নি কারো সাথে কিংবা মন মতো বন্ধু পাই নি। তবে তোমরা অনেক মিশুক, তোমাদের সাথে মিশতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। হয়তো তোমরা মুমুর বন্ধু বলে। আর তোমার পোশাক সেটা একান্ত তোমার ব্যাপার। আমি কেন কিছু বলবো?
তবে আমি মুমুর ব্যাপারটা যে জানি তা মুমু বা ছোট মা যেন না জানে, ঠিক আছে?
— কেন? ওরা জানলে আপনার গাম্ভীর্যতা বজায় থাকবে না বলে?
— আমি মুমুর বড় ভাই। মুমু আমার সামনে লজ্জা পাবে।
— ঠিক আছে বলবো না। তবে এখানেও আপনি ভালো। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব নীরবে ঠিক পালন করছেন কিন্তু বড় ভাইগিরি আই মিন কোনো হম্বিতম্বি নেই আপনার।

আমি মৃদু হেসে বললাম আধ ঘণ্টার মতো একটা কাজ আছে আমার। তুমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারো কিংবা পাশের শপিংমল ঘুরে আসতে পারো।

টয়া বলল, আমি শপিং মলে যাই তাহলে।

কাজ সেরে আমার মনে পড়লো টয়ার নাম্বার তো আমার কাছে নেই। টয়াকে খুঁজে পাবো তো?
শপিং মলে ঢুকে এদিক সেদিক তাকাতেই টয়াকে পেয়ে যাই।
–ভাইয়া, কিছু টাকা ধার দেয়া যাবে? আমার তিনশো টাকার ঘাটতি পড়েছে।
— কি কিনবে?
— একটা ফতুয়া। বেশ সুন্দর।
— আচ্ছা চলো।
–ভাইয়া টাকা কিন্তু ধার দেবেন নইলে নেব না।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি দোকানে ঢুকতেই কর্মচারী দাঁত বের করে হাসলো।
— মইন ভাই, আপু আপনার সাথে আসছে?
— হুম, ওর ফতুয়াটা প্যাক করে দাও। সাথে আরও ফতুয়া দেখাও।
— আরো কেন ভাইয়া?
— তোমাদের সবাইকে গিফট করবো।
— আমি তো বললাম ধার নেবো টাকা।
— হ্যাঁ, তিনশো টাকা দিয়ে দিও। এখন যা দেবো সেটা গিফট।
— ঠিক আছে। কিন্তু লামিয়া আর কংকা তো ফতুয়া পরে না।
— তাহলে কামিজ দেই?
— ভাইয়া শাড়ি দেন সবাই পছন্দ করবে।
— তুমি পছন্দ করবে?
— আমি সবই পরি। আমাকে লুঙ্গি দিলেও দেখবেন নিজেস্ব স্টাইলে আমি ঠিকঠাক পরে নেবো।

চারটা মনিপুরী শাড়ি কিনলাম ভিন্ন রংয়ের। টয়াই ওদের পছন্দ মাফিক বাছাই করলো। ছোট মায়ের জন্যও একটা শাড়ি নিলাম।
কর্মচারীকে সব প্যাকেট করে আমার দোকানে পাঠিয়ে দিতে বলে টয়াকে জিজ্ঞেস করলাম দূরে ঘুরতে যাবে?
— অবশ্যই যাবো। ঘুরতেই তো এসেছি এ শহরে।
টয়াকে নিয়ে প্রথমে যে অস্বস্তি হচ্ছিল এখন আর তা হচ্ছে না। বরং টয়ার সঙ্গ ভালো লাগছে।
–ভাইয়া, এখন কোথায় যাচ্ছি?
–একটা সুন্দর জায়গা আছে শহরের বাইরে চা বাগানের দিকে। চারিদিকে নিরবতা শুধু অজস্র পাখির কিচিরমিচির। তুমি তো পশুপাখি প্রেমী, তোমার ভালো লাগবে।
বাইকে চলতে চলতে টয়া আফসোস করলো লামিয়াকে সাথে না আনায়।
লামিয়াকে তোমার বেশ পছন্দ, তাই না?
— হ্যাঁ, মুমুকেও পছন্দ করি।

মুমুর সরলতা সবাই পছন্দ করে আর লামিয়া হচ্ছে বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবাইকে বোঝে। আপনার কখনো মন খারাপ হলে লামিয়াকে কল করবেন দেখবেন কিভাবে মেয়েটা আপনার মন ভালো করে দেবে। কিন্তু ঝামেলা হলো ফাজিলটা প্রেম করছে আমাদের না জানিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে। সবাই ঘুমিয়ে থাকলে খুব ভোরে উঠে মোবাইলে কথা বলে। কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছেলেটা, কানাডা থাকে।
— ও হ্যাঁ, আমিও ওকে ভোরে কথা বলতে দেখেছি।
— তাই না? ওর প্রেম না থাকলে বলতাম আপনি ওকে বিয়ে করেন। মহা সুখী হবেন।
— কি যে বল না তুমি?
— জ্বি হা, আমি যাহা বলি একশোভাগ সঠিক বলি। আচ্ছা কংকার ব্যাপারে কিছু জানতে চান না?
–বিশেষ করে জানার আগ্রহ নেই।
— আহা! বেচারী কত সেবা করছে আপনার। কষ্ট করে আজ হালুয়া রেঁধে খাওয়ালো। মিনিমাম আগ্রহ না দেখালে তার প্রতি অবিচার হবে না?
আমি মিররে তাকিয়ে দেখলাম টয়া মুখ টিপে হাসছে। চোখে চোখ পড়তেই জিভ কেটে পিছিয়ে গেল।
–জিজ্ঞেস না করলেও আমি নিজ দায়িত্বে বলি। কংকা হচ্ছে রূপে গুণে অনন্যা, মেধাবী এবং সুশৃঙ্খল জীবনে মোড়ানো মূল্যবান কোহিনূর। আমার মতো চলায় বলায় বেখেয়ালি মেয়ের প্রতি তার ভীষন এলার্জি।
— তাহলে বন্ধু হলে কিভাবে?
— ও আসলে আমাদের রুমমেট। বন্ধু নয়। ওর বন্ধু হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার মতো অতি সাধারণ মেয়ের নেই।
টয়া হাসতে থাকে।
আমি কোনো কথা না বলে সামনে তাকাই।
— মইন ভাই, কংকা কিন্তু কারো সাথে প্রেম করে না। এসব ফালতু জিনিসে সে সময় নষ্ট করতে চায় না। সে নিরীহ ভদ্র চাচাছোলা পরিবারের ছেলে খুঁজছে বিয়ের জন্য….. আপনার মতো ছেলে।
আমি মিররে তাকালে টয়া যথারীতি জিব কেটে সরে যায়। আমি না শোনার ভান করি।
কিছুক্ষণ বাদে টয়া বলে, ভাইয়া একটা কথা বলি?
— বল।
— আপনাদের বাগানটা অনেক সুন্দর। সেখানে চকচক করা আর্টিফিশিল কিছু রাখলে বাগানের সৌন্দর্যহানী হবে। পুরো বাগান তার সজীবতা হারাবে।
আচ্ছা,আপনি বিয়ে করছেন না কেন? বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল কোনো রাজকুমারীর প্রতীক্ষা?
— না ওরকম কিছু না।
— শুনুন, আপনি যদি ভাবেন আন্টি আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করবে তবে ভুল করবেন। তিনি আপনাকে ভয় পায়। তবে আপনি যাকে বিয়ে করতে চাইবেন তিনি তাই মেনে নেবে। এমন স্বাধীনতা কোথায় পাবেন মইন ভাই?
তাই আর দেরী না করে জলদি জলদি পাত্রী বাছাই করে বিয়ে করে ফেলুন এ সপ্তাহের মধ্যে। সময় সীমিত। আমরা একটু বিয়ে টিয়ে খেয়ে যাই, কি বলেন?
টয়ার কথার ধরনে আমি স্বজরে হেসে উঠি।
— টয়া, তুমি আসলেই একটা পাগল।
টয়া মিররে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে।
— মইন ভাই, জীবনে পাগলদের সাথেও চলা উচিত। নইলে আপনি যে এমন প্রাণ খুলে হাসতে জানেন তা কী কখনো বুঝতে পারতেন?
আমি খানিক চমকে মিররে টয়ার দিকে তাকাই। দেখি দুহাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে টয়া সবুজ পাহাড়ের ঘ্রাণ নেয়ায় ব্যস্ত।

টয়াকে দুপুরে বাসায় নামিয়ে আমি দোকানে চলে যাই। রাতে ফিরে দেখি কংকা ড্রইংরুমের শোকেস গোচ্ছাচ্ছে। টয়া টিভি দেখছে।

আমাকে দেখে কংকা বলে, আপনার জন্য আজ স্পেশাল রান্না করেছি।

আমি রান্না ঘরের দিকে মাথা হেলিয়ে দেখি মুমু ও ছোট মা ঘেমে নেয়ে কাজ করছে।

আমার দৃষ্টি বুঝে কংকা সাথে সাথে বলে আমি সব করে এইমাত্র এসেছি। মুমু আর আন্টি তো কেবল ঢুকেছে।

টয়া ডাইনীর মতো খিক কিক করে হাসতে শুরু করে।

আমি ওর দিকে তাকালে বলে, সরি ভাইয়া, আমি টিভি দেখে হাসছি অন্য কিছুর জন্য নয়।

লামিয়া এগিয়ে এসে বলল, আপনার গিফট আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে ভাইয়া। আপনাকে ধন্যবাদ।

কংকা বলল, আপনার পছন্দ প্রশংসনীয়। গলা উচিয়ে বলল, এই মুমু দেখে যা শোকেস কেমন গুছিয়েছি!

আমি বললাম, খামাখা এসব কেন কষ্ট করছো কংকা?
–এলোমেলো জিনিস দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না। হাত নিশপিশ করে যতক্ষণ না এগুলো গোচ্ছাচ্ছি। খুব যে কষ্ট তা না, মুমু চাইলেই সব সুন্দর করে রাখতে পারে। খুবই অলস মুমু।
টয়া আবার ডাইনীর মতো খিক খিক হাসি দিল।
আমি খেয়াল করলাম দেয়ালে টাঙ্গানো মাহিনের মেডেলগুলো একটা বাটিতে জড়ো করে রাখা।
–মেডেল গুলো এখানে কেন?
— এগুলো দেখতে ভালো লাগছিল না। তাই নামিয়ে রেখেছি।
— ওগুলো যেভাবে ছিল ওভাবেই রাখো।
— কিন্তু ওখানে আপনার মায়ের ছবি রেখেছি। ওটা বেশি ভালো লাগছে না?
— না, আমার মায়ের ছবি আমার রুমেই থাকবে। মাহিনের মেডেলগুলো আগের জায়গাতেই থাকবে।
কংকার মুখ মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেল।
আমি নরম গলা বললাম, তুমি হয়তো কাজ করে টায়ার্ড হয়ে গেছ। রেস্ট নাও। টয়া, তুমি পারবে সব আগের মত করতে?
টয়া উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট দিয়ে বলে ইয়েস বস!
আমি রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। মুমুকে জিজ্ঞেস করলাম মাহিন কোথায়?
— ও বন্ধুর বাসায় পড়ছে।
— কখন ফিরবে?
— ওখানে খাওয়া শেষ করে আসবে।
–মাহিনকে কল করে বল এক্ষুনি আসতে। বাসায় ভালো রান্না রেখে বাইরে কেন খাবে? এক্ষনি আসতে বল।

বাসার পরিবেশ কেমন যেন বদলে গেছে। মুমু, ছোট মা, মাহিন মুখ কালো করে ঘুরছে সারাক্ষণ। বাসায় মেহমান অথচ পরিবারের সবার মুখ কালো।

রাতের খাবারে ডাইনিংয়ে বেশ কটা আইটেম দেখতে পেলাম। ছোট মাকে সাথে নিয়ে টয়া আর লামিয়া বসেছে। মাহিন মুমু পুরোই চুপচাপ। কংকা আমার পাশে বসে আমাকে বেড়ে দিচ্ছে। ওর আদিখ্যেতা আর ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু বলাও যাচ্ছে না।

আমার পাতে রোষ্টের রানের অংশ দিয়ে মাহিনকে বুকের অংশটুকু তুলে দিলো কংকা। মাহিন বাটি ভর্তি মাংসের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে খাওয়া শুরু করলো। বাটিতে আরো রান ছিল। কিন্তু মাহিন কিছু বললো না। আমি খেয়াল করেছি মুমুর বন্ধুগুলোকে এড়িয়ে চলছে মাহিন। বিশেষ করে কংকাকে।

মাহিনের প্লেটটি আমার কাছে এনে আমার প্লেটটি মাহিনকে এগিয়ে দেই আমি।

মাহিন অবাক চোখে তাকালে বলি তোর রান প্রিয় তুই বুকের মাংস কেন খাচ্ছিস?

মাহিন আড় চোখে ছোট মায়ের দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।

কংকা হেসে বলে, মাহিন কি এখনও ছোট বাচ্চা নাকি? সব কিছুই খাওয়া ওর শেখা উচিত, তাই না মাহিন!

আমি বিরক্তি কণ্ঠে বলি, মাহিন আমার কাছে এখনও বাচ্চা। আমার যতদিন সামর্থ থাকবে আমার ছোট ভাই-বোন মুরগীর রান ওদের পাতে পাবে।

সবাই নিরবে খেতে শুরু করলে খেয়াল করি ছোট মা কিছু খেতে পারছেন না। আড়ালে চোখের জল মুছে নিচ্ছেন।

আজ প্রথম মনে হলো পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে আমার আসলে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আমার সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

চলবে…