সকালে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে খেয়াল হয় চাবি আনতে ভুলে গেছি। বাইক ঘুরিয়ে আবার বাসায় ফিরি।
বাসায় এমন কিছু দেখবো আশা করিনি। মাহিন চিৎকার করছে কংকার সাথে।
— মেহমান হয়ে এসেছেন মেহমানের মতো থাকেন। খবরদার আম্মুর সাথে বাজে ব্যবহার করবেন না।
কংকা চেঁচিয়ে বলে, বড়দের সাথে কি করে কথা বলতে হয় জানো না? এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার মা?
— যা দিয়েছে আপনার পরিবারের চেয়ে ভালো শিক্ষা দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে যাই মাহিনের এমন বেয়াদবি দেখে। এগিয়ে যাই কষে একটা চড় মারতে। হঠাৎ লামিয়া আমার হাত টেনে ধরে। ওর দিকে তাকালে সে ইশারায় আমাকে থামতে বলে।
কংকা বলে, আমার পরিবার নিয়ে কথা বলো এতো বড় সাহস? নিজের ভাই হলে এতোক্ষণে থাপ্পর মেরে ঠিক করে দিতাম।
আমি আর চুপ থাকি না। চেচিয়ে বলি কি হচ্ছে মাহিন? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?
মাহিন আমার দিকে তাকালে ওর চোখে আমি ভিন্ন কিছু দেখতে পাই। সবসময়ের নিরীহ হাসিখুশি মাহিন যেন আজ অন্য কেউ।
— ভাইয়া আমরা তোমার সব টাকা লুটে খাচ্ছি? তোমার আমাদের পালতে কষ্ট হয় বললেই পারো, বাইরের মানুষের কাছে কেন বল?
আমি অবাক হয়ে বলি, কি যা তা বলছিস?
— ঠিক ই বলছি। সমুচা ভাজা দেখে আম্মুকে বলেছিলাম কয়েকটা বক্সে ভরে দিতে বন্ধুদের দেবো। কংকা আপুর হাতে বানানো জানলে জীবনেও চাইতাম না। আপু বলে আমি নাকি এভাবেই টাকা উড়াই।
কংকা বলে উঠলো, মিথ্যা কথা কেন বলছো মাহিন?
মাহিন কংকার দিকে না ফিরে আরো চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি তোমার টাকা কোথায় উড়িয়েছি ভাইয়া? কেন আম্মুকে কংকা আপু সুযোগ পেলেই কথা শোনায়? আম্মু তোমার সাথে কি ভেদাভেদ করেছে বলো তো?
ছোট মা হঠাৎ মাহিনের গালে চর মেরে বলে, চুপ থাক বেয়াদব। কখন থেকে তর্ক করে যাচ্ছিস?
— কেন চুপ থাকবো? আমরা সৎ বলে? ভাইয়া আমাদের বের করে দেবে বলে? করে দিক। আমি ছোট হতে পারি তবু আমার মায়ের অসম্মান আমি সহ্য করবো না। চলে যাবো তোমাদের নিয়ে।
কংকা ঝাঁঝিয়ে বলে, বাহ্ মাহিন, তুমি তো আচ্ছা গুটি চালো। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমি এসব কিছু বলি নি।
— ও তাই! আপনি সারাক্ষণ আম্মুকে ভাইয়ার সৎ মা ফিল করান না?
— মাহিন তুমি ভয়াবহ মিথ্যুক ছেলে। তুমি…
আমি কংকাকে থামিয়ে বলি, আমার ভাইকে আমি চিনি কংকা। আমার পরিবারকেও আমি চিনি। তুমি দয়া করে আমার পরিবারে অযথা নাক গলাতে এসো না। আমি কি খাই, খাই না, কি পাই,পাই না তা আমার ব্যাপার। তোমার মাথা ব্যথার দরকার নেই।
–আশ্চর্য মানুষ আপনারা? মাহিন বেয়াদবি করে যাচ্ছে আর আপনিও তাতে সায় দিচ্ছেন?
মাহিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ভাইয়া তুমি এমন মেয়েকে এ পরিবারের বউ করতে চাও যে কিনা বিয়ের আগেই পরিবার ভাঙ্গতে চায়।
— কি পাগলের মতো কথা বলছিস? আমি কংকাকে বিয়ে করতে চাই তোর মাথায় কেন এলো? এসব ফালতু কথা কেন ভাবছিস?
ওয়েট ওয়েট ওয়েট! কংকা হাত নেড়ে বলল, কে কাকে বিয়ে করবে? সবার কেন মনে হলো মইন ভাই আমাকে বিয়ে করতে চাইলেই আমি উনাকে বিয়ে করবো? একটু রান্নাবান্না, খাতিরদারি করেছি বলে সব আমাকে এ বাড়ির বউ ভাবতে শুরু করেছেন কেন? আসলেই ছোট শহরের মানুষদের মানসিকতা ছোট থাকে দেখছি!
আমি ঢাকায় বড় হওয়া মেয়ে এখানে এমন ছোট শহরে কেন আমার পরিবার বিয়ে দেবে? কি দেখে দেবে?
আজকাল নিজ শাশুড়ীকেই মানুষ সহ্য করে না সেখানে সৎ শাশুড়ী সৎ ভাইবোনের মাঝে কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে কি করে এডজাস্ট করবে শুনি?
তাছাড়া আমার বা…
লামিয়া কংকাকে টেনে রুমে নিয়ে যায়। কংকা রুমে ঢুকেও চেঁচাতে থাকে। মুমু বোকার মতো দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
আমি মাহিনের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। ভাইটা আমার হঠাৎ যেন বড় হয়ে গিয়েছে। আমাকে জড়িয়ে এখন আবার বাচ্চাদের মতো ভেউভেউ করে কাঁদছে।
মুমু পাশে এসে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, সরি ভাইয়া, আমি বুঝিনি কংকা এমন কিছু করবে। আম্মু কিছুই আমাকে জানায় নি।
আমি মাহিনের দিকে চেয়ে বলি, আর কোনদিন যেন না শুনি আমরা সৎ ভাইবোন। এ বাড়ি শুধু আমার বা তোর না। এ বাড়ি আমাদের সবার।
কংকা রুম থেকে বের হয় থমথমে মুখে, হাতে ব্যাগ।
লামিয়া বলে, আমি আর মুমু কংকাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি। ও চলে যাবে এখন।
আমার বিরক্তভাব কোনোভাবেই আড়াল করতে পারছি না। ভদ্রতার যথেষ্ট অপব্যবহার করছে এই মেয়ে। মুখ ফিরিয়েই বলি ঠিক আছে আমি দিয়ে আসছি।
মাহিন বলল, না ভাইয়া তুমি দোকানে যাও। আমি ফ্রি আছি। আমি বাসে তুলে দেবো। নইলে বড় শহরের মানুষ ভাববে আমরা দায়িত্বহীন।
নিঝুম রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে যেন। দিনের বেলা ব্যস্ততায় কাটলেও রাত যেন টুটি চেপে ধরে। টয়ার কথা বার বার মাথায় ঘুরে।
টয়াকে নিয়ে কি আমি একটু বেশি চিন্তা করছি? একটু হেসে ,একটু বন্ধুর বেশে নাহয় আমার সাথে দু চারদিন কথা বলেছে তাই বলে আমাকে এতো রিয়্যাক্ট করতে হবে কেন? কংকার বলা কথাটাই কি ঠিক? ছোট শহরের মানুষদের মানসিকতা ছোট। আমি হয়তো একটু বেশি কিছু ভেবে নিয়েছিলাম। টয়া হয়তো অনেক ভালো, যোগ্য পাত্র পেয়েছে তাই বিয়ে করছে।
যত যাই হিসেব মিলাই না কেন মনে শান্তি পাই না।ভালো লাগে না কিছু। এতো হাসফাঁস নিয়ে চলা মুশকিল। রুম ছেড়ে বাগানে হাঁটতে থাকি কিছুক্ষণ। ফিরে এসে রুমে ঢোকার পথে লামিয়া মৃদুলয়ে ডাক দেয়। টিভি ছেড়ে বসে আছে যেন আমার অপেক্ষায়।
–মইন ভাই, কথা ছিল।
— হুম, বলো।
— বসুন প্লিজ।
আমি পাশে বসলে লামিয়া বলে, বুকে এতো অভিমান নিয়ে চলা কি ঠিক?
আমি দ্বিধা চোখে তাকাই।
— ভাইয়া, বন্ধু মানে তার সাথে শুধু ভালো সময় কাটানো নয়। তার মনটাও ছুয়ে দেখতে হয়। বন্ধুর কষ্ট, আনন্দ, না বলা কথা সব বুঝে নিতে হয় চুপ করে।
— তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো, লামিয়া?
–যার সাথে রাত জেগে জেগে কথা বললেন তাকে একবার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা গেলো না?
আমি চমকে উঠি।
— আপনাকে সেদিন চা দিতে এসে শুনেছি এবং ওপাশে কে তাও বুঝেছি। আজ কংকার সাথে আমারও চলে যাওয়ার কথা ছিল। শুধু একটা কাজ রয়ে গেছে বলে যাই নি।
টয়ার ফটফট কথা শুনে সবাই ধারণা করে মনের সব কথা টয়া হয়তো অবলীলায় বলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বড্ড অভিমানী টয়া ঠিক আপনার মতো।
ওর মনের গহীনে কারো প্রবেশ নিষেধ। এমন কি আমিও প্রবেশ করতে পারি নি। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো সে দরজায় কড়া নেড়েছেন। কিন্তু আপনি তো সে চেষ্টাই করেন নি দেখছি।
আগামীকাল ভোরে চলে যাচ্ছি ভাইয়া। যাওয়ার আগে একটা কথা বলতে চাই, কিছু প্রত্যাশা করলে তাকে পাওয়ার স্পৃহা থাকতে হয়। এমন যেন না হয় অভিমানী হয়ে দুজনই একা রয়ে গেলেন নিজ মনের কুঠরীতে।
ভালো থাকবেন।
লামিয়া আজ ভোরে চলে গেছে। ওর বলা কথাগুলো থেমে থেমে মনের মাঝে বেজে উঠছে। টয়াকে তবুও ফোন করছি না।
অভিমানের কাছে মন যেন বন্ধক রেখেছি।
রাতের নির্জনতায় মনের আয়নায় নিজেকে কোথাও না কোথাও অপরাধী পাই। এতো কিসের অভিমান আমার? ভুলটা আমিই কি করছি না? একবার কল করতে ক্ষতি কী?
সকল দ্বিধা কাটিয়ে টয়াকে কল করি। ওপাশ থেকে নিষ্প্রাণ কণ্ঠ শুনতে পাই।
কি বলে কথা শুরু করবো বুঝি না।
দুজনই চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ।
–সেদিন আর কল দিলে না যে?
— আপনিও তো দেন নি ।
— শুনলাম তোমার আংটি বদল হয়েছে।
— হু
— আগে থেকেই ঠিক ছিল?
— না।
— তাহলে?
— ছেলে পিউকে আংটি পরাতে আসার কথা। কিন্তু পিউ সকাল থেকে বেঁকে বসলো বয়স্ক ছেলে বিয়ে করবে না। কোনোভাবেই রাজি করাতে না পেরে মামী আমাকে অনুরোধ করলেন বিয়ের জন্য। মামা বন্ধুকে আগেই কথা দিয়েছিলেন। পরিবারের ইজ্জত বাঁচাতে আমি রাজি হয়ে গেলাম।
— ইজ্জত বাঁচাতে রাজি হয়ে গেলে?
টয়া চুপ করে রইলো।
–তুমি এমনভাবে বিয়ে করতে চাও?
— আমি কিভাবে বিয়ে করতে চাই তা তো জানি না মইন ভাই। আমি শুধু জানি আমার নিজের কেউ নেই যার জন্য আমি বিয়েতে মানা করবো। কেউ নেই যে আমাকে ভালোবাসে, আমার অপেক্ষায় বসে আছে। তাহলে কেন, কি কারণে,কার জন্যে আমি মানা করবো?
— তারমানে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো?
টয়া মৃদু হেসে বলল, না করার কোনো কারণ আছে কি?
আমার বুকে কেমন ভোঁতা অনুভূতি হতে থাকে।
–ছেলে কি করে?
— ইটালি থাকে।
— ছেলের ছবি আছে? আমাকে দিও দেখবো তোমার হবু বরকে।
টয়া দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে বলে, আচ্ছা।
— রোজ বুঝি কথা হয়?
— হয় তবে পিউর সাথে।
— মানে?
— ছেলে বয়স্ক হলেও দেখতে হ্যান্ডসাম। মিষ্টি কথায় বেশ পটু। পিউর সাথে জমে গেছে। রোজ ফোনালাপ হয় তাদের।
— তাহলে আর সেদিন বেঁকে বসেছিল কেন?
— হয়তো পিউ এখন আফসোস করছে। অবাক হবো না যদি পিউ মত পাল্টায়।
— তোমার বিরক্ত লাগছে না ওর এমন আচরণে?
— নাহ্, স্বার্থপরতা দেখে আমি অভ্যস্ত।
আমি চুপ হয়ে রই কিন্তু মনের মাঝে কত কথা হাসফাঁস করছে যেন।
— এতোদিন পর আজ কি মনে করে ফোন করেছেন? অভিনন্দন জানাতে?
আমি বোবা হয়ে থাকি।
— অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করুন কথা।
— টয়া!….. আমাকে একবার বলতে পারতে। একটা কল দিতে পারতে।
টয়া হয়তো রেগে গেল। কাটকাট সুরে বলল, আমাকেই কেন কল করতে হবে মইন ভাই? কল করে কি বলতাম, আমাকে উদ্ধার করুন? কোনো লাভ হতো কি?
ধরে আসা কণ্ঠ আড়ালের চেষ্টা করে বলে, লামিয়াকে জানিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম আপনি হয়তো…. থাক বাদ দেন। রাখি মইনভাই। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
— না টয়া! কথা শেষ করো প্লিজ।
— আমার কোনো কথা নেই… ফোন রাখছি।
— টয়া থামো, প্লিজ। আমি… আমি… সরি। আমার আসলে কল করা উচিত ছিল। আমি ভুল করেছি। নিজের জন্য আমি আসলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জানি না। কি করে নিজের কিছু চাইতে হয় তাও জানা নেই আমার। একা বড় হয়েছি বলে অনেক কিছু শিখি নি। হয়তো..
— মইন ভাই, একা আমিও বড় হয়েছি। কিন্তু আপনার মতো নিজেকে একা ভাবি নি। আশেপাশের সবাইকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি তারা আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক। সত্যি কথা কি আপনি নিজেকে দুঃখী ভাবতে ভালোবাসেন। একা ছিলেন একাকীত্ব ই আপনার পছন্দ।
কিন্তু জানেন কি, আপনি আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান। আপনার মৃত মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত আপনি অভিযোগ, অনুযোগ করতে পারেন ।
আমার কথা ভাবুন। আমার আপন জনরা জীবিত থেকেও মৃত। তাদের কাছে আমার দুঃখের কোনো মূল্যই নেই। যাদের আমি মনেপ্রাণে পরিবার মানি তারা বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাকে আশ্রয় দিয়ে তারা ধন্য করেছে। যে ছেলে পিউর মতো সুন্দরী মেয়ের কল্পনা নিয়ে আসে অথচ আমাকে আংটি পরাতে বাধ্য হয় সে কি আর খুশি? ওর মুখ দেখে যে কেউ স্পষ্ট বুঝতে পারবে। কিন্তু আমি বুঝলেও কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমি আশ্রিতা! এমন সোনার টুকরো পাত্র পিউ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে সেটাই তো আমার সৌভাগ্য। তবে কাল যদি পিউ মত বদলায় তবে আমাকে হাসিমুখে তা মেনে নিতে হবে। কারণ পাত্র তো পিউর জন্যই ছিল।
পরিবারকে অনেক ভালোবাসি তাই হয়তো বার বার আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়।
যাই হোক, অনেক কিছু বলে ফেললাম। আমাকে আর কল দেবেন না। আজ কল করে এমনিতেও আপনি দায়মুক্তি পেলেন। নিশ্চিত মনে ঘুমোতে যান। ভালো থাকবেন।
টয়া লাইন কেটে দিলে আমি মোবাইল কানে ধরেই বসে থাকি। মাথা যেন কাজ করছে না। কেমন বোবাকান্না পাচ্ছে। এতোটা অসহায় আমি কখনো কি হয়েছি? মন কি চাচ্ছে, আমি কি চাচ্ছি কিছুই বুঝছি না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সেটাও যে শিখিনি। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথচ চোখ দুটো মরুভূমির উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
মোবাইলে ছবি আসে। টয়ার পাশে একজন পুরুষ বসা।
বুকের ভেতরে চলা নিঃশব্দ প্রলয় হঠাৎ যেন থেমে যায়। টয়ার পাশে বসা মানুষটি আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে রয়।
একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমি চেয়ে থাকি কাজল কালো নত চোখজোড়ার দিকে। হাতে সবুজ রেশমি চুড়ি, কপালের সবুজ গোল টিপ উঁকি দিচ্ছে সোনালী শাড়ির ঘোমটার ভেতর থেকে।
আমি মন ভরে দেখতে থাকি অভিমানী মেয়েটিকে। যত দেখি বুকের ভেতর কেবল শূন্যতা অনুভব করি। অস্থিরতা বাড়ে তবু চোখ সরাই না। চোখের আড়াল হলেই যেন আমাকে একা করে হারিয়ে যাবে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙে কাচের চুড়ির শব্দে। আমার পাশে কে যেন শুয়ে আছে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। কে শুয়ে আছে ঝাপসা চোখে বুঝতে পারছি না। হাত বাড়িয়ে দিলে আঙ্গুলের ডগায় নরম গালের অনুভূতি টের পাই। কে মেয়েটি?
শরীর থেকে সোনালী রোদের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। কিন্তু চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
মেয়েটির কাছে এগিয়ে যাই। যতটা কাছে গেলে ঠোঁট ছোঁয়া যায়। আস্তে আস্তে মেয়েটির অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘন কাজল কালো চোখ। কপালে সবুজ গোল টিপ। গায়ে সোনালী শাড়ি জড়ানো।
আমার দিকে চেয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, কি, এতো দেরী হলো আমাকে চিনতে?
টয়া!
আমি চমকে উঠি।
আমি সত্যিই চমকে উঠি। ঘুম ভেঙে চারিদিকে তাকাই।ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে সাথে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। স্বপ্নে টয়া ছিল!
আমার পাশে? আমার মনে?
টয়া! কিভাবে হতে দিচ্ছি ? সব বুঝেও কেন অবুঝ হচ্ছি? কিছু পেতে হলে তাকে চাইতে হয়! কিছু প্রত্যাশা করলে তাকে পাওয়ার স্পৃহা থাকতে হয়। আমি কেন একবারের জন্যেও হাত বাড়াই নি?
অস্থির মনে বিছানা ছাড়ি। তৈরী হয়ে রুম থেকে বের হলে ছোট মা পেছন থেকে ডাকেন, মইন!
আমি চমকে তাকাই।
— কি হয়েছে মইন? এতো ভোরে কোথায় যাচ্ছো?
আমি চুপ করে থাকায় ছোট মা মলিন মুখে নিজ রুমের দিকে পা বাঁড়ান। পেছন থেকে ডাক দেই আমি।
— ছোট মা, একটা কথা ছিল।
— বলো!
— আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি এ পরিবারের কর্তি। তাই আপনার মতামত চাইছি।
ছোট মা আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকেন।
–আপনার বড় ছেলের বউ যদি জিন্স ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়ায় আপনার তাতে সমস্যা আছে?
— তোমার সমস্যা না থাকলে আমার কেন হবে?
— বউ যদি আমার বাইকের পেছনে দুদিকে পা ছড়িয়ে বসে? কুকুর বিড়াল এনে ঘর ভরে ফেলে কিংবা….
— কিংবা মোবাইলে একে তাকে শাসায় কিংবা রাত জেগে তোমার সাথে কথা বলে তাও আমার কোনো সমস্যা নেই মইন। তোমার পছন্দ ই আমার, আমাদের সবার পছন্দ।
আমি গলা নামিয়ে বলি, ছোট মা আমি আজ ঢাকা যাচ্ছি টয়ার কাছে।
— দেরী করে ফেললে না?
— হয়তো, হয়তো বা না। ভাগ্য ভালো থাকলে টয়া আমার বউ হবে মা।
ছোট মা হয়তো মা ডাক শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কেঁপে ওঠে আমার দিকে তাকান। কাছে এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, মায়ের দোয়া রইলো।
দু’জনই একে অপরের দিকে খানিক সময় তাকিয়ে রই। দীর্ঘদিন পাশাপাশি থেকেও যে বন্ধনটিকে উপেক্ষা করে এসেছি আজ যেন তার গভীরতা অনুভব করি।
মা আমাকে বললেন, তোমার মায়ের একটা সোনার হার আমার কাছে আছে। সেটা টয়ার জন্য সাথে করে নিয়ে যাও।
— না মা, আপনার ছেলের বউ হয়ে এলে আপনিই তাকে নিজে হাতে পরিয়ে দেবেন।
ঝুম বৃষ্টিতে বন্ধ দোকানের টিনের ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে আছি। ভোর থেকে মুসলধারে বৃষ্টিতে আবহাওয়া একবারে শীতল হয়ে আছে। ভেজা শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে। সাথে করে ছাতা অন্তত আনা উচিত ছিল। গাজীপুরের এ গলির ভেতরের সব দোকানই প্রায় বন্ধ। এমন মুষলধারে বৃষ্টিতে নিতান্ত কাজ ছাড়া সবাই কাথামুড়ি দিয়েই শুয়ে থাকবে।
টয়াকে কল করছি, ধরছে না। বেশ কয়েকবার কল দেয়ার পর নিজেই ব্যাক করলো।
— টয়া!
— বলুন মইন ভাই!
— একটু বাইরে আসতে পারবে?
— মানে?
— মানে তোমাদের গলির সামনে রহমত স্টোরে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
— মানে?
— মানে সব দোকান বন্ধ। আমি ভিজে চুপচুপে হয়ে আছি। খুব ঠাণ্ডা লাগছে।
— মানে কি?
— আর বোঝাতে পারবো না। তুমি কি আসতে পারবে?
— আ.. আমি আসছি। এখনি আসছি।
— শোনো!
— কি?
— সাথে ছাতা এনো, অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
— আচ্ছা।
— শোনো!
- কি?
— রাস্তায় পানি জমে গেছে। সাবধানে এসো।
— ইস! থামেন তো। আপনি বেশি কথা বলেন।
বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি।
বৃষ্টির ঝুমঝুম ছন্দের মাঝে তাল কেটে ছপাৎ ছপাৎ শব্দে এগিয়ে আসছে কেউ। হয়তো টয়া!
আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস টানছে। ছুটে এসেছে বোধহয়। সাথে ছাতা আনে নি। কাকভেজা হয়ে গেছে পুরো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে নির্ঘাত।
অবাক চোখে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
— আপনি… আপনি কেন এসেছেন?
— আসা ঠিক হয় নি ?
— না না তা বলি নি। কিন্তু এভাবে হঠাৎ?
হাত বাড়িয়ে টয়াকে আমার পাশে দাঁড় করাই। বৃষ্টির ঝাপটায় টয়া থরথর করে কাঁপছে। আমিও কাঁপছি।
–কিছু বলছেন না যে?
আমি চেয়েই থাকি। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। থাক না কিছু সময় এভাবেই থমকে।
— আপনি কি এতোদূর শুধু আমাকে দেখতে এসেছেন?
— হুম।
টয়া হতাশ হয়।
–দেখা শেষ এবার চলে যান।
–তুমি চাও আমি চলে যাই?
–আমাকে জিজ্ঞেস করে তো আসেন নি। আমার চাওয়া কেন জিজ্ঞেস করছেন? থাকেন আপনি বৃষ্টিতে একা দাঁড়িয়ে।
টয়া চলে যেতে নিলে আমি ওর হাত টেনে কাছে নিয়ে আসি।
— আশ্চর্য! আমি এতোদূর এলাম আর তুমি চলে যাচ্ছো?
— তো কী করবো? সব আপনার ইচ্ছেতে হবে?
আমি কল করবো, আমি ব্যাখা দেবো, আমি দুঃখের সাগরে ডুবে যাবো, আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাবো আর আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন কিন্তু কিছু বলবেন না। কোনো দায়িত্ব নেবেন না।
কেন এসেছেন আপনি? যান এখান থেকে।
দুহাতে ধরে কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারছি না টয়াকে। বার বার ছিটকে চলে যেতে চাচ্ছে।
–থামো না প্লিজ, এতো ছটফট কেন করছো? সরি বলছি।
— কিসের সরি?
— সেটা বলতেই তো এসেছি।
— কিছুই তো বলছেন না।
টয়াকে কাছে টেনে ঝাঁকিয়ে বলি, এই মেয়ে, স্থির হও এবং মনোযোগ দিয়ে শোনো। কেউ একজন তোমাকে খুব পছন্দ করে, প্রচণ্ড ভালোবাসে! তোমার মামা- মামীকে এ কথা বলতে পারবে?
টয়া কিছু বলতে গিয়েও পারে না। কেবল ঠোঁট নড়ে ওঠে।
— আমি ইতালির মতো জমকালো রঙিন দেশে থাকি না। খুব ছোট শহরে, সাধারণ পরিবারের সাধারণ ছেলে আমি। ব্যবসা করি, ইনকাম মন্দ নয়। দেখতে মোটামুটি পর্যায়ের তবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে জানি না। তোমাকে সানন্দে বিয়ে করতে চাই। এক আকাশ সমান ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি কি তা গ্রহণ করবে?
টয়া চেয়ে আছে। বৃষ্টির পানি টয়ার কপাল বেয়ে গাল গড়িয়ে পড়ছে। সাথে চোখের নোনাজল মিশে যাচ্ছে।
— বলো টয়া? আমাকে বিয়ে করবে?
— করবো। কিন্তু…..
— কিন্তু কী?
–আমি যে রান্না পারি না। খুব ভোরে ঘুমও ভাঙ্গে না আমার, শাড়ি পরতে মোটেও ভাল লাগে না, আর…
আমি হেসে বলি আমি মনের সঙ্গী চাই, শাড়ি চুড়ি পরা প্রতিমা নয়।
ঝুম বৃষ্টির মাঝে ঝাপসা দুপুরে নির্জন গলিতে একা দাঁড়িয়ে আছি দুজন।
নতমুখে কাঁদছে টয়া। শরীর কেঁপে উঠছে অবাধ্য কান্নায়।
টয়ার গালে দুহাত রেখে বলি, ভালোবাসার কথা অধিকার নিয়ে বলতে দেরী করে ফেলেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, নিজেও কষ্টে জ্বলেছি।
আমার বুকে মুখ লুকায় টয়া।
— আপনি সবকিছু এতো দেরীতে বোঝেন কেন?
— সরি বলছি তো।
— সরিতে কি সব কষ্ট মুছে যায়?
–কি করতে হবে বলো?
–আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন?
শীতল বাতাসের দাপটে ভালেবাসার উষ্ণ আলিঙ্গন হয়তো আমারও প্রয়োজন ছিল।
সমাপ্ত
ঝিনুক চৌধুরী