ইনফিওরিটি কমপ্লেক্স।
আনোয়ার হাকিম।
ক.
নীরার সাথে প্রথম দেখা এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে। সে উপস্থাপিকা, আর আমি সময় কাটানোর দর্শক-শ্রোতা। বিষয়ঃ বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতা। আলোচক অনেক। যুক্তিতর্কের রকমারি কাটাকুটিও চমকপ্রদ। কিন্তু আমার দৃষ্টি নীরার দিকে। ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠালামঃ কিছু বলতে চাই- একজন পড়ুয়া হিসেবে। নীরা যেন কী দেখলো! সুযোগও দিল। আমি বিজয় গর্বে উদ্দীপিত সৈনিকের মত মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিতর্কিত হবার বাসনার চেয়ে নীরার দৃষ্টি আকর্ষণের আকাংখা পেয়ে বসলো। হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানের মত বলে গেলাম অনেক কিছু। বললাম যাদেরকে আমরা বাংলা সাহিত্যের দিকপাল বলে জানি বা মনে করে থাকি তারা আসলে কেউই আধুনিক ছিলেন না।ব্যক্তিগত জীবনে তো নয়ই লেখাতেও না। মনে হলো হলের মধ্যে যেন বোমা ফাটিয়ে দিয়েছি। তাই মঞ্চে উপবিষ্ট ভারি লেন্সধারী মফস্বলের বাংলা বিশারদরা ঘাড় কাত করে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন। কেউ কেউ চিড়িয়া জ্ঞানে আমাকে ডায়াসে উঠার পারমিশন কে দিয়েছে সেরুপ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উশখুশ করতে থাকলেন। দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে প্রাথমিক ক্ষীণ উত্তেজনা। নীরার মুখ রক্তিম। যেন সাজানো ড্রয়িংরুম তছনছ করে দিয়েছি আমি। বললাম, এই যে মধ্যবিত্ত আর সাধারণের শরৎ বাবুর কথাই ধরুন। তিনিও কি আধুনিক হতে পেরেছেন? শ্রীকান্ত রাজলক্ষীর প্রণয় নিয়ে জাত পাতের ভেদ ভাঙ্গতে না পেরে অযথা শ্রীকান্ত উপন্যাসটিকে চার পর্ব ঘুরিয়েছেন। প্রণয় লীলা দেখিয়েছেন,পাবলিক কাঁদানো হৃদয় চেড়া কাহিনী ফেঁদেছেন। তবু রাজলক্ষীকে শ্রীকান্তের হাতে তুলে দেওয়ার সাহসটুকু পাননি। আবার হা হুতাশ করে বলেছেন, “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলিয়া দেয়”। আরো দেখুন, দেবদাসের সাথে পার্বতীর গাঁটছড়াও বাঁধাতে পারেননি। এই যদি হয় নমস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে আমি অন্তত আধুনিক বলতে পারিনা। তারচেয়ে আরো ইন্টারেস্টিং হলো রবি বাবুর কায়কারবার। জমিদার নন্দন রবি বাবু লেখায় রেখায় যথেষ্ট আধুনিক কাহিনী ফাঁদলেও শেষতক যে লাউ সেই কদুই। “শেষের কবিতা” উপন্যাসে দেখুন। অমিত লাবণ্যের প্রণয়কে আধুনিকতার সকল রেকর্ড ভঙ্গকারীর মত করে উপস্থাপন করার পরেও তাদের হাতের মিলন ঘটিয়ে দিতে পারেননি। “হঠাৎ একদিন” কবিতার কথাই ধরুণ। পেরেছেন কি তাঁর প্রণয়ীকে কাছে ধরে রাখতে? পারেননি। উল্টো কাব্য করে বলেছেন, “আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী”? নিজেই প্রণয়ীনির মুখ দিয়ে দার্শনিক বাণী শুনিয়েছেন,
“রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। দেখলাম হাউজের অবস্থা ক্রমশঃ ভারি হয়ে উঠছে। অপেক্ষাকৃত তরুনরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে সাবাস সাবাস পটকা ফোটাচ্ছে। অন্যদিকে বিদগ্ধ সুধীদের মধ্যে চুতরা পাতার চুলকানি শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় রণে ভঙ্গ দেওয়াই নিরাপদ ভেবে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম অনেকটা স্টান্ট মারার ভঙ্গিতে। যেন আরো অনেক কিছু বলার ছিল। আরো অনেক কিছু তুলে ধরার ছিল। কেবল সময়ের কারণেই হলো না। এক শ্রেণীর তরুণের প্রচন্ড করতালি পেলাম। কেউ কেউ উচ্চকন্ঠে চালিয়ে যেতেও বললো। আমি আসনে বসে নীরার দিকে চেয়ে থাকলাম। নীরা কি আমার উপর রাগ করেছে? চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল। মনটা চনমনে হয়ে উঠলো তার সাথে পরিচিত হতে। অনুষ্ঠান শেষে সবার নিষ্ক্রমণের পালা। হলরুম ফাঁকা প্রায়। ইচ্ছেকৃত কালক্ষেপণ করলাম। সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামার সময় নীরার কন্ঠ, “এক্সকিউজ মি”। আমার কানে তা ইকো হতে থাকলো। আমার বোধ তা গ্রহণও করলো ধীর লয়ে।
— যা বললেন, তার সবটাই কি বিশ্বাস করেন? নীরার প্রশ্ন।
–বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন না, এ হচ্ছে যুক্তির কথা। আমার উত্তর।
–বলুন তর্কের কথা। সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস পড়েছেন নিশ্চয়?
–কেন বলুন তো?
–মানুষের বিতর্কিত হওয়ার কত ইচ্ছে- তাইনা? নীরা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত। নীরাই নিরবতা ভাঙ্গলো, “কোথায় থাকেন”?
–সার্কিট হাউজ
–নিশ্চয় আমলা?
–কেন? এলার্জি?
–কিছুটা। আচ্ছা, চলি।
যাবার সময় আগামী অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানালো। আগামী সপ্তাহে, এই দিনে, এই সময়ে। আমি যেন টেক্কার ট্রয় হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম। বুকের ভেতর বসন্তের ফিনফিনে হাওয়া হৃদপিন্ডের প্যান্ডুলামটায় মিষ্টি পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেল। আমি কি প্রথম ইনিংসে এগিয়ে গেলাম?
খ.
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুঃ সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাঃ প্রেক্ষাপট রাজনীতি। নীরা আমার নাম ঘোষণার অনুমতি চাইলো। আমি করজোড়ে বারণ করলাম। নীরা যেন কী অর্থ করলো তার। একবার তাকালো। আমি তার অর্থ বুঝে উঠতে পারলামনা। অনুষ্ঠান শেষে আবারো আলাপ। সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নীরার সংলাপ,” আজ তর্কে নামলেন না যে”?
–বিতর্কিত হতে চাইনা বলে
–আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিলেন?
–নাহ। ভুল স্বীকার করে নিলাম।
নীরা যেন কিছুটা হোচট খেলো। আশ্চর্যবোধক চিহ্নের মত খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আপনার সাথে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন”।
–কোন বিষয়ে?
— সাহিত্য।
— ও বিষয়ে আমার পড়াশোনা খুব কম
–বিনয় দেখাচ্ছেন?
–নাহ। নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিচ্ছি। নীরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
গ.
অনেকদিন নীরার সাথে দেখা নেই। অফিসের কাজে উপজেলা টু উপজেলা ঘুরছিলাম। বিকেলে আর্ট কলেজের গ্যালারিতে দেখা। নবীন শিল্পীদের আর্ট এক্সিবিশন চলছে। চোখাচোখি হতেই নীরার কন্ঠ,”বহুদিন দেখা নেই। কী ব্যাপার?
–ব্যস্ত ছিলাম।
–ও তাইতো। আমলাদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা
–খোঁটা দিচ্ছেন?
–মোটেই না।
–তাহলে?
–দেখলাম সহজেই রেগে যান কিনা?
–কি দেখলেন?
–ইগোতে লেগেছে মনে হলো
–তাই নাকি?
–হ্যা,ওটাই তো আমলাদের সম্বল। নীরা যেন মৃদু হাসলো।
নীরার সাথে এভাবেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বিতর্কিত হয়েছি। আবার বিতর্কিত হয়েছি বলেই তো তার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি। তবু, কেন জানি শূন্যতা বোধ হয়। একদিন বলেই ফেলি,
” আজকাল কেমন যেন লাগে”?
–কেমন?
— ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত
–কোন প্রবলেম?
— নানা চিন্তা
–যেমন?
–থাক।
–সেই চিন্তার মধ্যে আমিও আছি নাকি?
–হুম্ম।
–খুব খারাপ লক্ষ্মণ তো
–হেয়ালি করছো?
–মোটেই না। নীরা হাসতে থাকে। ওর হাসি কাঁচ কাটা হীরার মত খচ খচ টানে হৃদয়ের প্যান্ডুলামটাকে রক্তাক্ত করে। কোথায় যেন সব জট পাকিয়ে গেছে। অথচ নীরা তা বোঝেনা। শুধুই হাসে। বলে,”আপনার কপালে অনেক দুঃখ আছে”। আমিও তেমনটা আঁচ করি। আপনি থেকে তুমিতে কিভাবে যে নেমে এলাম নিজেও জানিনা। আমি কি দ্বিতীয় ইনিংসে পিছিয়ে পড়ছি?
ঘ.
সময় এভাবেই গড়িয়ে চলে। আর নীরার দহন জ্বালা পোড়াতে থাকে। তাই নানা উছিলায় স্টেডিয়ামের পাশের কফি শপে সন্তর্পণে চলে আড্ডার নামে আলাপ। আলাপের নামে উষ্ণ সাহচর্য। সাহচর্য মানে সান্নিধ্য। কফি খেতে খেতে এতসব ভাবছি। কিছুক্ষণ পর নীরা এলো। বেশ গম্ভীর। বেশি কথা না বলে গাড়ীতে ওঠার ইশারা করলো। অনুগত সহচরের মত গিয়ে বসলাম। ড্রাইভিং সিটে নীরা। আমি পেছনের সীটে। নীরা অবাক হলো। কপাল কুঁচকে বললো,” আমি কি আপনার ড্রাইভার?”
আমি হতচকিত হয়ে বলেই ফেললাম,”কেন”। “আপনার মাথা। এভাবে কথা বলা যায়?”
“তো” আমি বোকার মত বলে ফেললাম। “সামনে বসুন” বলে বা হাত দিয়ে ইশারা করলো। আমি কিছুটা লাজে, কিছুটা ‘পাছে লোকে কি বলবে’ গোছের আড়ষ্টতা নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। পারফিউমের গন্ধে গাড়ী মৌ মৌ। এ গন্ধ কার সেন্টের আর নীরার পারফিউমের। গাড়ী ছুটে চলেছে পতেঙ্গার দিকে। নীরা গম্ভীর। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,”কাল সারারাত অনেক চিন্তা করে দেখলাম। সব কিছু আপনাকে জানানো প্রয়োজন”। আমি ঔৎসুক্য নিয়ে শুনতে থাকলাম তার অকথিত কথামালা। অল্পদিনের জানাশোনাতেই ভালোবেসে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছিল সে। কিন্তু সে ভালোবাসা ছ’মাসও টিকেনি। একদিন সকালে ভালোবাসার সাজানো সংসার দু’পায়ে ঠেলে চলে গিয়েছিলো তার ভালোবাসার প্রাণ পুরুষ। সেও ছিলো এক আমলা। খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলো সে। নীরার ভালোবাসাই তাকে সাহসী করে তুলেছিল। কিন্তু সব সময় এক ধরণের কমপ্লেক্সে ভুগত সে। নীরার বাবার প্রাচুর্য আর পারিবারিক আধুনিকতার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি কখনোই। সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও হার মানে নীরা। একসময় আসে চূড়ান্ত ক্ষণ। নীরা পাড়ি জমায় কানাডায়। ওর বড় বোনের কাছে। সেখানেই তূলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। বছরে দু’মাস কাটিয়ে আসে লন্ডনে। বড় ভাইয়ের কাছে।
নীরা খানিকটা থামলো। গলা ধরে এসেছে তার। বা হাতে ক্যাসেটটা অন করে দিলো। কি যেন ইংলিশ মেলোডি বাজছে তাতে। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। বুকের ভেতরটায় ফায়ার ব্রিগেডের পাগলা ঘন্টাধ্বনি অনবরত বেজে চলেছে। যেন হৃদয় জুড়ে আগুন লেগেছে। নীরার দুঃখের সাথী হতে ইচ্ছে করছে। অথচ নীরা অনড়। ওর দুঃখ একান্তই ওর।
ঙ.
তিন মাসের ট্রেনিং শেষে কর্মস্থলে এসে দেখি টেবিলের উপর দু’টো চিঠি। একটা বদলীর। ভেদরগঞ্জ উপজেলায়। আর অন্যটা নীরার। তারিখ অনুযায়ী নীরা এখন লন্ডনে। ওখানে থেকে এরপর কানাডায়। আর আমি? এখান থেকে ভেদরগঞ্জ। হয়ত কিছুদিন পর সেখান থেকে অন্য কোথাও, অন্য কোন উপজেলায়। নীরার কক্ষপথের ব্যাপ্তি কত বড়! কত সমৃদ্ধ! আর আমার? পরিভ্রমণের বলয় ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। আমার কেবলই সেই পরাজিত মুখটার কথা মনে পড়ছে। যে নীরার মত সুন্দরীর অধিকারী হয়েও পরাজয়কে মেনে নিয়েছে সানন্দ চিত্তে। অন্যদিকে নীরার গ্লেয়ারিং এন্ড গ্লিটারিং মুখটাও অনবরত ভেসে উঠছে চোখের পর্দায়।
শীতের রাত। দরোজা, জানালা সব বন্ধ। তবু যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। জানালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে এক পশলা হিম শীতল বাতাস সমস্ত শরীরে ঠান্ডার পরশ দিয়ে গেল। বাইরে ঘোর অমাবস্যা। শুন শান নিরবতা। হৃদয়ে ক্ষরণজনিত অস্থিরতা। অথচ নীরার মুখোমুখি হয়ে ফরোয়ার্ড মার্চ করার সাহসও হয়না। এ এক অসহনীয় অবস্থা। এরই নাম কি ইনফিওরিটি কম্পলেক্স?
(রচনাকাল ১৯৮৯)