সবাই নিশ্চুপ,হাঁ করা মুখ! দৃষ্টি পূর্ব দিগন্তে নিবদ্ধ।
আমাদের চাক্ষুষ ধারাবিবরণী প্রসারণের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছেন সুরজিৎ।
অন্ধকার ছিন্ন করে আলো আঁধারি পরিবেশ, মেঘের উপর অংশে হালকা আলোর রেখা, বজ্রপাত দেখার মতো বা অন্য কিছু, বলে ঠিক বোঝান মুশকিল। মুখ হাঁ থাকায় সবার মুখে গপ গপিয়ে কুয়াশা ঢুকছে। চোখ স্থির রেখে পরবর্তী বল অনুসরণ । রঙের ভেলকি খেলা আরম্ভ, হালকা লাল মিশ্রণে স্বর্ণালী আভায় আউট সুইং দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষ। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে রং পাল্টাচ্ছে। এখন কিছুটা লাল কমে সোনালী। মেঘ গুলোর উপর সোনালীর সাথে খানিক সাদা ও কালো সংমিশ্রণে মায়াময় অবগুণ্ঠন। সদ্য বিবাহিত মেয়ে তার ঘোমটা ধীরে ধীরে লজ্জা কাটিয়ে তুলে ধরার মতো। পূর্ব দিগন্ত আরো রঙে ভরে উঠেছে, নিজ চোখে না দেখলে আমার লেন্সে পুরোমাঠ তুলে ধরতে পারছিনা। পরের ওভারের প্রথম বল। বাউন্সারে আকাশ ফেটে ব্যাটস্ ম্যান এর কপাল দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
তার রেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষে গিয়ে পরেছে। বন্ধু মাথা ফাটুক আর যাই ফাটুক, বল বাউন্ডারি ডিঙিয়ে ছয়। শীর্ষের লালের সাথে হলুদ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন ড্রিংকসে অরেঞ্জ জুস পরিবেশন। ধীরলয়ে রশ্মি ছিটকে আকাশ কেও রঙে ভরিয়ে দিচ্ছে,যেন বলে বলে চার আর ছয়। সূর্য দেবতা সূর্যবংশী মহলের মাথা থেকে উঁকি দিচ্ছেন। কি অভূতপূর্ব পরিবেশ। চারি ধারের দর্শক হাততালি ও চেঁচামেচিতে মাঠ ভরিয়ে দিয়েছেন। সামনের গাছপালা একটু একটু করে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হঠাৎ একটি বাউন্সার ও বিরাট ছক্কা এবং সূর্য গপ করে উপরে উঠে এলো। সারা আকাশ এখন লাল,আকাশি, সাদা ও কালো রঙে মুড়ে গেছে। এখন লাস্ট ওভারের শেষ বল নিয়ে বোলার তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে, দেখতে অনেকটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভি.বি. হোল্ডার এর মতো। বল করেছেন এবং সেট ব্যাটস্ ম্যান আউট। আকাশ এখন ঝকঝক করছে। লোক বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়েছে। সানরাইজার্সকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন মধুবাবু।
স্যারের কর্কশের সাথে কোকিল আওয়াজ মেশান গলার শব্দ- , কিরে কেমন দেখলি? আমি প্রতিবছর আসি কিন্তু প্রত্যেকবার নতুন বউয়ের মত লাগে। আমি স্যারের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলাম- এমন বউ পেলে আমি প্রতি বছর বিয়ে করতে রাজি আছি। স্যার খেঁকিয়ে বলেন, বেড়ে পালোয়ান হয়েছিস একটাকে সামলে দেখ আগে।
সবাই চেঁচামেচি করতে করতে জীপের দিকে চললাম।সত্যি কথা বলতে কি আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্শ স্পিচ লেস ছিলাম। আমাদের কাজ ছবি তোলা আর কুয়াশা খাওয়া ছাড়া এক দেড় ঘণ্টা কোন কিছু বলার ছিলো না।
এবার নামার পালা। গাড়ি সোজা দার্জিলিং ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে থামলো। নেবে এক বিহারীর দোকানে পুরি ও ঘুগনি ,মিষ্টি সহযোগে চা গলাদ্ধকরণ । এবার হেঁটে হোটেল।
খানিক বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে ধোপদুরস্ত হওয়া। একটু পরে মধুবাবুর ডাক, সবাই হলরুমে জড়ো হয়ে দাঁড়ালাম। স্যার বলে ওঠেন বয়েজ এখন আমরা নেমে যাব শিলিগুড়ি ,আর তোদের ফেরা কাল। কেন স্যার? কোনো ভুল ,আরে না না, আজকের পুরো দিন তোরা আনন্দ করে ঘুরে বেড়া। কাল দুপুরের খাওয়া সেরে বাস ধরবি। আর শোন হোটেলের টাকা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে,কাল ১২টার আগে হোটেল ছেড়ে খাওয়া খেয়ে বাসে উঠবি। আর সুবীর তোর হাতে আজকের মধ্যাহ্ন,রাতের,বিকেলের,কাল সকালের টিফিন, লাঞ্চের আর বাস ভাড়া বাবদ যা খরচা তুই রাখ। দেখে রাখবি স্কুলের চিন্তা রাখবি, দায়িত্ব তোদের থাকলো। সব বুঝিয়ে স্যাররা বেরিয়ে গেলেন।
আমাদের বাদ দিয়ে ছোট রাউন্ড টেবিল মিটিং করে ছেলেরা জানিয়ে দিল কাল সকালে টিফিন সেরে ওরা বাস ধরবে, কেন রে কোন অসুবিধা? না না ,আর তো কিছু করার নেই তাই। এখন থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাকি যা আছে দেখা হয়ে যাবে। ঠিক আছে তোরা যা ভালো মনে করিস। আমারা কিন্তু বিকেলে নামবো। তোরা এখন ছোট দলে বেরিয়ে পর । কেনো তোরা কি করবি? দেখি কি করা যায়। এক দু বোতল ভাল্লুক আর মুড হলে এক পেগ ও.টি.। অরিজিৎ তুই একটা গ্রুপ নিয়ে ঘুরে আয় আর গৌতম তোরাও যেতে পারিস বা অরিজিৎ এর সাথে। আমরা একসাথে বেরবো। জিজ্ঞেস করি ফিরে একসাথে খাবি, না কি রাস্তায় খেয়ে নিবি। ফেরার পথে খেয়ে নেব বলে দেয় অরিজিৎ। সুবীর ওদের লাঞ্চ,ডিনার টিফিনের টাকা দিয়ে দিল, সুশান্ত বলে ওঠে কাল সকালের টিফিন আর বাসের টিকিটের টাকাটা দিয়ে দে আমরা মুক্ত। সুবীর ওদের হাতে টাকা বুঝিয়ে দেয়।
আমরা রুমে গিয়ে একটু নাচানাচি করে বেরোলাম। চল আবার সিমলা হোটেলে গিয়ে বসি। পৌঁছে তিন বোতল গোল্ডেন ঈগল বিয়ার অর্ডার করলো সুবীর। ধীরলয়ে প্রথম রাউন্ড শেষ। আওর দো বোতল দেনা। কিরে সুবীর মাসির কাছ থেকে কত ম্যানেজ করেছিস, আরে টুনটুনি শীল ওরা সকালে চলে যাবেনা! লাঞ্চের পয়সাটা! আমাদের পুঁজি বাড়বাড়ন্ত । বুঝতে কষ্ট হলো না ও কেন কন্ট্রাক্টার সুবোধ কুন্ডুর ছেলে।শালা হিসাবটা ভালো বোঝে। এক পেগ করে ও.টি. দো। দুপুরের খাবার এখানেই সেরে ফেলি কি বলিস শীল? শীল বেশ তাড়িয়ে বলে ওঠে, মন্দ নয় প্রস্তাব টা। সুশান্ত বলে বসে আমি ভাই রুটি আর চিলি ফাকসা(শুয়রের মাংস) খাবো।সবাই একমত। সমীর বায়না ধরে আর একটা পেগ চাই।ঘমকে চুপ করান হলো। রাতে আবার খাবোনা, তখন আধ পেগ এক্সট্রা দেব। তা বেশ, তা বেশ। খাওয়া সেরে টাকা পয়সা মিটিয়ে, মাল রোডে যাত্রা।
আমরা এখন পুরো ধুনকিতে।আমরা হাসি ঠাট্টা করতে করতে নেপালি মেয়ে দেখে চোখ সেকছি।ওদের খবর নেওয়া উচিৎ একটু। সুবীর গালি দিয়ে বলল একটু কেন পুরোটা নে। শান্তি করে মেয়ে দেখ সব নেশা নেমে যাবে,সন্ধ্যা আসর জমবে। সুশান্ত বলে ওঠে ,শীল বেশ রঙিন লাগছেনা , শীল ফোকলা দাঁত দেখিয়ে খিক খিক করে হেসে বলে ওঠে চলনা এক দুটো মেয়ে ফাঁসাতে চেষ্টা করি। স্যাররা তো নেই চিন্তা জিরো। বাদবাকি বালছাল কোথায় মরছে মরুক গিয়ে। বুঝতে বাকি নেই শীল এখন ফুলটুস।
এখন আমরা মাল রোডে বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছি ও সিগারেট ফুঁকছি। হঠাৎ দেখি মহেশ,প্রদীপ আর মহেন্দ্র। তিনজনই মাড়োয়ারি আর আমার ছোট বেলার স্কুল সঙ্গি। আমি ও মহেশ ছিলাম প্রথম ও দ্বিতীয় বয়। খুব কম্পিটিশন ছিল দু’জনের আবার খুব ভালো বন্ধুও। দুর ছাই আবার অন্য দিকে চললাম যে। জানা ছিল ওরা দার্জিলিং- এ পড়াশোনার জন্য আছে। বাবলু তু ইধার( আমার ডাক নাম) । সবটা জানালাম। ওঁরা আমাদের বলে চল আমাদের ভাড়া বাড়িতে থাকবি। চুটিয়ে আড্ডা আর ফুর্তি করা যাবে।চল এখন আমাদের ঘরে। এত জনের থাকার জায়গায় হবে। মহেশ চল তোদের বাড়িটা দেখে আসি। আগামী কাল সকালে চলে আসবো। আমাদের মধ্যে দু’জন বলে ওঠে আমরা কাল সকালে নেমে যাব। মহেশ বলে ওঠে, ফিরতো কোই প্রবলেম নেহি রহা।
ওঁরা রুমে রয়ে গেল, আর বলে দিল সকাল ৮ টার মধ্যে পৌঁছে যাস। কাল থেকে ৭-১০দিন আমাদের সাথে থাকবি আমাদের গেস্ট হয়ে। খালি মস্তি আওর মস্তি। হোটেলে ঢুকতেই ম্যানেজার বলে ওঠে,আপ লোগোকা সাথী শিলিগুড়ি চলা গয়া। শালারা আমাদের চে বড় ধান্দা বাজ। তোরা দুজন কাল সকালে বেড়িয়ে যাস আর আমরা দিন সাতেক পরে ফিরবো। বাড়িতে খবর দিস।মাল ও চাখনা নিয়েই এসেছিলাম। আমাদের ফুর্তি নন্ স্টপ চলবে। সমীর মন ভরে টেনে নিস বড়ো বোতল এনেছি।