মারুফ আর রুবেল দুজনে ছোটবেলার বন্ধু, খুব মিল দুজনের… রুবেলটা বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি,কোন রকম টেনেটুনে এস.এস. সি পরীক্ষা দিয়েছিলো কিন্তু রেজাল্ট ফেইল, যাই হোক তারপর থেকে বাবার মুদির দোকানেই বসছে, বিয়ে থা করে সংসারীও হয়েছে, অপরদিকে মারুফ খুব ভালো ছাত্র না হলেও ডিগ্রী পাশ করেছে, পাশাপাশি বাবার ইটের ব্যাবসাটাও দেখছে, মাস্টার্সটাও কমপ্লিট করার চিন্তাভাবনা করছে….
দুজনের অবস্থানে ভিন্নতা আসলেও বন্ধুত্বে মোটেও ভাটা পড়েনি…
এরই মধ্যে মারুফের বিয়ে ঠিক হলো, মেয়ে প্রাইমারীর টিচার, বেশ ভালো ফ্যামিলি, দেখতেও বেশ সুন্দর…..
বিয়েটা হয়েই গেলো মারুফের, বিয়েতে অনেক হৈ হুল্লোড় হলো… রুবেলও ভিষণ খুশি বন্ধুর বিয়েতে।।
এখন প্রতিদিন তার দোকান এর সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে মারুফ তার বউকে স্কুলে পৌছে দেয়… রুবেল এর মনটা এবার খচখচ্ করে, এত ভালো বন্ধুত্ব ওদের দুজনের কিন্তু এবার বুঝি আর তাদের বন্ধুত্বটা টিকবে না…
সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট বউ মারুফের, সে আর পাত্তাই দিবেনা রুবেল কে…
মনটা বিষিয়ে আছে রুবেল এর…
ওর বউটা অল্পশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে, বয়সও বেশি না, এক বাচ্চার মা হয়েছে, খুব চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে, রুবেল এর কখনোই মনে হয়নি কোন কারণে সে অসুখী… কিন্তু হঠাৎ এখন তার মনে হতে লাগলো তার বউটা কোনো কাজের না….
রুবেল এর মনের বিষবাষ্প আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো… মারুফ এর বউকে দেখলে তার বুকের ভিতর কেমন ছ্যাত করে উঠে..
এদিকে ওর ভাবনার মতো কিছুই হয়নি, ওদের বন্ধুত্বে কোন ফাটল ধরেনি তখনও, মারুফের বউ দীপা বেশ মিশুক খুব সম্মান করে রুবেল কে… কিন্তু রুবেল এর মনেতো শান্তি নেই…
মারুফ এর বাসায় একদিন আড্ডা দেয়ার সময় রুবেল এর সামনেই দীপা মারুফ কে বলছে.. এই শোন একটু শহরে যাবো, কিছু কেনাকাটা আছে… কখন নিয়ে যাবে…
মারুফ বলে আজ পারবো না তোমার ছুটির দিনে দেখা যাক… দীপা কিছু বললো না।
দুই বন্ধু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নদীর পাড় ধরে হটছিলো… নীরবতা ভেঙ্গে রুবেলই বলে শহরে কি কেনাকাটা করতে যাবি….
আর বলিস না, স্কুলে একের পর এক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে, বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ শাড়ি, চুড়ি লাগে, এইযে সামনে কি এক দিবস তার জন্য কেনাকাটা…….
রুবেল উৎসাহ পেয়ে যায়, সে বলে তাইতো,তুইতো ভালোই ঝামেলার মধ্যে আসিছ দোস্ত…. আমার বউটা সহজ সরল গ্রামের মেয়ে, এইসব ঝামেলার মধ্যেই নাই বলে হো হো করে হেসে উঠে…. আর মেয়ে মানুষ এত সাজগোজ কেনরে ভাই…!
আচ্ছা দোস্ত তুই ভালো করে খোজ খবর নিয়েছিস তো… বেশি শিক্ষিত মেয়েরা আবার….. এত সাজগোজ তো খারাপ মেয়েমানুষরা করে, বলে আবার হো হো করে হাসি….
দোস্ত কিছু মনে করিস না…. মজা করলাম…
মারুফ ও হাসে আরে না না কি মনে করবো…!
সেইদিনের পর থেকে মারুফ এর মনে রুবেল এর কথা বাজতে থাকে.. যদিও সে দীপাকে বুঝতে দেয়না…দীপা শুক্রবার মারুফ কে বলে আজ বিকেলে তাহলে যাচ্ছি শহরে.. মারুফ মুখ কালো করে বলে এত ম্যাচিং করে সাজগোজ না করলে হয়না!! এত সাজো কেন তুমি!! মানুষে নানা কথা বলে! আর স্কুলে কার জন্য এতো সাজগোজ!!
দীপা আকাশ থেকে পড়ে, একি ব্যাবহার মারুফ এর!! যে কিনা প্রথম দেখায় তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো!!
তুমি এসব কি বলছো মারুফ!! তুমিতো জানোই আমি সাজতে, টিপটপ থাকতে পছন্দ করি। তাছাড়া একটা বিশেষ দিন শুধু আমি না সব টিচার একই রকম করে সাজবো… মারুফ আর কথা বাড়ায় না… বলে বিকেলে রেডি থেকো…. দীপা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মারুফের চলে যাওয়ার দিকে…
এদিকে রুবেল এর মনে শান্তি নেই, তার বিষ কোনো কাজ করছে না….
মারুফ আর দীপা ভালোই আছে!! তারতো কিছু ভালো লাগছেনা …..
রুবেল হঠাৎ একদিন মারুফকে ফোন দিয়ে জানায় কিরে তুই কই…?
কেন ইট ভাটায় ব্যাস্ত আছি দোস্ত, কি বলবি বল!
না বলছিলাম যে তোদের বাসার সামনে একটা পালসার হোন্ডা দেখলাম, কেউ আসছে নাকি…
জানিনাতো দোস্ত, হইতে পারে, দীপার শরীরটা ভালো না সে ছুটি নিসে, তার বাবার বাড়ি থেকে কেউ আসছে মনে হয়…
রুবেল জমাতে পারেনা কথা… মনটা বিষিয়ে থাকে… বাসায় এসে তার বউয়ের সাথে হম্বিতম্বি করে দুপুরের খাবার দেয়ার জন্য….
মারুফ বাসায় ফিরে দুপুরের পর, দীপাকে জিজ্ঞেস করে কেউ এসেছিলো কিনা তার বাবার বাড়ি থেকে… দীপা বলে না কেউ আসেনি, ভাইয়া আসবে ভাবিসহ সন্ধ্যার পর, মারুফ কিছু বলেনা কিন্তু মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করে বিঁধে….. মুখে কিছু বলেনা কিন্তু দীপার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা… মুখ ভার করে বেড়ায়… দীপা মারুফের পরিবর্তন টের পায় কিন্তু সে কারণ খুজে পায়না…. সে জিজ্ঞেস করলে কোন সদুত্তর পায়না… অনেক প্রশ্ন জমতে থাকে দীপার মনে…
মারুফ কদিন ধরেই দীপাকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টায় ব্যাস্ত থাকে… একা কোথাও যেতে চাইলে দেয়না…. দীপা আঁচ করে কিন্তু কিছু বলেনা…..
এরই মধ্যে একদিন আবার রুবেল মারুফকে বলে বসে কিরে তোর বউরে শহরে দেখলাম গত বুধবার… তুই যাস নাই….!
মারুফ কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা, বলে তাই নাকি!!
হ্যা দেখলাম মার্কেটে ঘুরতেছে!!
মারুফ সেদিন খুব তারাতাড়ি বাসায় ফিরে শুয়ে থাকে….
দীপা স্কুল থেকে ফিরে খুব অবাক হয়, কি ব্যাপার তোমার শরীর খারাপ!! শুয়ে আছো যে এই অবেলায়!!
মারুফ উঠে বসে, দীপার হাত ধরে টেনে খাটে বসায়…. দীপা অবাক হয়…
মারুফ বলে, বুধবারে কোথায় গিয়েছিলে…?
বুধবার!! কোথাও নাতো…
তুমি শহরে গিয়েছিলে?
নাতো…শহরে তো তোমার সাথেই যাই, কেনো কি হয়েছে বলতো….!!
কিছু না, “দীপা” প্লিজ তুমি আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ো না… আমাকে কষ্ট দিতে চাইলে একবারেই দাও, আমি তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকতে চাইনা…. আমি আর পারছিনা… দীপা…
দীপা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে তুমি কেন এধরনের কথা বলছো…. আমি তোমাকে কেন কষ্ট দেবো… আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মারুফ…. কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো, আমার মনে হচ্ছে তোমাকে কেউ কিছু বলছে … যে কিনা তোমার আমার ভালো চায়না… বলো কে সে! আমি তাকে দেখতে চাই! মারুফ প্লিজ আমাকে কষ্ট দিয়োনা আর তুমি নিজেও এভাবে কষ্ট পুষে রেখোনা…..
মারুফ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দীপাকে, দীপা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মারুফের বুকে মুখ গুঁজে…. মারুফের চোখেও জল কিছুটা অভিমান আর কিছুটা সুখের…
সেদিন সন্ধ্যায় অনেক বৃষ্টি হলো, বেশ দমকা হাওয়ার সাথে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা…
মারুফ আর দীপার মনের প্রশান্তি ছড়িয়ে গিয়েছিলো প্রকৃতিতেও…. বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গলো দুজনের… বাসার পাশেই কিসের যেনো হট্টগোল!!
তারাতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো দুজন….
লোকজন থানা পুলিশ ভরে গেছে বন্ধু রুবেল এর বাসায়… যা শুনলো তা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না মারুফ আর দীপা…..
রুবেল এর সহজ সরল গ্রাম্য বধু তার দুবাইপ্রবাসী ফুপাতো ভাইয়ের হাত ধরে পালিয়েছে… আড়াই বছরের বাচ্চাটাকে ফেলে…….
রুবেল এর ঘরে গিয়ে দেখে ও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে….. মারুফ ওকে সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো শব্দ খুজে পেলোনা, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে আসার সময় শুধু মনে হলো…..
রুবেল কি তবে দীপা আর মারুফকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো!!
যার কারনে নিজের বউয়ের দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজনও মনে করেনি!! দীপা রুবেল এর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসেছিলো…. মারুফ দীপাকে ডেকে শুধু বললো দীপা চলে এসো, তোমার স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।।
শিমু কলি
২১/০৮/২০১৯ইং