গনি মিয়া একজন কৃষক

Photo of author

By Anwar Hakim

  • গনি মিয়া একজন কৃষক।
  • আনোয়ার হাকিম।

গনি মিয়া একজন কৃষক। নিজের জমি নাই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। ছেলের বিবাহে সে অনেক ধুম ধাম করিল। গ্রামের লোকেরা অনেক ফুর্তি করিল। ইহাতে সে অনেক কর্জ করিল। সেই কর্জ আর সে শোধ করিতে পারিল না। গ্রামের লোকেরা বলিতে লাগিল গনি মিয়া কেন কর্জ করিতে গেল?

উপরের এই গল্পটি কয়েক যুগ আগের। সবুজসাথী নামক প্রাথমিক স্তরের বইয়ে পাঠ্যভুক্ত ছিল। তখন পড়ার জন্য পড়িতাম। পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করিতাম। বাবার পিটুনী হইতে রক্ষা উচ্চস্বরে বারংবার পড়িতাম। কিন্তু তখন ইহার বিশেষ মানে বুঝিতাম না। মাস্টার মশাই ও বাবা শুধু এইটুকু বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে কর্জ করিয়া ঘি খাওয়া অনুচিত। ইহাতে গরীব হইতে হয়। পরিণামে কষ্টে পড়িতে হয়। আমার মাথায় অতশত ঢুকিত না। কেবলই মনে হইত ইহা গনি মিয়ার একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। তাই ইহা লইয়া অধিক মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নিষ্প্রয়োজন।

যুগ পাল্টাইয়াছে। যুগের এক্সেলেটরে পা রাখিয়া গনি মিয়ারাও মডার্ন হইয়াছে। সেই গল্প এখন পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাস বহির্ভূত হইয়াছে। ইহার কোন হার্ড কপি আজ যাদু ঘরেও পাওয়া যাইবে কিনা সন্দেহ। তবে কর্জ করার অভ্যাসী গনি মিয়াদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়িয়া চলিয়াছে। সঙ্গত কারণেই ইহারা আর আগের সেই গনি মিয়া নাই। আগের সেই দাদন ব্যবসায় এখন আর তেমন প্রসারও নাই। কর্জের টাকার জন্য গনি মিয়াদের এখন আর অশিক্ষিত, চামার টাইপের দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হইতে হয়না। ইহাদের চক্র বৃদ্ধি সুদ পরিশোধের তাগাদার তাড়া খাইতে হয়না। ইহাদের স্থলে সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকসমূহ কর্পোরেট সরাইখানা খুলিয়া লইয়া বসিয়া আছে। গনি মিয়ারা ফ্রন্ট ডোর অথবা ব্যাক ডোর দিয়া সেই অর্থলগ্নিকারী সরাইখানাগুলোতে বুক ফুলাইয়া এসি’র বাতাস খাইয়া আপ্যায়ন ইত্যাদিতে সম্মানিত হইয়া আন্ডার হ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড কারবার সারিয়া মিলিয়ন অংকের কর্জ হাসিতে হাসিতে হাসিল করিতেছে। অর্থলগ্নিকারী সরাইখানায় নিয়োজিত গনি মিয়াগণও পরম উৎসাহ লইয়া ইহাদের খেদমত করিতেছে। ইহারা বেতনভুক মাত্র। নিজেদের ক্যাশ নাই। তবে গনি মিয়াদের মত ইহাদেরও ‘ক্যাশপতি’ হইবার খায়েস হয়। তাই খেদমতের বিনিময়ে তাহারা উইন উইন সিচুয়েশনের ভাগ-বখরা নিজেদের ভোল্টে নির্বিঘ্নে ঢুকাইয়া লইতেছে। হতভাগ্য দুই একজন ধরা খাইতেছে সত্য। তবে তাহা অনুপাতে অনুল্লেখযোগ্য। জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠাইবার পর ইহার যেরুপ অবস্থা হয় তাহারা কতককাল সেইরুপ ছটফট করিতে থাকে। পরে বজ্র আঁটুনি ফসকা গিরোর যাদুমন্ত্রে বেকসুর হইয়া সমাজে বিচরণ করিতে থাকে।

কথা অন্যদিকে বাঁক লইয়াছে। তাই, ট্র্যাকে থাকাই বাঞ্চনীয়। কথা হইতেছিল আজকালকার গনি মিয়াদের লইয়া। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ যথার্থই বর্গাজীবি, নিজের জমি নাই। থাকিলেও প্রায় ভূমিহীন পর্যায়ের। বাকীদের জমি জমা আছে। তবে স্বভাবে ইহারা গনি মিয়া তুল্য। নিজের জমি তো নিজেরই। অন্যের জমিও নিজের মনে করিয়া ইহারা অন্যের জমি, অন্যের সম্পদ ধর্ষণ, কর্ষণ করিয়া থাকে। ধর্ষণের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িয়াছে। লেখার ফোকাসও অন্যদিকে বাঁক লইতে উসখুস করিতেছে। গনি মিয়ারা নিজের জমিতে কর্ষণ, ধর্ষণ করে কিনা জানিনা। ইহা তাহাদের প্রাইভেট বিষয়। ইহার কোন অডিও, ভিডিও ক্লিপিং ফাঁস হইয়াছে বলিয়া শুনি নাই। তবে ইহারা যে নিজ জমি ভিন্ন অন্যের তত্ত্বাবধানে থাকা পতিত, অনুর্বর, উর্বর, লাখারিজ, নয়নসুখ জমি পাইলেই বাছবিচার না করিয়া ধর্ষণ-কর্ষণে লিপ্ত হইতেছে ইহা ফাঁস হওয়া অডিও,ভিডিও ক্লিপিংয়ের কল্যাণে চাক্ষুষ হইতেছে। শুধু যে গনি মিয়ারাই ম্যারাডোনা স্টাইলে কহেলিতেছে ইহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। মিস/মিজ/মিসেস গনি মিয়ারাও কম খেলিতেছে না। ইহারাও নীচতলা, উপরতলা বন্ধক রাখিয়া ভালই চলিতেছেন। ইহাদেরও অডিও, ভিডিও ক্লিপিং ফাঁস হইতেছে। এই সমস্ত লইয়া কিছু দিন মিডিয়া পাড়া সরগরম থাকে। আটপৌরে পাবলিক ইহাতে বেশুমার বিনোদন খুঁজিয়া লইতেছে। চারিদিকে গনি মিয়াদের আধিপত্য মুহম্মদ ঘোরির ঘোড়ার মত টগবগ করিতেছে।

আগেকার গনি মিয়ারা ফুটানি দেখাইতে যাইয়া কর্জ করিয়া ঘি খাইয়াছে। ফলত নিঃস্ব হইয়াছে। কিন্তু আজকালকার গনি মিয়ারা আঙ্গুল ফুলিয়া কলা গাছ হইতেছে। ইহারা মিলিয়ন মিলিয়ন অংক কর্জ করে। কর্জ শোধ করিবার কোন খায়েসই ইহাদের নাই। প্রথমত ইহারা অর্থলগ্নিকারী সরাইখানার সাথে আঁতাত করিয়া ধর্ষণ, কর্ষণের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পাদন করিতেছে। উইন উইন সিচুয়েশনের অলিখিত ম্যামোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং সম্পাদন করিয়া কর্জের টাকা সরাইয়া ফেলিতেছে। ইহার কিয়দংশ দিয়া হোয়াইট কারবারে বিনিয়োগের সাইন বোর্ড লটকাইয়া সিংহভাগ বিদেশে থ্রো করিতেছে। ইহার পরের কাহিনী সবার জানা। আমেরিকা,কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই প্রভৃতি দেশে সেই কর্জের টাকা দ্বিগুণ, তিনগুণ, বহুগুণ হইতে থাকে। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিল জাতীয় আবহ সৃষ্টি হইয়া থাকে। ভাগ, বাটোয়ারা বা বখরার অর্থের কমবেশি লইয়া অথবা বঞ্চিত কাহারো ফুঁসমন্তরের কারণে কিছু কিছু হতভাগার কাহিনী ভাইরাল হইয়া থাকে। এইরুপ হইলে সরকারি যন্ত্র ‘হায়, হায়, ইহা কি হইলো, কেমনে হইলো, কাহারা করিলো, কাহারা জড়িত’ ইত্যাদি বিলাপে চারিদিক কাঁপাইয়া ফেলিতে থাকে। ইহা নিয়া সুশীলের মাতামাতি, গুঁতোগুঁতি, হাতাহাতি, খায়-খাতির, আড়াল-আবডাল খেলা চলিতে থাকে। আরেকটি ইস্যু আসিয়া ইহার অগ্নিনির্বাপণ করে।

কথা আবারো বেলাইনে ছুটা শুরু করিয়াছে। গনি মিয়া প্রসঙ্গে কথা বলিতেছিলাম। আজকালকার গনি মিয়ারা ভাগ্যবান। ইহাদের কদর সর্বত্র। ইহারা টক শোতে বসিয়া জ্ঞানের ছবক দেন। বুভুক্ষু পাবলিক ইহাদের কথায় কখনো উত্তেজিত হয়, কখনো হাসিতে দশ খান হয়, কখনো বৌ এর ছোট ভাই সম্বোধনে খিস্তি খেউর করেন। ইহাদের মধ্যে অনেকে চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন দিয়া, সেলিব্রেটি এম্বেসেডার ক্রয় করিয়া ব্যবসারুপী মারণ ফাঁদ ফাঁদিয়া বসেন। অধিক ধর্ষণ, কর্ষণের জন্য বিভিন্ন এভেন্যু খুলিয়া বসেন। অর্ধভুক, বুভুক্ষু পাবলিক এই সব সেলিব্রেটিদের মোহনীয় সুর আর আগুনজ্বলা গা গতরে আকৃষ্ট হইয়া লোভাতুর, কামাতুর প্রাণীর মত ধার-কর্জ করিয়া, নিজেদের সর্বস্ব বন্ধক রাখিয়া ইহাদের কাছে নিজেদের সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া থাকে। কালান্তরে এই সব ‘গনি মিয়া প্রাইভেট কোম্পানি’ সমূহ ইন্দ্রনাথের মত হঠাৎ দৃশ্যপট হইতে উধাও হইয়া যায় বা অলক্ষ্যে সটকিয়া পরে। সেলিব্রেটি সাইন বোর্ডধারীরা অতিশয় ধরিবাজ প্রকৃতির হইয়া থাকে। ইহারা আঁতেলেকচুয়াল বিবৃতি দিয়া মুহুর্তেই গায়ে লাগা নোংরা পানি সাফ সুতরো করিয়া ফেলে। আম পাবলিক কয়েকদিন চিল্লাচিল্লি করিয়া গলা ফাটায়, পুলিশের লাত্থিগুঁতা খায়। কর্তৃপক্ষ ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিয়া বিবৃতি সর্বস্ব হুংকার দিতে থাকে। ইহাতে কাহারো হাতে, কাহারো কোমরে দড়ি পরে। ইহাদের কাউকে আটক ফাটক করিয়া সামনে দাঁড় করাইয়া ফটো সেশন হয়। পরে কি হয় জানি না।

কথা হইতেছিল গনি মিয়াদের লইয়া। ছোটবেলার পড়া গনি মিয়া গল্পের শেষাংশে ছিল একটি ম্যাসেজ। কর্জ করিয়া যে গনি মিয়া ধুম ধাম করিয়া তাহার ছেলের বিবাহতে বেশুমার খরচ করিয়া গ্রামবাসীকে খাওয়াইল, সেই গ্রামবাসীই গনি মিয়ার দেউলিয়াপণার সময় তাহাকে ভর্ৎসনা করিতে ছাড়ে নাই। তাহাদের বক্তব্য হইল গনি মিয়া কেন কর্জ করিয়া খাওয়াইল? সেইকালের গনি মিয়াদের নিজের জমি ছিল না। অন্যের জমি চাষ করিত। এই কালের গনি মিয়াদের জমি থাকুক কিংবা না-ই থাকুক তাহারা কর্জ করিতে দ্বিধাবোধ করেনা। সুযোগ পাইলেই ধর্ষণ, কর্ষণে নিজেদেরকে নিয়োজিত করিয়া ফেলে। ধর্ষক কৃষকদের টিকি পর্যন্ত ছোঁয়া যাইতেছে না। ছোঁয়া গেলেও ফুলের টোকার মত গায়ে কিছুটা বাতাস লাগিতেছে মাত্র। চূড়ান্তরুপে ইহারা ফটোসেশনে ‘ভি আঙ্গুল’ দেখাইবার নামে কার্যত পাবলিককে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করিয়া থাকে।

কথায় কথা বাড়িতেছে। কিন্তু গল্পের নটে গাছটি ফুরাইতেছে না। এইবার এইবার খোকার থামিবার পালা। গনি মিয়ারা ধর্ষণ, কর্ষণে পরিবারকে, সমাজকে, নীতি-নৈতিকতাকে একের পর এক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিতেছে। রাষ্ট্রকেও ফোকলা করিয়া ফেলিতেছে। বিনোদনে মত্ত পাবলিক ভাবিতেছে ঘরে বসিয়া বিনা পয়সায় এইসব ধর্ষণ, কর্ষণের রগরগে কাহিনীর অডিও, ভিডিও ক্লিপিং দেখিতে, শুনিতে পাওয়া যাইতেছে ইহাই তো তাহাদের জন্য অফুরান বোনাসের। খামোখা আওয়াজ চওড়া করিয়া সরকারি, বেসিরকারি চতুর্মুখী সাঁড়াশি আক্রমণের শিকার হইতে যাইবে কেন? মূলত দেখভাল করার জন্য যাহারা নিয়োজিত আছেন ইহাদের চিন্তাও অভিন্ন। রাষ্ট্রের জন্য এই সব গনি মিয়ারা কি ভ্যাল্যু এড করিতেছে রাষ্ট্রকেই ইহা সুয়োমোটো ভাবিয়া দেখিতে হইবে।

ছোটবেলার একটি প্রবন্ধ বয়সকালে পাঠ করিয়া কি সব প্যাচাল পারিলাম বুঝিতেছি না। ইহাকে বিলাপ বা প্রলাপ বলা সমীচীন কি-না ইহা যাচাই করার দায়িত্ব পাঠকের। স্কুল-কলেজে ‘একাল-সেকাল’ লইয়া রচনা লিখিতে হইত। সেই অভ্যাস আজো সুযোগ পাইলেই উঁকি মারে। তাই, গনি মিয়াদের লইয়া এই তুল্যমূল্য নিবন্ধ। গনি মিয়ারা ধর্ষণ, কর্ষণে আরো প্রভূত ধুরন্ধর ও আগ্রাসী হইয়া উঠুক ইহাতে আমার কি? আমি শুধু একালের গনি মিয়াদের চরিত্র চিত্রণের প্রয়াস পাইয়াছি। ইহাতে বেয়াদবি হইলে নিজ গুনে মাফ করিয়া দিলে বেশুমার খুশি হইবো। অধমের প্রাণ সংহারের ভীতি ইহাতে কিঞ্চিৎ দূরীভূত হইবে।