স্মৃতির পাতা থেকে

Photo of author

By Zeenat Alam

১৯৮৯ সনের কথা। আমার বড় ছেলে তখন “লিটেল জুয়েলস” স্কুলে পড়ে। ছেলেকে ভর্তি করতে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। আমরা দুজনে সিদ্দেশ্বরী গার্লস কলেজে এক সঙ্গে পড়তাম। নাম শারমিন। ওর বিয়ে আমার আগেই হয়েছিল। কলেজেও আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম। আমার বিয়ের পর তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই ছেলের স্কুলে তাকে পেয়ে আবার পুরানো বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়ে গেল। প্রতিদিন স্কুলে দেখা হতো। তাতেও হতোনা। একে অন্যের বাসায় আসা যাওয়া হর হামেশাই লেগে থাকতো। এদিকে আমাদের বরেরাও দুজন ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছে। বাচ্চারা দুজন একই ক্লাসে পড়ে বলে ওরাও বন্ধু। ভাল দিনকাল কাটছে।

হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, শারমিন অসুস্হ। তাই সে কয়েকদিন বাচ্চা নিয়ে স্কুলে আসছেনা। তাই আমি আর আমার বর দুজনেই ঠিক করলাম ওকে দেখতে যাবো। তখনকার সময়ে মোবাইল ছিল না। বিবাহিত মেয়েরা এবাসায় ওবাসায় যেতে শাড়ী পরেই যেত। আর আমরা দুই বান্ধবী মা শা আল্লাহ্ সাজু গুজু করতে খুব পছন্দ করতাম। (আমি এখনো করি)।

Weekend ছিল সেদিন। আমার বর বললো, চল যাই আজ তোমার বান্ধবীকে দেখে আসি। আমাকে আর পায় কে। সাজুগুজু করে, প্রিয়শাড়ী আর খুব প্রিয় একটা বেশ দামি সেন্ডেল (জেদ্দাহ্ এর খুব দামি একটা দোকান থেকে কেনা) পরে রেডি হয়ে গেলাম বান্ধবীকে দেখতে। সেদিন শুক্রবার ছিল। ড্রাইভার ছিলনা। ড্রাইভ করলো আমার বর। ওদের বাসা ছিল বাসাবো। প্রচন্ড গরম ছিল তখন। বান্ধবীকে দেখতে গেলাম। ওর অসুস্থতার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর নাকি হার্টের সমস্যা হয়েছিল। এই বয়সে হার্টের সমস্যা, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রায় ঘন্টা দু-এক ছিলাম ওর সাথে। ফিরে আসছিলাম। যেহেতু হার্টের সমস্যা, ওকে বললাম তিনতলা থেকে তোমার নামার প্রয়োজন নাই। আমিই চলে যাবো। আমার বর ছেলেকে নিয়ে বান্ধবীর বর সহ নেমে গিয়েছে। আর আমাদের একটা অভ্যাস, বিদায়ের সময় হঠাৎ খুব জরুরী কিছু কথা বাকী থেকে যায়। তাই বলছিলাম। এদিকে আমার বর গাড়ীতে এসে এসি চালিয়ে গাড়ী ঠান্ডা করছিল আর বান্ধবীর বর গাড়ীর সামনে ঝুকে আমার বরের সাথে গল্প করছিলেন।

না বললেই নয়, শারমিন আগে একদিন আমার কাছে গল্প করেছিল, সন্ধ্যার সময় ওদের এলাকার একটা কুকুর ওদের কাজের মেয়েকে কামড় দিয়েছে। বাসার বড় গেটটা বন্ধ ছিল। মনটা খুব খারাপ করে ছোট গেটটা দিয়ে বের হচ্ছিলাম, আর বেশ কিছু কুকুরের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। চট করে মনে পড়ে গেল কুকুরের কামড়ের কথা। আমি কিন্তু কুকুর ভীষণ রকম ভয় পাই। এদিকে বান্ধবীর শরীর খারাপ সে জন্য যেন মনটা পাগলের মত খারাপ। মাথা পুরাটাই এলোমেলো। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, আমি যেই বাম পা টা বের করেছি গেট থেকে দেখলাম, ১০/১২/১৫ টা কুকুর ধেয়ে আসছে। আমার দিকে নয়। তারা দৌড়ে কোথাও যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ড পর দেখলাম আমি “ম্যানহোলে” পড়ে গেলাম। কুকুর গুলো আমার মাথার উপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আমি তাড়াহুড়ো করে কিভাবে যেন নিজে নিজে “ম্যানহোল” থেকে উঠে পড়লাম। আমি আজও ভেবে কুল পাই না আমি কি ভাবে পড়েছিলাম, কেমন করে উঠেছিলাম। তবে এটা মনে পড়ে, আমি ভেবেছি “বান্ধবীর বর যদি আমাকে ধরে উঠায়, ছিঃ। এটা কেমন কথা”। উঠেছি ঠিক। কিন্তু নিজের পায়ের উপর আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। মজার ব্যাপার, ম্যানহোলে থাকা অবস্থায় আমি শুনতে পেয়েছি, “কিসের যেন শব্দ হয়েছে!!!” আপাকে তো মাত্র দেখলাম। উনি আবার কোথায় গেলেন”!!! আশ্চর্য…..আমার মনে পড়ে না কি ভাবে পড়েছি, কি ধরে আটকে ছিলাম, কিভাবে নিজে নিজে উঠেছি। অথচ ওই কথা গুলো মনে পড়ে। যাই হোক, আমি পুরোটা ডুবিনি। আমার হাটু পর্যন্ত ডুবেছে। বাকীটা ঝুলেছিলাম বলে গায়ে অনেক ময়লা লেগেছিল। হাত পা সব ছিলে গিয়েছিল। এ ঘটনার দু মাস আগে আমার একটা বড় সড় অপারেশনও হয়েছিল। তবে আল্লাহ্ র কাছে এখনও আমি শুকরিয়া আদায় করি, যে সেদিন আমি ঝুলে ছিলাম বলে হয়তো বেঁচে গেছি। পরে একদিন আমি সে বাসার সামনে গিয়ে দেখেছিলাম, আমি শুধু এটা দেখেছিলাম, যেখান থেকে আমি পড়ে গিয়েছি সে জায়গাটা ম্যানহোলের কভারটা হাফ ছিল। সন্ধ্যার পরে অন্ধকার ছিল বলে, কুকুরের ভয়ে তাড়া করতে গিয়ে পা টা স্লিপ করেছিল আমার। কিন্তু আমি অনেক ভাবে চেক করেছিলাম আমি কি ধরে ঝুলে ছিলাম। আমি কোন কিছুরই হদিস পাইনি। এটা একমাত্র আল্লাহ্ জানেন। আমার কাছে আজও সেটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

তারপর আমার বান্ধবী নেমে আসলো। ওদের গাড়ী ধোয়ার পাইপ দিয়ে অনেক চেষ্টা করলো আমাকে পরিস্কার করতে, কিন্তু পারলোনা। ওর বাসার ভেতরে নিয়ে গেলো। ওর বাথরুমে গিয়ে অনেক চেষ্টা আমিও করলাম। কোন ভাবেই হাটু থেকে পা পর্যন্ত যে ময়লা লেগেছিল সেগুলো উঠানো গেলো না। কোনভাবে বান্ধবীর একটা শাড়ী পরে বাসায় আসলাম। গাড়ীতে যখন বসেছি, আমার বর বলছিল, “উহ্ তোমার গায়ের গন্ধে আমি মরে যাব”। ছেলে বলে আম্মুউউউ গন্ধঅঅঅ”। কোনভাবে বাসাবো থেকে শান্তি নগর বাসায় ফিরে আসলাম। ব্রাস দিয়ে ঘসা দিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে সে পিচ্ছিল শেওলা গুলো গা থেকে সরালাম। এক দেড় ঘন্টা ধরে গোসল করলাম। তার পরের ২/৩ মাস আমি শুধু ম্যানহোলের গন্ধই পেয়েছি গায়ের থেকে। যদিও গন্ধ ছিলো না। খাওয়া-দাওয়া সব কিছুতে ম্যানহোলের গন্ধ পেতাম।

তবে যখনই মনে পড়ে সে কথা, আল্লাহ্ র দরবারে আমি সুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারি না।

বিঃদ্রঃ আমি আমার সে বান্ধবীকে আজও খুঁজছি। যতদূর মনে পড়ে ১৯৯০ সালের দিকে সে আমেরিকায় চলে যায়। তারপর থেকে কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।

জীনাত
৫ই নভেম্বর ২০২০
সময়ঃ বিকেল ৪টা