আজ শাহেদের ছুটির দিন ছিল কাজেই নাস্তা শেষ করেই সে বাড়ির কাজ দেখতে চলে গেছে। মাঝে মাঝে রানুও যায়, তবে আজ তার যেতে ইচ্ছে করেনি। ওই যে একটা আগুন জ্বলছে, সেটাই তাকে পুড়াচ্ছে, সেটাই তাকে ভাবাচ্ছে।
রানুর বাবা পদস্থ মানুষ ছিলেন, শাহেদ সে সুযোগটা পুরোদমেই নিয়েছে। নিজের বাবার বাড়ি আর বিশেষ করে মিথির থেকে বহুদূরে থাকার ইচ্ছে থেকে সে বরাবর শ্বশুরবাড়ির এলাকা ও এর আশেপাশেই পোস্টিং নিয়েছে। রানুর নামে বাড়িটাও করছে শ্বশুরের এলাকায়। এমন নয় যে শ্বশুরবাড়ি থেকে সে আর্থিক কোনও সাহায্য পেয়েছে বরং রানুর ভায়েরা যখন ব্যবসায় বড় ধরনের মার খায়, শাহেদই কুলিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল, শাহেদের নিজের ভায়েরা কী করছে সে খবর নেবার গরজ যদিও সে কোনও দিন অনুভব করেনি।
এই যে এত এত পাওয়া, শাহেদের ভালমানুষি রানুর প্রতি, রানু সবসময় এতে কিন্তু খুঁজে পায়, তবে রানু বেশি ঝামেলা করে না কখনও। আজ একটা কথা রানুর থেকে থেকে মনে আসছে, সে কিছুতেই মন থেকে সেটা দূর করতে পারছে না। শাহেদ আসুক, আজ শাহেদকে জবাব দিতেই হবে।
সারাদিন বাড়ির কাজ দেখাশোনা শেষে শাহেদ ক্লান্ত হয়েই বাড়ি ফিরেছিল। গোসল শেষে ডাইনিং এ বসে আছে সে, বুয়া ভাত দিবে। রানু কোথায় কে জানে, শাহেদ রানুর খোঁজ নেয়, সে খেয়েছে কি না।
হঠাৎ করেই রানুর গলা শুনতে পেল শাহেদ।
‘তুমি এলে!’
ভাত মুখে দিতে দিতে শাহেদ বলে, ‘খেয়েছ’? রানু তার জবাব দেয় না। অপেক্ষা করে কখন শাহেদের খাওয়া শেষ হবে। শাহেদ খাবার শেষ করে নিজের রুমে যায়।রানুও পিছু পিছু, শাহেদ রানুকে দেখে চমকে উঠে, কারণ বহুদিন হয় রানু তার রুমে আসেই না। কেন আসে না সে প্রশ্ন শাহেদ করে না।
‘কিছু বলবে’?
‘কেন’?
শাহেদ কী ভেবে উত্তর দেয়, ‘না, আমার রুমে তো তুমি আজকাল আসো-ই না’।
‘আসি না, তোমার কল্পনায় যারা থাকে, তাদের সেই সাথে তোমার ব্যঘাত ঘটাই না’।
একটু কঠিন স্বরে রানু উত্তর দেয়।
শাহেদ কোনও জবাব দেয় না। রানুর রাগ লাগে, এ নিশ্চয়ই তার আগের বউ আর মেয়েদের কথা ভাবে, নইলে কোনও উত্তর কেন দেয় না!
‘তোমার মেয়ে দুটোর নামে বাড়িটা দিলে পারতে, আমাদের তো সন্তান নেই’।
রানুর কথায় শাহেদ জ্বলে উঠে ভেতরে ভেতরে, কিন্তু জবাব দেয় না।
‘কী হল! উত্তর দাও না কেন?’
শাহেদ এবার ধীরে উত্তর দেয়, ‘রানু! তুমি জানো যে ওদের ব্যপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই, কেন এসব বিষয় নিয়ে কথা বল?’
‘মাথাব্যথা নেই কিনা আছে কে জানে তোমার মনের খবর! ওরা তোমার মেয়ে’।
শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘রানু তুমি জানো তোমাকে আমি ভালবাসতাম, বাবার ইচ্ছেয় বিয়েটা হয়েছিল, ওতে আমার সায় ছিল না।আমি তো কেবল চাকরি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।চাকরিটা হতেই সব ফেলে তোমার কাছে চলে এসেছি।সবই তুমি জানো’।
‘বাহ! সাধু সাধু! মিথির সাথে তোমার কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠে নি!’
রানুর শ্লেষ মাখা কণ্ঠে শাহেদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।
‘বিশ্বাস কর রানু,মিথিকে আমি স্ত্রী মর্যাদা দিইনি, ওকে আমি সহ্যই করতে পারতাম না’।
‘খুব ভাল। তোমার মেয়ে দুটো হল কী করে! মিথিকে তুমি স্ত্রীর মর্যাদা দাওনি, তাকে তুমি সহ্য করতে পারো নাই, তবে মেয়ে দুটো তোমার তাহলে নয়! যাকে সহ্যই করতে পারতে না, তার কাছেও নিশ্চয়ই তুমি যাওনি!আর এখন তোমার পরিচয়েই নিশ্চয়ই ওরা বড় হচ্ছে’।
আজ শাহেদের কী হল! ঠাস করে রানুর গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
দেড়দিনও হয়নি রানু বাবার বাসায় এসেছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শাহেদের এমন জিদ, এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করেনি। রানুর এখানে ভাল লাগছে না মোটেই। প্রথম ধাক্কাটা আসে বাসায় ঢোকার পর মায়ের কাছ থেকে –
‘কীরে রানু! এই অসময়ে! জামাইর সাথে কোনও ঝামেলা’!
রানু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল
‘কেন! আমার কী এখানে আসতে নেই’!
রানুর মা থতমত খেয়ে বলেন
‘নারে কখনও এভাবে আসিসনি তো’
রানু কোনও উত্তর না দিয়ে তার রুমে চলে যায়। এ বাড়িতে মোট চার তলা। একতলায় কিচেন, ড্রয়িং, বাড়ির বাড়তি লোকদের থাকার জায়গা আর গেস্ট রুম। দুতলায় মা বাবা, বোন আর রানুর রুম, কাছের আত্মীয়দের জন্য আরেকটা গেস্টরুম। তিনতলা আর চারতলায় রানুর দুই ভাই।
বিয়ের পর রানু হাতে গোনা দুই তিনদিন থেকেছে তার রুমে। বরাবর শাহেদের সাথে এসে সারাদিন থেকেই চলে যায়। কখনও আর সেভাবে থাকা হয়নি।
মায়ের পর শুরু হয় ইন্টারভিউ একে একে, বোন ভাই বাবা — সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে রানুকে কেন সে এখানে আসল। বিয়ের পর বাবার বাড়ি কি আসলেই পর হয়ে যায়! একটু নিঃশ্বাস নিতেও আসা যাবে না! সবচেয়ে বিরক্তিকর বিন্তি খালা, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিচ্ছে রানুকে। যে বিন্তি খালা একদম নিজের দরকার ছাড়া কাউকে ফোন দেন না, সেই তিনি প্রতি ঘন্টায় একবার করে ফোন দিচ্ছেন। মুখে দরদ কিন্তু গলায় আনন্দ চেপে রাখতে যেন পারছেন না।
উনার প্রথম ফোনটা এমন ছিল-
‘হ্যাঁ রে রানু শুনলাম বাবার বাড়ি এসেছিস’!
‘তো! কী হয়েছে’!
‘না রে জানিসই তো তোদের কোনও দুঃসংবাদে স্থির থাকতে পারি না’।
‘খালা আমার কোনও দুঃসংবাদ হয় নাই’।
রানু লাইন কেটে দেয়।
ঠিক ঘন্টাখানেক পরেই-
‘হ্যাঁ রে রানু! জামাই তোকে খুব মারধর করেছে’!
‘কি সব বল খালা! মারধর করবে কেন’?
‘আহারে বয়স কী আর এমনে এমনে হয়েছে! বুঝি সব বুঝি। দাঁড়া এমন বুদ্ধি আঁটবো, আমি চলে আসি একটু সবর কর’।
রানুর রাগে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলতে থাকে।
‘তোমার এসে কাজ নেই, তুমি এসব খবর কই পাও? যত্তসব’।
‘তোদের ধ্যৈর্য কম। সবাই বলাবলি করছে’।
রানু শেষ পর্যন্ত আর শুনে না, লাইন কেটে দেয়। সেই বিন্তি খালা এই দেড়দিনে রঙিয়ে চঙিয়ে ঘটনাকে কতদূর যে নিলেন, শাহেদকে জেলের ভাত পর্যন্ত ইতিমধ্যেই ফোনের মধ্য দিয়েই খাওয়ালেন। উফ্ অসহ্য! বিন্তি খালা মায়ের দূরসম্পর্কের বোন। নানা ছুঁতোয় এ বাড়িতে আসেন। রানুর মা এই বোনটিকে প্রচুর সাহায্য করেন, কিন্তু ইনি কানা বালতির মত, যতই দেওয়া হোক উনার অভাব দূর হয় না। আবার রানুদের কোনও দুঃসংবাদে ইনিই আনন্দে নেচে উঠেন। কী যে অসহ্য লাগে রানুর। আর রানুর ভাবীরা মুখে কিছু বলে না, বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন আর মুখের রহস্যময় হাসিটা রানু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সবমিলিয়ে রানুর আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে মন চাইছে না। যত যাই হোক নিজের স্বামীর ঘরটাই যে বিয়ের পর সবচেয়ে নিজের রানু সেটা যেন তিলে তিলে বুঝতে পারছে। কিন্তু শাহেদ যা করছে তাও তো রানু মেনে নিতে পারছে না। সে কি পারত না একটা ফোন দিয়ে অন্তত রানুর খোঁজ নিতে!
দুনিয়টা খুব স্বার্থপর, হঠাৎ করেই রানুর মনে হল। আজ একটা সন্তান থাকলে তার উছিলায়ও রানু তার সংসারে ফিরে যেতে পারত। রানুর মনটা এত খারাপ হতে লাগল, বেঁচে থাকাটাই এখন অসহ্য লাগছে।
কী করবে সে এখন!
রানুর পড়া শেষ হলে পরেই শাহেদের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। ওর বান্ধবীরা প্রায় সবাই যেখানে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, চাকরি করছে রানু সেখানে কিছুই করার চেষ্টা করেনি। বাবার সংসারে অঢেল প্রাচুর্যে বড় হয়েছে, বিয়ের পরও প্রাচুর্যেই আছে। কিন্তু রানুর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রতিটি মেয়েরই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। এখন তো চাকরির বয়সও শেষ।
ওদিকে বিন্তি খালা আজ আসছে। রানুর ভাল লাগছে না কিছুতেই। ঘটনা কোনদিকে মোড় নেবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
কখন রানু মোবাইলটা হাতে নিয়ে শাহেদের নাম্বারটাতেই ডায়াল করল, বলতে পারে না।
ওপাশ থেকে শাহেদের কণ্ঠ, ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেব’?
রানুর বুক থেকে জমানো দীর্ঘশ্বাসটা বের হয়ে আসল যেন।
‘না, তুমিও আসো’
শাহেদ বলে, ‘ওকে, আমিও আসছি’।
বিন্তি খালা যখন এল তখন রানু শাহেদকে নিয়ে খাবার টেবিলে। মা, ভাবীরা আজ অতিরিক্ত খাতির করছে শাহেদকে। রানুর চেয়ে যেন শাহেদই বেশি যত্ন পাওয়ার দাবীদার। অথচ এই শাহেদকে রানুর বড়লোক ভাবীরা কখনও আলাদা যত্ন করেছে কি না রানুর মনে পড়ে না।
কারণটা যে রানুর এ বাড়িতে চলে আসা, রানু সেটা ভালই বুঝতে পারছে। এখন ভালোয় ভালোয় শাহেদ রানুকে নিয়ে গেলেই যেন সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচে।
বিন্তি খালা শাহেদ আর রানুকে খাবার টেবিলে একসাথে খেতে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ হতাশ।
চলবে…