ফিরে আসার পর (পর্ব-২)

শাহেদের যেহেতু কোনও চাকরি ছিল না, কাজেই মিথির বাবা বিয়ের পর পরই তার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে মাসে মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা হাতখরচের জন্য রেখে দিতেন। শাহেদ সে টাকা খরচ করতো। মিথির শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকে, শাহেদের এ ব্যপারে কোনও মাথাব্যথা ছিল না, বরং বিরক্ত লাগত। মিথি রাত হলে পাশের রুমে চলে যেত। মিথির মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত তার স্বামী তাকে শরীরের অবস্থা জানতে চাইবে, তার জন্য ভালমন্দ এটা সেটা আনবে।কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের কোনও ঘটনাই ঘটল না। মিথির তখন কেবল মনে হত, বাচ্চা হওয়ার পর নিশ্চয়ই শাহেদ আর এমন থাকবে না।

এভাবেই মিথির ডেলিভারির দিন এগিয়ে আসল। শাহেদ এরই মাঝে সরকারি একটি চাকরীতে রিটেনে এলাউ হয়েছে। আজ তার ভাইবা, কাজেই একদিকে মিথির হাসপাতালে যাওয়া আর আরেকদিকে শাহেদের ভাইবা দিতে যাওয়া। মিথির নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব হল না, সিজারিয়ান অপারেশন করে জমজ কন্যা সন্তানের মা হল সে। মিথির পাশে তার মা বাবা,বোন বোনজামাই ছিলেন, শাহেদ ছিল না।

মিথির মা নাতনীদের নখ চুল কেটে দিলেন, গোসল দিলেন, আজ সাতদিন হয়। খবর পেয়ে শাহেদের বাবা মাও এলেন। শাহেদ এলো এর একদিন পর।

কোথায় ছিল সে এতদিন, উত্তর নাই। শাহেদ মেয়েদের মুখ দেখে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো, একসাথে দুই মেয়ের কি দরকার ছিল!

মিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, শাহেদ তার রুমে চলে যায়। এর ঠিক এক মাস পর শাহেদের সরকারি চাকরিটা হয়ে যায়। শাহেদ এখন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। তার পোস্টিং অন্য জেলায় কাজেই সে ওখানেই চলে যাবে।

অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্নে জর্জরিত মিথির চিন্তাক্লিষ্ট মুখ কেবল দেখল শাহেদের নিস্পৃহ চলে যাওয়া।
মিথি একদিন শাহেদকে বলেছিল, ‘আপনার যদি এতটাই অমত ছিল তবে বিয়ে করেছিলেন কেন? মেয়েদের দিকেও আপনি ফিরে তাকান না?’-

জবাবে শাহেদ নিষ্ঠুর এক বক্র হাসি উপহার দিয়েছিল।
শাহেদ চলে যাওয়ার পর মিথি অপেক্ষা করেছিল শাহেদ ফোন দিবে, না দেয়নি,নাম্বারও আগেরটা নেই। শাহেদ যেন হারিয়েই গেল মিথির জীবন থেকে।

কলকল হাসিতে শাহেদ চমকে তাকায়। রানু ওর ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দে মেতে আছে। নীল শাড়িতে রানুকে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে,৷ ইচ্ছে করছে ওর পাশে যায়, ওদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে।
কষ্টে সেই ইচ্ছেকে দমন করে শাহেদ। রানু হয়ত বিষয়টা পছন্দ নাও করতে পারে। রানুর পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব অনেক বেশি শাহেদের কাছে।

আসলে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শাহেদ বড় হয়েছে অনেক টানাপোড়েনের মাঝে। মনের মাঝে বড় স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন পূরণের জন্য যা যা করতে হয়েছে শাহেদ তাই করেছে নির্দ্বিধায়। সে মস্ত বড় অফিসার হয়েছে, আরাধ্যা রানুকে পেয়েছে।

যদিও রানুর বিষয়টি শাহেদের কাছে দুর্বোধ্য অনেক, রানু তাকে কতটা ভালবাসে কিংবা আদৌ ভালবাসে কি না সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না শাহেদ। তারপরও রানুর মত মেয়ে তার স্ত্রী, যা বন্ধুমহলে ঈর্ষার কারণ, তার শ্বশুরবাড়িও অনেকের ঈর্ষার কারণ, শাহেদের মহাতৃপ্তি ওই এক জায়গায়।
রানু শাহেদের জুনিয়র ছিল। ভার্সিটিতে এমন কোনও ছেলে বোধহয় তখন কম ছিল যে রানুর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ধন্য হত না।

গ্রাম থেকে আসা শাহেদের চোখে রানু ছিল স্বপ্নের রাণী। রানুর চোখে পড়ার জন্যই শাহেদ ভাল প্রোগ্রামে যুক্ত রাখত নিজেকে, সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করার চেষ্টা করত। অবশেষে রানুর চোখে সে ধরা পড়েছিল বটে। তবে রানু শাহেদের প্রেমে পড়ে নাই। রানুর সুবিধা অসুবিধায় শাহেদ দৌড়ে যেত। সেরকমই একবার রানুর এক মামার জন্য নিজের রক্ত দিয়েছিল শাহেদ, গ্রুপটা ছিল রেয়ার। কাজেই সে সূত্রে রানুর কাছাকাছি আসার সুযোগ পায় শাহেদ। এরপর থেকে চিনাজোঁকের মতই রানুর পিছে লেগেছিল শাহেদ।

রানুর বাবা তখন বড় কর্মকর্তা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কাজেই রানু তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিল তুমি আগে আমার যোগ্য হও, তারপর ভেবে দেখব। শর্ত মেনেই রানুর সাথে শাহেদের সম্পর্ক, কিছুটা দূরত্ব ছিল সেই দূরত্ব আজও আছে কিনা শাহেদ বুঝতে পারে না।

বাবার মন রাখতে গিয়ে শাহেদ বিয়ে করেছিল বটে, তবে সেসব শাহেদ মনে করতে চায় না, বাবার বাড়ির কারও সাথে শাহেদ সম্পর্কও রাখে না। শাহেদের জীবন এখন কেবলই রানুময়।

শেষ যখন শাহেদ বের হয়ে এসেছিল — তারপর ঝাড়া দু’বছর লেগেছিল শাহেদের নিজেকে গুছাতে, রানুর উপযুক্ত হতে। শাহেদ হিসেব করে মনে মনে রানুর সাথে তার পাঁচ বছরের সংসার চলছে। রানু হাসছে, শাহেদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, রানু সেই আগের মতই আছে।

শহর থেকে কিছুটা দূরে নতুন একতলা বাড়িটা। বাড়ির কাজ চলছে পুরোদমে। শাহেদ তৃপ্তি নিয়ে দেখে, এই প্রথম সে একটা দামী উপহার রানুকে দিতে যাচ্ছে সে।যদিও রানুর কোনও শখ সে অপূর্ণ রাখেনি। কিন্তু এই যে বাড়িটা শাহেদ রানুর নামে করে দিচ্ছে রানু খুশি হবে, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও নিশ্চয়ই খুশি হবে।

বিবাহিত জীবনে রানুর কোনও দুঃখ নেই, বরং শাহেদ না চাইতেই সব দেয়, একটু বেশিই দেয়। রানুর কেবল মাঝে মাঝে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে।

বিয়ের দশ বছর হতে চলল তাদের কোনও সন্তান নেই। রানু এ বিষয়টা কৌশলে এড়িয়ে যায়। কারণ সে জানে শাহেদ আগে বিয়ে করেছিল যদিও ওদের সাথে শাহেদের কোনও যোগাযোগ নেই। আর এও জানে যে শাহেদের জমজ দুটো কন্যা সন্তান আছে। কাজেই শাহেদের কোনও দোষ নেই, দোষ থাকলে রানুর। রানু নিজেই ভাবে তার নিজেরই মনে হয় মা হবার ক্ষমতা নেই। তার নিজেরই দোষ,কাজেই সে নিজে থেকে চুপ থাকে,শাহেদও কিছু বলে না। রানুর সংসারের সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্পর্ক নেই, কাজেই তাকে কথা শুনানোরও কেউ নেই।

চলবে…