ফিরে আসার পর (পর্ব-১)

পুকুরের এ পাশটায় পাকা ঘাটের পাশে একটা পাকা বেঞ্চ আছে। শাহেদ সেই কখন থেকে এখানেই বসে আছে। জানালার পাট বন্ধ, তবু ফাঁক গলে আলোর রেখাগুলো বের হয়ে আসছে। কাঠের জানালাগুলো কি আগের মতই আছে নাকি আরও ভেঙে গেছে!

শাহেদ আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ওপাশটা যদি দেখা যেত! কী করছে মিথি এখন?

হঠাৎ করে এত বছর পর শাহেদকে দেখে তার মনের ভাব কী হতে পারে? সে-কি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে নাকি কাছে টেনে নেবে? কিছুই জানা নেই তার। অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময়টা যাচ্ছে।
খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাড়িটা দরজার গিয়ে কড়া নাড়তে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য অনুভূতি তাকে আটকে রাখছে পাকা বেঞ্চটির উপর। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে, ক্লান্ত অবসন্ন মন একটু বিশ্রাম চায়,কিন্তু!!
পাকা বেঞ্চটি বেশ চওড়া অনায়াসে শোয়া যায়। সাথে থাকা নিত্য ব্যবহার্য কিছু কাপড় ভর্তি ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে শাহেদ সটান লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বেঞ্চটিতে।

দীর্ঘ জার্নি শেষে অবসাদে ঘুম আসার কথা, কিন্তু ঘুম আসছে না,কোন মুখ নিয়ে সে দাঁড়াবে মিথির সামনে!

আজ বার বার মনে পড়ছে বিশ বছর আগের কথা।

শাহেদ তখন সদ্য ভার্সিটি পাশ করে বের হওয়া টগবগে যুবক। এতটা মেধাবী না হলেও মোটামুটি মেধাবী সে ছিল, ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র, কাজেই একটা ভাল সরকারি চাকরির আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।

শাহেদের বাবা টেনেটুনে সচ্ছল, কাজেই ছেলেকে এতদূর পড়াতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তাছাড়া উনার আরও সন্তানাদি রয়েছে, তারাও পড়ছে, কাজেই তার সমস্ত আশা ভরসা ওই শাহেদ। শাহেদের বাবার বন্ধুর ছয় মেয়ে। পাঁচ মেয়েকে ভাল পরিবারেই পাত্রস্থ করেছেন, যেহেতু ছেলে নেই কাজেই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাছেই রাখার ইচ্ছে। কাজেই বন্ধুর কাছেই মনের কথা পাড়লেন।

শাহেদের বাবা প্রথমত ইতস্তত করলেও পরে ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে রাজি হয়ে যান, কারণ বন্ধুর মেয়ের সাথে সম্পত্তি লাভের একটা সুস্পষ্ট ইংগিত তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। কাজেই শাহেদের ঘোর অনিচ্ছাসত্তেও বাবার মতের বিরুদ্ধে যাবার সাহস হয় নি,মিথির সাথেই শাহেদের বিয়ে হয়ে গেল।

শাহেদের বাবার বুদ্ধি বেশ পাকাই ছিল। বিয়ের আগে মিথির বাবা নিজের বাড়িটা ছোট মেয়েকে লিখে দেবেন বলেছিলেন তবে সেটা ভবিষ্যতে। কারণ পুত্রহীন মিথির বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব যে শাহেদকেই নিতে হবে।

শাহেদের বাবার বায়না ছিল বাড়ি এবং আর যা কিছু আছে তা বিয়ের আগেই লিখে দিতে হবে। যেহেতু মিথির আরও বোন আছে কাজেই অনেক দেন-দরবার শেষে মিথির বাবা বাড়িটা মিথি ও শাহেদের নামে লিখে দিলেন,তবে পূর্ণ মালিকানা পাবে তারা কেবল মিথির বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর।

বিয়ের পর শাহেদ শ্বশুরবাড়ি উঠে এল অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

মেয়ে হিসেবে মিথি মন্দ নয়, যদিও অন্য বোনদের তুলনায় সে তেমন সুন্দরী নয়। কিন্তু শাহেদ কেন যেন মিথিকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। শাহেদের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, মিথি বুঝতে পারে। স্বামী স্ত্রীর সব সম্পর্ক বজায় রাখলেও মিথি শত চেষ্টা করেও শাহেদের মন ছুঁতে পারে না যেন। কাছাকাছি থাকা আর একে অন্যকে বুঝতে পারা এক নয়। স্বাভাবিক নারী হৃদয় দিয়ে মিথি কিছু একটার অভাব বুঝতে পারে, কিন্তু কী সেটা তা বুঝতে পারে না।

শাহেদ দিনরাত বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। তার জগৎ আলাদা। একটা চাকরি, ভাল চাকরি তাকে পেতেই হবে। বাহ্যিক দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চললেও কেবল মিথির ব্যপারে তার চরম নিঃস্পৃহতা মিথিকে ব্যকুল করে দেয় সময় সময়। প্রাণপনে স্বামীর মন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যায় মিথি।

মিথির একতরফা আকুলতা শাহেদের বিরক্তিকর মনে হয়। তা প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ তার নেই।কেবল শরীরের প্রয়োজন ছাড়া আর কোনও চাহিদায় মিথিকে যেন কাছে টানতে নেই। মিথি তবু আশায় বুক বেধে রাখে, হয়ত একদিন সে শাহেদের মন জয় করতে পারবে।

খাবার টেবিলে মিথির বাবা শাহেদকে তার ব্যবসা দেখার অনুরোধ করলেন। মিথির বাবা মা দুজনেই অসুস্থ, হার্টের রোগী। এমতাবস্থায় শাহেদের হাতে সবকিছুর ভার দিতে পারলে তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। ব্যবসাটা তেমন বড় নয়, মার্কেটে দুটো কাপড়ের দোকান আছে, ভাল চলছে, শাহেদ কেবল একটু দেখাশোনা করবে।

“বাবা,আমার এসব ব্যবসা পছন্দ নয়, আমি চাকরি করব। এত লেখাপড়া করে ব্যবসা করব, এ আমার পছন্দ নয়”।

শাহেদ প্লেটের খাবার দ্রুত শেষ করে রুমে চলে যায়।

মিথিও পিছু পিছু আসে। “তুমি বাবার কথা রাজি হলেও তো পারতে”– মিথি মৃদু গলায় অনুযোগের সুরে বলে।

শাহেদ রাগত চোখে মিথির দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দু’দিন ধরে শাহেদের খবর নেই।
তার গ্রামের বাড়ি, আগের মেসবাড়ি সবখানেই খবর নেয়া হল, কোথাও যায়নি সে।

দু’দিন পর বাড়ি ফিরল শাহেদ। দুশ্চিন্তায় মিথির কেমন দিন কাটল তা মিথিই জানে কেবল, আর সাথে বাবা-মাও। মিথি শাহেদের কাছে জানতে চায় কোথায় ছিল সে।

জবাব শাহেদের রাগত উত্তর
“তোমার কি মনে হয় আমাকে কিনে নিয়েছ তোমরা? আমার যখন যেখানে খুশি যাব, তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও যেও”। সটান বিছানায় শাহেদ, একবারও জানতে চাইল না মিথি কেমন আছে।

মিথির শরীরটা ভাল যায় না, বিয়ের মাসখানেক পরই সে কনসিভ করে। শাহেদের তাতে কোনও মাথা ব্যথা নেই। বরং রাতে যখন তার ঘুম আসে না, যখন তখন বমি আসতে থাকে মহাবিরক্ত হয়ে শাহেদ তাকে অন্য রুমে চলে যেতে বলে। তার ঘুমের নয়তো লেখাপড়ার ব্যঘাত হয়।

চোখের জল মুছতে মুছতে মিথি অন্য রুমে চলে যায়, কিন্তু শাহেদের এই নিষ্ঠুরতার কথা সে কাউকেই বলতে পারে না।

চলবে…