ঝকঝকে নীল আকাশ। আকাশে দলবাধা সাদা মেঘ। গাছের পাতাগুলো গতরাতের বৃষ্টিতে আরো সজীব হয়েছে। কত শত পাখি নির্ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক–ওদিক। অপরূপ একটি বিকেল। তবুও কেমন যেন বিষণ্নতা ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কী যেন নেই। চাপা একটা হাহাকার। তবে কি সুন্দরের মধ্যে কষ্ট মিশে থাকে? নীলা, পাঁচ মাস পর বাবা–মায়ের কাছে এসেছে। বার বার মা–বাবার ফোন, সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। চলে এসেছে। ট্রেনে। একা। আজ আর পাশের সিটে শাওন নেই। উত্তরার ছোটো ছিমছাম একটি ফ্ল্যাটে ছোট্ট সংসার শাওন আর নীলার। বিয়ের তিন মাস চলছে। একটি কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে শাওন। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাটে ব্যস্ততায়। শুধু বিশুদবার ব্যতিক্রম। দিনটা যেন সকাল থেকেই হাসে। নীলাও সেদিন প্রজাপতি হয়ে যায়। শাওনের অফিস সপ্তায় দুদিন বন্ধ। তাই বিশুদবার অফিস থেকে ফিরেই নীলাকে জড়িয়ে ধরে। কী এক উত্তেজনায় বলে, আমাদের দুদিন ফুরফুরে দিন। নাস্তার টেবিলে প্ল্যান হয় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়।
বিশুদবার কলিংবেলের শব্দ নূপুরের মতো মনে হয় নীলার। নূপুরের শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘরে ঢোকে শাওন। নীলার মন আজ অন্যরকম আনন্দে ভরে আছে। আজ নাস্তার টেবিলে আরেকটি প্লেটে, একটুকরো কাগজে মুড়েরাখা আছে একটি গোলাপের পাশে আরেকটি গোলাপি লেখা। ঘ্রাণ নিতে নিতে দেখবে শাওনের চেহারার পরিবর্তন। কিন্তু শাওনকে দেখে মুহূর্তে উবে গেলো সেই আনন্দ।
– এ কী চেহারা হয়েছে তোমার শাওন? কী হয়েছে?
– কাল রাত থেকেই শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল। আজ অফিস যাওয়ার পর সর্দির সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। জ্বরও এসেছে মনে হয়।
– তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। আমি মিনহাজকে ফোন দিয়ে কী ওষুধ খেতে হবে জেনে নিচ্ছি। নীলা জ্বর মেপে দেখল একশো এক। থার্মোমিটার দেখে শাওন হেসে বললো, ও কিছু না। মাথাব্যথায় হয়তো। একটু গা গরম হয়েছে। চলো নাস্তা করে নিই।
– আজকাল কী কাগজও নাস্তার রেসিপিতে যোগ হয়েছে! প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কাগজের দিকে তাকিয়ে বললো শাওন।
– হুম। খেয়ে দেখো। পৃথিবীর সবচেয়ে মজাদার খাবার মনে হবে। করোনা মেয়েদের ভালোই ঘরকন্যা বানিয়েছে। বলতে বলতে প্লেটে রাখা কাগজটি খুলে হতবাক। চেয়ার থেকে উঠে নীলাকে কোলে তুলে ঘুরে গেলো একপাক।
– নীলা – নীলা – নীলা! এখানে তো একটি নয়। হাজার হাজার গোলাপে আমার মন, আমাদের ঘর ভরে গেছে। দেখো চারদিকে! কবে আসবে আমাদের গোলাপি?
– সেতো ডাক্তার বলবে। এখন আমাকে নামাও, নাস্তা করে নাও।
উত্তরার ছোট্ট ফ্ল্যাট জুড়ে আনন্দ খেলা করছে। রাত এগারোটার দিকে জ্বর একশো চার ছাড়িয়ে গেলো। নীলার কেমন ভয় লাগছে। মিনহাজকে ফোন দিতেই বলল হাসপাতাল নিয়ে যেতে। হাসপাতালের কথা শুনেই কান্না করে দিলো নীলা।
– মিনহাজ, ওর কী খারাপ কিছু হয়েছে? – এমন ভেঙে পড়ছিস কেন? পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই হাসপাতালের কথা বললাম। ভয় পাসনে আপুনি। আমি আসছি।
জ্বরে ছটফট করছে শাওন। আধঘণ্টা পর এলো মিনহাজ। গাড়ি ছুটছে কুর্মিটোলা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জেনারেল হাসপাতাল…। কোথাও সিট নেই। জ্বর, সর্দি বললেই ডাক্তার, নার্স সরে যাচ্ছে দূরে। নীলার কান্না আর থামে না। মিনহাজের অনুরোধেও কিছুতেই কিছু হয় না। হাসপাতালের আশা ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে ছুটল গাড়ি। ওদের দরজা একেবারেই বন্ধ। দরদর করে ঘামছে শাওন।
– নীলা, গাড়ির গ্লাসগুলো নামিয়ে দাও! বাতাস লাগলে ভালো লাগবে মনে হয়। পূর্বদিক লাল হয়ে জানান দিচ্ছে, দিন আসছে। কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধ, নরোম আলোর সঙ্গে মিশে গেলো শাওন। নীলা নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। মিনহাজ দেখছে এক নিষ্ঠুর ভোর। যার সঙ্গে মিশে আছে একজন ডাক্তারের ব্যর্থতা। কখন যে এক টুকরো মেঘ এসে নীলার নীল সমুদ্র ঢেকে দিয়েছে! কোথায় উড়ে গেলো সাদা মেঘ। কখন যেন পড়া শুরু করেছে টুপটাপ করে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। নীলার ছাদ থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি বেগ বাড়ছে। চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে সেই পানিতে। এ কী, বৃষ্টি নোনা কেন! নীলা বুঝতে পারে বৃষ্টি আর চোখের জল এক হয়ে নামছে দুগাল বেয়ে। পাঁচ মাস আগে ঠিক এইখানেই, পিংক মুন দেখার জন্যে শাওনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল ও। বাসার নিচের সরু গলি, বড়ো দালানের লোকজন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছ সবাই ঘুমোচ্ছিল। নিজের উজ্জ্বল হাসি নিয়ে শুধু জেগেছিল চাঁদ। জেগেছিল শাওন আর নীলা। সেই তীব্র সুন্দর জোছনায় ভিজেছিলো দুজন। আজও নীলা ভিজছে। সেদিনের জোছনার আলো আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। ঝরোঝরো বৃষ্টির ধারা নামছে তার কালো চুল বেয়ে। মুখ ছুঁয়ে। চোখ ছুঁয়ে। শাওন কি মিশে আছে বৃষ্টিতে? প্রশ্নটা কার কাছে? কে দেবে উত্তর? ওপারে শাওনরা কোথায় থাকে! কেমন থাকে! কোনো পূর্ণিমা রাতে আবার এসে দাঁড়াবে কী সে নীলাদের পাশে? ছাদের রেলিংয়ের বাইরে বাড়িয়ে রাখা হাত। আঙুল বেয়ে চোখের জলের মতো বেয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল।