একজন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী, আমার অনেক বন্ধুরা ও আমি
ওঁর নাম ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী, আমি বলি দিদি, ইন্দ্রাণীদি।
ফেসবুকে পরিচয়। এখনও দেখা হয়নি। এমন কি কথাও হয়নি।
অথচ, আমার মতো এক অভাজনের লেখায় সুর দিয়েছেন, কন্ঠ দিয়েছেন।
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী কলকাতার মানুষ। বছর দুয়েক ধরে পারিবারিক কারণে আমেরিকায় অবস্থান করছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে।
ফেসবুকের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া আমার একটা কবিতা পড়ে ইন্দ্রাণীদি মন্তব্য করলেন, এতে সুরারোপ করা যেতে পারে।
ঢাকার এক অতিসাধারণ শখের লিখিয়ের লেখা, তাতে সুর করছেন, কন্ঠ দিচ্ছেন কলকাতার একজন গুণীজন! এবং সেই সুর সৃষ্টি হচ্ছে আমেরিকার পশ্চিম তীর, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়ায় হাওয়ায়! যে দুজনের এখনও দেখা হয়নি, কথা হয়নি!
সত্যিই, এই পৃথিবীতে কতোই না বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে !
ইন্দ্রাণীদির এই ছোট্ট মন্তব্যটুকুই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো আমার ধূসর হয়ে যাওয়া শৈশবে।
ফেসবুক নিয়ে অনেক তীর্যক মন্তব্য শুনেছি। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি নৈতিক কারণে ফেসবুক থেকে দূরে থাকেন এবং থাকার পরামর্শ দেন।
কিন্তু, ফেসবুক না থাকলে আমার এই ষাট পেরুনো বয়সে এতো বন্ধু পেতাম না, এটাও তো সত্যি। এটাও তো সত্যি, পেতাম না ইন্দ্রাণীদিকেও!
চমৎকার গান করেন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। মূলতঃ উচ্চাঙ্গ, রবীন্দ্র ও নজরুল। পাশাপাশি রাগপ্রধানসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। আকাশবাণী কলকাতা ও দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী। এ পর্যন্ত তাঁর পাঁচটি গানের সিডি প্রকাশ হয়েছে। আগ্রহীরা ইউটিউবে ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর গান শুনতে পাবেন।
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতগুরু পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, রবীন্দ্রসঙ্গীতে শিক্ষাগুরু সুচিত্রা মিত্র। সঙ্গীত জগতের এই দুই দিকপাল আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে, তাঁদের আলোকচ্ছটায় যে কয়েকজন সৌভাগ্যবান উদ্ভাসিত হয়েছেন, ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী তাঁদেরই একজন।
সেই ১৯৬১-৬২ সাল। কতোই আর বয়স। পাঁচ-ছয় বছর বয়স।
ভুলে গিয়েছি অনেক কিছুই।
ভুলিনি ধূসর হয়ে যাওয়া সেই স্মৃতি।
ঢাকার মালিবাগের বাসায় প্রতিবেশীদের অনেকেই এসেছে কলের গানের গান শুনতে। আমি কলের গানের বাড়ির ছেলে বলে সব থেকে কাছে গিয়ে কলের গান রাখা টেবিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গান শোনার সুবিধাভোগী! অন্যেরা একটু দূরে। শিশুসুলভ এক ধরণের গর্ব ও আনন্দ আমাকে কি উদ্বেল করতো?
মেজো ভাই পিনের ছোট্ট শক্ত কাগজের বাক্সটা থেকে পিন বের করছে, কুকুরের ছবি সম্বলিত কালো গোল রেকর্ড একটা করে শেষ হলে নুতন পিন লাগিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা হাতির মতো কলের গানের শুঁড়ের মাথায়! অনুরোধ অনুযায়ী রেকর্ড পাল্টে যাচ্ছে। মোটা কাগজের প্যাকেটে একটার পর একটা করে সাজানো আছে রেকর্ডগুলো।
কখনো হেমন্তের কন্ঠে, ‘শান্ত নদীটি যেনো পটে আঁকা ছবিটি…’, কখনো জগন্ময়ের কন্ঠ, ‘তুমি আজ কতো দূরে…’!
তখন সেই পাঁচ ছয় বছরের শিশু মনে কি এমন কোনো ইচ্ছা হয়েছিলো, ‘আহা, আমিও যদি এমন গান গাইতে পারতাম! আহা, আমিও যদি এমন গান লিখতে পারতাম!’
দৃশ্যতঃ এমন ভাবনা শিশুমনে জেগে ওঠার কথা নয়। শিশু মন শুধু মুগ্ধ হয়, বিস্মিত হয়।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা অবচেতন মনের জগত আবিষ্কার করলেন। সে এক বিস্ময়কর জগত। আমৃত্যু অজানাই থেকে যায় সেই অবচেতন মনের গহীনে বসবাস করা বৈচিত্র্যময় রঙিন আবেগগুলোর কথা!
তখন কি ঘুনাক্ষরেও জানতাম, ষাট বছর পরে, ২০২২ সালে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত এক প্রবীণ, ফেসবুক নামক এক অদ্ভুত মাধ্যমে মনের ভেতর জমে থাকা নানান কথা নিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করবো? চেষ্টা করবো কবিতা লেখার?
১৯৭০ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে ব্রাজিল থেকে নেপাল পর্যন্ত অনেক ‘পেন ফ্রেন্ড’ ছিলো। মুক্তি যুদ্ধে সব চিঠিপত্র ঠিকানা হারিয়ে গেলেও কিছু কিছু নাম এখনও মনে আছে।
ব্রাজিলের জোয়েল মোরেইরা, অস্ট্রিয়ার মেইডল রোম্যান, অস্ট্রেলিয়ার (কুইন্সল্যান্ড) জন কোলে, ডাব্লু এ কাল্টহার্ড, কানাডার (কুইবেক) ড্যানিয়েল প্যাটিগ্রু, ভারতের (মাদ্রাজ) কোকিলা গুরুস্বামী ও পি থানগাপ্পান(কোয়েম্বাটুর), নেপালের অনুপ শ্রেষ্ঠাচারিয়া, সিলনের (শ্রীলঙ্কা) বনী টেইলর, আমেরিকার (ডেট্রয়েট, মিশিগান) বেভারলি কান্ট্রিম্যান, চেকোস্লোভাকিয়ার মাডলো জান, জাপানের চেইকো ফুগিমাকি,…… আরও অনেক!
যুদ্ধে হারিয়েছি আমার স্মৃতি বিজড়িত শৈশব!
উদ্ভ্রান্ত যৌবনের আরেক যুদ্ধে হারিয়েছি দিক নিশানা!
জীবনের শেষ বেলায় অলস সময় কাটাতে গিয়ে নুতন করে আবার পাওয়া গেলো বন্ধু!
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী তেমনই একজন।
কারও কারও ভালো লাগবে, এই ভেবেই সব বন্ধুদের জন্য গানটি ছেড়ে দিলাম ফেসবুকের হাওয়ায় হাওয়ায়…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!