একদিন ভিজে যাওয়া বৃষ্টিতে

আজ থেকে ঠিক ২১ বছর আগের কথা। ২০০১ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে বিধায় মেয়ে হলে থাকুক তা আমার বাবা চাননি।তাই উত্তরা টু ভার্সিটি রুটের “ক্ষণিকা” বাসের একজন পার্মানেন্ট যাত্রী হয়ে গিয়েছিলাম।যাহোক। টঙ্গী থেকে ছেড়ে আসা লাল বাসটা ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন স্টপেজ থেকে নিতে নিতে যখন আমার স্টপেজে আসতো। লম্বা চুলের বেনী দুটো দুলিয়ে বন্ধুদের সাথে কলকল করতে করতে লাফিয়ে উঠতাম বাসে। উঠেই বন্ধুদের সাথে বকবক করতে করতে পৌঁছে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেটে। সেখান থেকে হেঁটে ক্যাম্পাস। এই ছিল প্রতিদিনের রুটিন।

একদিন লক্ষ্য করলাম একজোড়া চোখ প্রতিদিনই আমার চলার পথে দৃষ্টি রাখে। সে খুব সম্ভব টঙ্গী থেকে উঠতো। সমাজকল্যাণ না সমাজবিজ্ঞানে পড়তো আজ আর মনে নেই। আমার দুবছর সিনিয়র ছিলো।তার কিছু মেয়ে ক্লাসমেটের সাথে ছিল আমার চমৎকার সম্পর্ক, যেহেতু একসাথেই বাসে আসা যাওয়া করতাম। তারাও ইনিয়ে বিনিয়ে আমার কাছে জানতে চাইতো কাউকে পছন্দ করি কি না, কিংবা কারো সাথে রিলেশনে জড়াবো কি না (এসব আসলে শাফির জিজ্ঞাস্য ছিল। সরাসরি আমাকে বলতে পারতোনা বলেই ইংগিতে বোঝানো আর কি)। ভুলে গিয়েছিলাম- ওনার নাম ছিলো শাফি। যাহোক আমি একসময় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। শাফি ভাই মাঝেমাঝে আমাকে আমার ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন, টুকটাক কথা বলতেন। আমি একদিন ওনাকে বলে ফেলেছিলাম আমার কারো সাথে কোন রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছে নেই। উনি বলেছিলেন- আমি তোমাকে পছন্দ করি; এটা আমার সমস্যা। তোমার যে আমাকে পছন্দ করতে হবে, এমোন কোন কথা নেই। আমি আর কথা বাড়াইনি। একদিন ঝুম বৃষ্টি। আমি ছাতা নিতেও ভুলে গেছি। ইনকোর্স পরীক্ষা। বাস থেকে নেমে দৌড়ে লাইব্রেরির নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরক্ষণেই আঁতকে উঠলাম। দেখি উনিও দৌড়ে আমার পাশে দাঁড়ালেন।

-কি ব্যাপার, এতো বৃষ্টিতে এলে যে?
–ইনকোর্স আছে।তাই।

আমি চিন্তা করছি কি করে ডিপার্টমেন্টে যাবো। একটা রিকশা নেই। হঠাৎ করেই উনি একটা রিকশা পেলেন। আমাকে বললেন – উঠো। আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আপনি কিভাবে যাবেন? উনি মুচকি হেসে বললেন, আমাকে আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিও। আমি “কি?” বলে উঠতে না উঠতেই উনি আমার পাশে বসে পড়লেন। ঝুম বৃষ্টি। রিকশার হুড তোলা, এক পলিথিনের নিচে আমাদের শরীর। আমি যতোই জড়োসড়ো হয়ে বসছি উনি ততোই আমার কাছাকাছি। আমি বারবার কেঁপে উঠছি, শীতে না ভয়ে না কীসে কে জানে। আমি বলে উঠলাম আপনার ডিপার্টমেন্ট পার হয়ে যাচ্ছেতো। উনি বললেন, থাক। তোমাকে নামিয়ে দেই আগে। বলেই উনি আমার আরো কাছাকাছি বসলেন। আমি ওনার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস টের পেয়ে আরো কুকড়ে গেলাম। উনি কানের কাছে মুখ দিয়ে ফিসফিস করে কি জানি বলতে শুরু করলেন। ততক্ষনে রিকশা আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে। আমি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে এক দৌড়ে আধাভেজা হয়ে ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেলাম। মিথ্যে বলবোনা, ধাতস্থ হতে আমার বেশ সময় লেগেছিলো। ফেরার সময় আমি অন্য বাসে ফিরেছিলাম। পরদিন থেকে আমি স্পষ্ট ভাবেই শাফি ভাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। উনি বারবারই আমাকে স্যরি বলতে চেয়েছিলেন। আমি দেইনি সে সুযোগ। আজ ২১ বছর পর আড়ং এ ওনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম আমি। বৌ বাচ্চা নিয়ে শপিং করছেন।একবার ভেবেছিলাম সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো-শাফি ভাই ভালো আছেন? পরক্ষনেই মনে হলো, কি দরকার? অতীত কে অতীতের মতোই থাকতে দেয়া উচিৎ। একদিনের সেই ভিজে যাওয়া বৃষ্টির স্মৃতিকে টেনে আনার কি দরকার? বাইরে আজো ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আজ কোন ভুল করিনি। ছাতা সাথেই আছে।স্মৃতির পুনরাবৃত্তি নাহোক!

(ছবিতে আমি, ছবিটি আমার এক ফ্রেন্ডের তোলা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!