দ্বিতীয় দিন ১৬ই মার্চ, শুক্রবার খুব ভোরে আবদুর রশীদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম সাদা বরফে ঢাকা আলবান্দ পর্বতমালার ওপাশে লাল সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সাদার উপর সূর্যের লাল আভা সে নৈসর্গিক দৃশ্য কেবল দেখলেই অনুভব করা যায়। আর হোটেল কম্পাউন্ডের গাছগুলোতে অপূর্ব সুন্দর বাসন্তী বাহারি ফুল।কিন্তু বেশিক্ষণ প্রকৃতির মনভোলানো সৌন্দর্য দেখা হলো না। বাচ্চাদের ডেকে দ্রুত রেডি হয়ে রওনা হলাম। ঐতিহাসিক ও রহস্যময় জলগুহাটি যেন আমাকে ডাকছিল। ১৪ বছরের ইরান প্রবাস জীবনে অনেক প্রদেশ ঘুরেছি কিন্তু মনের ভেতর তীব্র আকাঙ্খা ছিল এই ‘আলীসাদ্র’ জলগুহাটি দেখার। শহর ছেড়ে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে পাহাড়ী এলাকার বুকচিরে। পথের দুপাশে পাথুরে রূক্ষ্ম পাহাড়। কোথাও কোথাও পাথর কেটে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে টানেল রয়েছে। একটু গা ছমছম করা ভাব অন্ধকার টানেলের ভেতর। রাস্তার দুপাশে মাঝে মাঝে আলু, পিঁয়াজ, আর রসুনের ক্ষেত দেখলাম। এক জায়গায় বিস্তৃত হলুদ সর্ষে ক্ষেত দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। তবে বুঝতে পারলাম না কাঁকর মিশ্রিত মাটিতে কিভাবে ফসল ফলল। আরো কিছুদূর গিয়ে জলপাই বাগান দেখতে পেলাম মাইলের পর মাইল। ইরানে জলপাইকে জয়তুন বলে। ইরানের জলপাই গাছগুলো ছোট সাইজের, ঝোঁপের মত কিছুটা। এই জলপাই ঠিক আমাদের দেশের মত না। সাইজে ছোট এবং স্বাদ কিছুটা কষ টাইপের। এই জলপাই দিয়ে ইরানের বিখ্যাত “রওগানে জয়তুন ” বা ওলিভ অয়েল তৈরি হয়।
আমাদের ট্যাক্সি হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। কোনো বাড়িঘর চোখে পড়ল না, কেবল ছুটে চলা টুরিস্ট মাইক্রোবাস, আর ট্যাক্সি চোখে পড়ল। সকাল নটার দিকে আমরা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সংরক্ষিত এলাকায় ঢোকার জন্য স্ক্যানিং মেশিনে চেকিং এর পর টিকিট কাউন্টারে গেলাম। বিদেশিদের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ ডলার হলেও আবদুর রশীদের চাকরির সুবাদে ইরানি হিসাবে বিবেচনা করল। ১০ ডলার মাথাপিছু দিয়ে টিকিট নিয়ে দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খার সেই প্রাকৃতিক জলগুহার প্রবেশ দ্বারে পৌঁছলাম। সেখানে আমাদেরকে লাইফ জ্যাকেট দেয়া হলো। পরে নিলাম এবং গুহার ভেতর প্রবেশের আগে আরেক দফা চেকিং এর মুখোমুখি হলাম। গেট দিয়ে ঢুকে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আল্লাহর অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি দেখে।
‘আলীসাদ্র’ গুহা
পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে নদী বা লেক। কী শান্ত, স্রোতহীন। ঘাটে বাঁধা সারিসারি নানান রঙের বোট। বোটগুলো তিনটি করে পরস্পরের সাথে বাঁধা। প্রতিটি বোটে ৪ জন করে অর্থাৎ ১২ জনের এক একটা গ্রুপ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। লাল, হলুদ, সবুজ, আর নীল আলোয় এক মোহনীয় পরিবেশ। গুহার ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে সৃষ্টি হয়েছে এই নদী বা লেক। পানির গভীরতা একেক বাঁকে একেক রকম। ৫ ফুট থেকে শুরু করে সাড়ে ২৬ ফুট পর্যন্ত। আর পাহাড়ের উচ্চতা ১৩২ ফুট। বিশেষজ্ঞদের মতে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ বছরের পুরানো এ গুহাটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬৩ সালে। ইরানের একদল পর্বতারোহী এ গুহাটি আবিষ্কার করেন। এপর্যন্ত গুহার ভেতরের লেকটি ২৪ মাইল পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে ট্রায়াসিক যুগের শেষ থেকে ক্রিটেশিয়াস যুগের মধ্যবর্তী সময় যেটাকে জুরাসিক যুগ বলা হয় সেসময়ের এ গুহাটি। গুহাটির ভেতর খনন কাজ চালিয়ে এমন বেশ কিছু নির্দশন পাওয়া গেছে যা থেকে বোঝা যায় যে সেলজুকিয় শাসনামলে এই গুহাতে মানুষ বাস করত।
বোটে উঠে বসলাম, বোট এগিয়ে চলল আমাদের ১২ জনের দলটি নিয়ে। উপরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হলো যদি লাইট অফ হয়ে যায় কিংবা ভূমিকম্প হয়ে গুহামুখের দরজা বন্ধ হয়ে যায়… ! হয়ত হাজার বছর পর আবার আমাদের কঙ্কাল আবিষ্কার হবে আর আমরা স্থান পাব ইতিহাসের পাতায়। এখানে কিছুক্ষণ থাকলে কবরের অন্ধকার, শীতলতা আর নিস্তব্ধতা অনুভব করা যায়।একটু ভয় পাচ্ছিলাম তালহা রোদোসি ভয় পাচ্ছে কিনা। কিন্তু ওদের হাসিখুশি মুখ দেখে নিশ্চিত হলাম। কিন্তু আঃ রশীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখটা কেমন শুকনো শুকনো আর চোখ দুটো যেন ভয়ে ছানাবড়া। ওর এই ভীত ভাব নিয়ে আমি ও ছেলেমেয়েরা এখনো মজা করি।
আমরা শীতের ভারী কোট পরে ছিলাম কিন্তু অনুভব করলাম বাইরে যে হিমাঙ্কের নিচে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল গুহার ভেতরে ঠিক ততটা না; ঠাণ্ডা তবে সহনীয়। আমরা লাইভ জ্যাকেট খুলে ফেললাম। সুনসান নীরবতা ভেদ করে আমাদের বোট এগিয়ে চলেছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে। গাইড মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছে; বিবরণ দিচ্ছে। কোথাও কোথাও পথ এত সুরু যে ভয় পাচ্ছিলাম এই বুঝি দেওয়ালে ধাক্কা লেগে বোট উল্টে গেল। আবার কোথাও বা দেয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়ার মত অবস্থা। বোটগুলো যাওয়ার রুটও ভাগ করা আছে। আাধা ঘন্টা চলার পর একটা স্টেশনের মত জায়গায় থামাল বোট। প্রায় ৫০০ মতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। সিঁড়ির দুপাশে পাথরের দেয়ালে পানির ফোঁটা জমে জমে বিভিন্ন আকৃতির স্পাইক তৈরি হয়েছে। দেখলে মনে হবে লাখ লাখ মোমবাতি গলে এগুলো তৈরি হয়েছে। সাদা চকচকে ক্রিস্টালও তৈরি হয়েছে কোথাও কোথাও। তার ওপর বিভিন্ন রঙের আলোর আভা যে মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা সত্যিই বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কেবল দেখে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম সেখানে বসার জায়গা করা আছে।চারদিকে নিয়ন আলো আধাঁরীতে এক নৈসর্গিক পরিবেশ। মনে হচ্ছিল লাখ লাখ লাল, নীল, সবুজ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। আমরা ফ্লাক্স থেকে চা বের করে খেলাম। তালহা রোদোশী চিপস, স্যান্ডউইচ খেলো। আমাদের পাশেই একটা ইরানি পরিবার ছিল। কথা বললাম তাদের সাথে। বাচ্চাদের সাথে ছবি তুললাম। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা আবার নীচের দিকে রওনা হলাম বোর্টের উদ্দেশ্যে। একবার মনে হলো ইচ্ছে করে হারিয়ে যাই, কিভাবে রেসকিউ করে দেখার ইচ্ছা হলো। কিন্তু গাইডের সর্তক দৃষ্টি এড়িয়ে সম্ভব হলো না। বোর্টে এসে বসলাম। পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখলাম। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে ৫ মিটার পর্যন্ত দেখা যায় গাইড জানালো। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল গাইডের ডাকে। দেখলাম ঘাটে পৌঁছে গিয়েছি। অন্যান্য টুরিস্টরা অপেক্ষা করছে বোর্টে ওঠার জন্য। আমরা নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম… আলোকময় পৃথিবীর দিকে।
গাড়ি চালকের ভালোবাসা ও উদারতা
সবশেষে একজনের কথা না বললে আমি স্বস্তি পাব না। তিনি হলেন আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার। মাহমুদ নামের ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক যে আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা আমি কখনই ভুলব না। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। বড় দু’জন ডাক্তার আর ছোট মেয়েটি তেহরান ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। হোটেলে পৌঁছে ভাড়ার যে হিসাব দিলেন তাতে দেখলাম ২০ ডলার কম নিয়েছেন তিনি। সেদিনই সন্ধ্যায় ফিরব শুনে তিনি বললেন, আমি তোমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেব। আমরা ১৫ ডলার দিয়ে একটা গিফট কিনে দিলাম তাঁকে। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। একটা গান বাজছিল ” তানহা গুজাসতে, মান চিতুর মিমুনাম, দোবরে মিবিনাম মান মনতাজের মিমুনাম।বাংলা অর্থ হলো — একা রেখে তোমরা যাচ্ছ, আমি কিভাবে দিন কাটাব, আবার দেখা পাব সে আশায় থাকব। ” তিনি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ভাড়াও নিলেন না। বললেন, তোমরা আমার দেশে মেহমান। অজানা অচেনা এই বিদেশিদের জন্য যে আন্তরিকতা ও সৌজন্যতা তিনি দেখিয়েছেন তা কখনই ভুলব না। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে। কানে বাজতে থাকল ” তানহা গুজাশতে, মান চেতুর মিমুনাম…