আচ্ছা, যদি হাতে পেন্সিল নিয়ে প্রথম লেখা হাতে খড়ি হয় তবে কি মনের টানে প্রথম গল্পের বই পড়া কি মনে খড়ি হবে? রবি ঠাকুর লিখেছেন কান পেতে রই, তবে চোখ পেতে রই লেখা যাবে?
যাই হোক, আমার গল্পের বই পড়ার মনে খড়ি আব্বার নিকট থেকে। আপা, ভাইয়াদের গল্পের বইও চুরি করে পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে মার খেলাম একদিন। তখন আব্বা লাইব্রেরি থেকে ক্লাস থ্রির বাচ্চাদের উপযোগী বই এনে দিলেন,। সিন্দাবাদের কাহিনী। বই পড়ে মনে হয়েছিল সিন্দাবাদের মত জাহাজ নিয়ে সাগরে সাগরে ঘুরতে না পারলে জীবনই বৃথা। সেই শুরু…. এরপর গালিভার ট্রাভেল।রাতে মাঝে মাঝে আব্বার কাছে ঘুমাতাম, বায়না ধরতাম গল্প বলার। ছোটদের উপযোগী গল্প বলতেন। মাঝে মাঝে তাঁর চাকরী জীবনের গল্প। আব্বা ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন। লাহোর, বেলুচিস্তান, ও কাশ্মীরের গল্প করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। তখন মনে হতো আব্বার মত আর্মিতে চাকরি করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বড় হওয়ার সাথে সাথে আব্বার গল্প বলার ধরনও পাল্টে গেল। তখন মনে হতো ইবনে বতুতা কিংবা কলম্বাসের মত স্বাধীনভাবে নানা দেশ ঘুরে বেড়ালেও মন্দ হয় না। বিভিন্ন সমাজ, জাতির জীবন যাপন দেখব।
বঙ্কিম চন্দ্রের দেবীচৌধুরানীও হতে ইচ্ছে হয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে পড়ে ফেলেছিলাম এক নিমিষেই। আব্দুর রহমানের সেই উক্তি যেন এখনো কানে বাজে ” ইন হাস্তা ওয়াতানাম।” একরাতেই পড়ে শেষ করেছিলাম আন্দিজের বন্দি বইটি। মনে মনে সেই হতভাগা যাত্রীদের সাথে আমিও ছিলাম সেই বরফের ভেতর। ওয়েস্টার্ন সিরিজে যখন স্টেজকোচ ডাকাতি হত সেই সময় আমিও সেই কোচের যাত্রী থাকতাম।
আমি এক একটা বই শেষ করতাম আর সেই চরিত্রে নিজেকে কল্পনায় দেখতে পেতাম। ভ্রমন কাহিনীতে আমিও যেন সেই চরিত্রের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে জীবনের লক্ষ্যও পরিবর্তন হয়েছিল। ধীরে ধীরে বাস্তবতা উপলব্ধির সাথে সাথে ছোট হয়ে এসেছে জীবনের লক্ষ্য। কিন্তুু মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ছোট বেলার সেই লক্ষ্য,, আশা, আকাঙ্খা যেন আজো সুপ্ত অবস্থায় মনের ভেতর লুকিয়ে আছে।তাই হয়ত আজ আমার ১৭ বছর প্রবাস জীবন মহান আল্লাহ উপহার দিয়েছেন। ১৭ বছরে ইরানের বিভিন্ন প্রদেশ বেড়িয়ে যে কেবল রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ও মনোমুগ্ধোকর দৃশ্যই উপভোগ করেছি তাই না। বরং বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সাথে মিশে তাদের মানসিকতা, ব্যবহার, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে জানতে পেরে পুলকিত হয়েছি। বিভিন্ন ট্যুর শুরু হয়েছিল যেমন আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে,আবার রাস্তায় দৌড়ে বাস ধরার মধ্যদিয়ে নাটকীয়তার দৃশ্যও রয়েছে। রয়েছে পাতাল রেলের গেট বন্ধের এক সেকেন্ড আগে দৌড়ে গিয়ে রিক্স নিয়ে ব্যাগ ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে অটোমেটিক গেট খুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা।
আমার মাস্টার্স পরীক্ষা চলাকানীন সময়ে হাতে এসেছিল ডঃ আনিস সিদ্দিকী সাহেবের ইরান নিয়ে লেখা ” যখন আমি রাজা ছিলাম “, ” যখন আমি শাহজাদী ছিলাম “। সেই সময় প্রথম ধারণা পেয়েছিলাম শাহ পরিবার ও রেজা শাহ পাহলভী সম্পর্কে।
পথের পাঁচালী র অপু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত বিলাতের ডায়েরি পড়ার জন্য। সপ্তাহিক পত্রিকার অপেক্ষায় থাকত সে।
আমার লিখতে ইচ্ছে হলো ইরানের ডায়েরি…
ইরানের ডায়েরি
হামেদান কথা – ২০১৮
প্রথম পর্ব
নওরোজের ছুটি শুরু হয়েছে। নববর্ষকে ফার্সি ভাষায় ‘নওরোজ’ বলে। ছুটি অথচ বেড়াতে বের হব না এটা বিরল ঘটনা আমাদের জীবনে। ঠিক করলাম এবার হামেদানে যাব।
তেহরান থেকে ৩২০ কিমি দূরে ইরানের একটি ছোট্ট প্রদেশ। ছোট হলে কি হবে, শহরটি বিশ্বখ্যাত কারণ এখানে আছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলগুহা যা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নদীর মতো ঠিক নদী বললে হয়তো বেশি বলা হয়ে যাবে তবে লেকের মত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এ জল গুহাটির নাম ‘আলীসাদ্র’।
১৫ মার্চ, ২০১৮ বৃহস্পতিবার
আমরা খুব ভোরে রওনা হলাম হামেদানের উদ্দেশ্যে। ৪ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম। আইআরআইবির হামেদান সম্প্রচার কেন্দ্রের কম্পাউন্ডেই রেডিও তেহরানের ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেল আছে, সেখানে গিয়ে উঠলাম। আলবান্দ পর্বতমালা দিয়ে পরিবেষ্টিত ছোট শহর হামেদান কিন্তু খুবই পরিচ্ছন্ন ও শান্ত পরিবেশ। প্রায় ৫,০০০ বছরের পুরানো এ শহরবাসীর প্রধান ভাষা ফার্সি, লোরি ও কূর্দি। লোকসংখ্যা ১মিলিয়ন ৭ লাখ ৫৮ হাজার।
আলী সাদ্র গুহা
এই হামেদানেই রয়েছে দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মহান ব্যক্তিত্ব আবু আলি সিনার (ইবনে সিনা) সমাধি। ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ইবনে সিনা। তাঁর পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ইবনে সিনা’র সমাধিতেই গেলাম প্রথমে।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় এক অন্যরকম অনুভূতিতে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। মোহগ্রস্তের মত এলোমেলো পায়ে ঢুকে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম সমাধির পাশের বাগানে একটা অদ্ভূত সুন্দর গাছের তলে। গাছটার নাম জানিনে। বসে ভাবছিলাম ইবনে সিনার কথা। আনন্দে চোখে পানি এলো। বারবার মনে হচ্ছিল এতকাল যার কথা কেবল বইএ পড়েছি সেই ইবনে সিনার সমাধির পাশে আমি বসে আছি!
ছেলে তালহার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে হাঁটতে থাকলাম রশীদ আর ছেলে মেয়ের সাথে। কিছু ছবি তুললাম, ঘুরে ঘুরে দেখতে প্রায় একঘন্টার মত লাগল। ওখান থেকে বের হবার আগে আবারো বসে থাকলাম সিঁড়িতে কিছুক্ষণ। মনে করার চেষ্টা করছিলাম ওনার সম্পর্কে কি কি পড়েছি, কিন্তু মাথাটা আবারো এলোমেলো লাগল। কিছুই মনে করতে পারলাম না। আসলে আমার অনুভূতির কথাটা ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারছি না।
এরপর গেলাম ‘উরিয়ন’ নামে বিখ্যাত বাবা তাহের হামেদানি’র সমাধিতে। বাবা তাহের ছিলেন একজন মরমী কবি। তাঁর কবিতার বক্তব্য ছিল একেবারেই সাদামাটা। তাঁর কবিতা এখনো বিভিন্ন ভাষায় অবশিষ্ট আছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও দরবেশ। ইরানে বিশেষ করে হামেদানে তিনি দরবেশ বাবা নামেও পরিচিত। ওখানে কতর্ব্যরত কর্মকর্তা জানালেন যে, বিদেশিদের জন্য ১০ ডলার করে টিকিট তবে রশীদ কার্ড দেখালে তিনি ইরানি হিসাবে বিবেচনা করে জনপ্রতি ১ ডলারের কিছু কমের সৌজন্য টিকিটে আমাদেরকে প্রবেশ করতে দিলেন। ওখান থেকে অনেকগুলো বই, কার্ড উপহার দিলেন। তালহা রোদসীকে দিলেন ছোটদের উপযোগী গিফট৷এখানেও ফুলবাগানে কিছুক্ষণ বসলাম। চারদিকটা ঘুরে দেখতে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। এরই মধ্যে রোদ কিছুটা পড়ে এসেছে…বাতাসটাও বেশ নরম, হালকা ঠাণ্ডা।
দুপুরের খাওয়ার জন্য আমরা একটা হোটেলে ঢুকলাম। হেটেলটি দেখে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। ঝরণার পাশে খুবই পরিচ্ছন্ন, গাছগাছালিতে ভরা কাঠের দুতলা। ব্যালকুনিতেও বসার জায়গা করা, কার্পেট পেতে বালিশে হেলান দিয়ে বসে নীচু টেবিলে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। এটা ইরানের বহু পুরানো ঐতিহ্য। ওয়েটার এসে মেন্যু দিয়ে গেল। খাবারের দাম দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তেহরানের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি খাবারের দাম। আমি উঠে দাঁড়ালাম মন খারাপ করে। আমার মন খারাপ দেখে আবদুর রশীদ বলল, প্রতিটি দেশেই টুরিস্ট স্পটে সবকিছুর দাম বেশি থাকে স্বাভাবিকের তুলনায়। সুতারাং এখানেই খেয়ে নাও, কিন্তু আমার মন সায় দিল না। ঠিক ঐ মুহূর্তে পকেটের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হলাম। ভাবলাম খাবারদাবারের পিছনে এত ব্যায় না করে বরং ঘোরাঘুরির পিছনে খরচ করি। তাই উঁচু দামের হোটেলটা থেকে বের হয়ে আমরা একটা ছোট ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকলাম। বার্গার খেলাম। তালহা রোদসী বাড়তি চিকেন আর ফ্রেন্স ফ্রাইজ খেলো। আমরা ড্রাইভারকেও ডেকে নিয়েছিলাম। তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন কিন্তু কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে খাচ্ছিলেন। আবদুর রশীদ সহজ করার জন্য হামেদান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলো। ইন্ডিয়ান মনে করে খেতে আসা আরেকজন ভদ্রলোকও যোগ দিলেন রশীদের আলোচনায়। আমরা তাদের ভুল ভাঙিয়ে দিলাম। বললাম, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়া। একসময় আমরা ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের একটি অংশ ছিলাম ঠিকই, পরে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা এনেছি।
রোদসী ও আমার জন্য রাইডিং কেডস কেনার দরকার ছিল। মার্কেটে গিয়েও মনটা আরেকদফা খারাপ হলো। আসলে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে দামের তুলনা করা। ইরানে গিয়ে প্রথম দিকে দেশের দামের সাথে তুলনা করতাম আর এখন এখানে তেহরানের সাথে। রশীদ বিরক্ত হয়ে বললো টুরিস্ট এলাকায় দাম বেশি থাকে দুনিয়ার সব দেশে। প্রয়োজন যেটা সেটা তো কিনতে হবে। কিনে নিলাম কেডস আর টুপি। এরপর গাইড নিয়ে গেল একটি ঝর্ণার কাছে। আলবান্দ পর্বতমালার মাঝামাঝি উপরে এ ঝর্ণাটির কাছে পৌঁছাতে বেশ কষ্ট হলো। প্রায় ৫০টির মত সিঁড়ি টপকে সেখানে পৌঁছলাম। ঝরণার একপাশে খানিকটা উপরে বিশাল পাথরে খোদাই করে প্রাচীন ফার্সি ও ব্যাবিলনিয় হরফে কিছু লেখা রয়েছে।ফার্সিতে একে বলে গাঞ্জনমে (শিলালিপি)।
ওই শিলালিপিতে লেখা রয়েছে হাখামানেশীয় রাজবংশের দুই রাজার বিজয় গাঁথা। তার একজন হলেন রাজা দারিয়ুস যার নাম আমাদের কাছে পরিচিত। এখানে অনেক বিদেশি পর্যটকের দেখা পেলাম। বিশেষ করে জাপান ও চীনের বেশ কিছু মহিলা। সাথে তাদের ছেলেমেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। কয়েক জন ভারতীয়কেও দেখলাম। এক সালোয়ার কামিজ পরা মহিলা সামনে এসে বললেন, তোম দিল্লিসে আইয়ে অর লাহোরসে ? আমি হটাৎ এ প্রশ্নে বিব্রত হয়ে গেলাম, মহিলা হাসিমুখে তখনো তাকিয়ে আছেন। হেসে বললাম, মে বাংলাদেশ থে আয়া। আমার উর্দূতে আমিই কনফিউশানে ছিলাম , হেসে আবার বললাম “আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ।” মহিলার সাথে বেশ আলাপ জমে উঠল। কথা বলে জানতে পারলাম মহিলা তেহরানে বোনের কাছে বেড়াতে এসেছেন; পাকিস্তানি। বোন ছুটি না পাওয়ায় একাই এখানে চলে এসেছেন। আরো কিছু কথাবার্তার পর মহিলা বিদায় নিলেন।
বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় এক মায়াময় পরিবেশে ঝর্ণার হিমশীতল পানিতে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম।ঝরণার পাশেই একটা গাছে বুলবুলির দেখা পেলাম। পাহাড় থেকে নিচে নেমে এসে একটা টল দোকানে বসলাম। আমাদের দেশে যেমন ছোট ছোট টল দোকানে চা বিস্কুট, সিঙ্গারা, সমুচা বিক্রি হয় তেমনই একটা দোকানে গেলাম। তবে এখানে বিক্রি হয় শালগম সিদ্ধ, লাল বিট সিদ্ধ আর ভুট্টা সিদ্ধ। সিদ্ধ করা ভুট্টার সাথে পনির, লবণ, সস আর লেবুর রস মিশিয়ে খেতে বেশ সুস্বাদু। এরপর লাল চা খেলাম। সন্ধ্যার দিকে হেটেলে ফিরলাম। এভাবেই কেটে গেল প্রথম দিন।