ক্যান্সার (পর্ব৪)

Photo of author

By Khugesta Nur E Naharin

“পেট সিটি স্ক্যান” মূলত ক্যান্সার সেল নির্ণয়নে সমস্ত শরীর ব্যাপী এক ধরনের পরীক্ষা।
মেটাস্ট্যাসিস বা শরীরে ছড়িয়ে পরেছে কি না, আর কোথাও আছে কি না সেই পরীক্ষা।

দীর্ঘ সময় ব্যাপী পরীক্ষা চলাকালীন শরীরে রেডিয়েশন ঢুকিয়ে রোগীকে আলাদা ঘরে রাখা হয় কয়েক ঘণ্টার জন্য। ২৩ বছর বয়সী একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কোথায় ক্যান্সার ধরা পরেছে মা ? মেয়েটি আঁতকে উঠে উত্তর দিল ”আমার ক্যান্সার অথচ আমাকে জানানো হয়নি।” নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হল মুহূর্তটিতে। এতো কষ্টের মধ্যেও আপাতত স্বস্তির খবর হল আমার শরীরের আর কোথাও কোন ক্যান্সার সেল পাওয়া যায়নি।

কাছের অনেক মানুষই ফোন করছেন কিছু লোক বিশ্বাসই করতে পারছেন না আমার ক্যান্সার হতে পারে। কেউ কেউ অভয় দিতে বলছেন মৃত্যুকে ভয় পেও না।
আমার গলায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নেই দেখে অবাক হচ্ছেন কেউ কেউ।

মৃত্যুকে ভয় পেয়ে কি লাভ?
জীবনে একটাই নিশ্চিত বিষয় তা হচ্ছে মৃত্যু।
একজন নারী জন্মের পর থেকে হাজারো বার মরে।

প্রথমবার মরলাম, ৮ বছর বয়সে আব্বার হাত ধরে মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনার জন্য যখন অষ্টমীর মেলায় গেলাম, নোংরা কদর্য লোভাতুর একটি হাত আমার ছোট্ট শরীরটাকে ভিড়ের চাপে নিমিষের মধ্যে খুবলে খেলো, তারপর দ্রুত আড়াল হল । শিশুর শরীরে তোরা কি মজা পাস পিশাচেরা। আমি আব্বাকে কিছু বলতে পারলাম না। অনেকদিন মন খারাপ, একদিন ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে আম্মা প্রশ্ন করলেন ” কি হয়েছে?” কিন্তু শুনলে আম্মা ভীষণ কষ্ট পাবেন আব্বাকে বকবেন ভেবে কিছুই জানালাম না আমি। কেবল দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললাম, “কিছু হয়নি।”

দ্বিতীয়বার মরলাম, মধ্য ১৯৯৩তে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে থিসিসের কাজ গুছানোর জন্য অর্গানিক কেমিস্ট্রি ল্যাবে কাজ করছি। সেদিন আমার গায়ে ১০৩ ডিগ্রী জ্বর, টাইফয়েড। শরীর আরও খারাপ হতে পারে ভেবে ল্যাবে এসেছি স্যাম্পল গুলো গুছিয়ে রাখতে। সময় সকাল ১১ টা । পাশাপাশি তিনটি রুম শিক্ষক, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং ছাত্র-ছাত্রী দ্বারা ভরপুর থাকার কথা। কিন্তু আজ খানিকটা ফাঁকা। বসে বসে টেস্ট টিউবে লেবেল লাগাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে জাপটে ধরে কিছু বুঝার আগেই ঠোঁট দুটো শুষে নিল কেউ । ধাক্কা দিয়ে সরাতেই অবাক চোখে দেখলাম আমার সহপাঠী এফ এইচ হলের মহিদুল হাসান ফটিক। জ্বরে এমনিতেই মুখটা তিতা হয়ে আছে উপরন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় ওর মুখে এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিলাম। ঘটনাটি এই পর্যন্ত হলে হয়ত মাফ করার কথা চিন্তা করা যেত।

কিন্তু ফটিক এটুকুতেই থেমে থাকেনি। বীর দর্পে জাবের আব্দুল্লাহ, রফিক, ফাহিয়ান,ফিরোজ,মুনির, ইমরান, বিমলেন্দু ভৌমিক সহ আরও অনেককে ক্যান্টিনে যেয়ে বলেছে, ”তোরা আজ আমাকে বিরিয়ানি খাওয়া আমি মুন্নির ঠোঁটে চুমু খেয়েছি।” এফ এইচ হলের আরও অনেকেই এই ঘটনার সাক্ষী। নিজের বীরত্ব আর পৌরুষ প্রকাশ করতে একে একে ক্লাসের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সে নিজ মুখেই ইভ টিজিং এর গল্প শুনিয়েছে।

হলে রুমে ফিরে গুনে গুনে ১০০ বার ডলে ডলে সাবান দিয়ে মুখ ধুলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো চামড়া টেনে ছিঁড়ে ফেলি। আমার রুমমেট পুটু মণিকে জানালে ও’ কান্নায় ভেঙ্গে পরে জানালো ওর জীবনেও এমন এক ঘটনা আছে। আমরা দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। প্রায় ১৫ দিন কারো সাথে কথা বললাম না, এমন কি রুম থেকে বাইরে বের হওয়াও ছেড়ে দিলাম।

ফটো এ্যালবাম বের করে ক্লাসমেটদের সাথে যত ছবি আছে কেচি দিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কেটে চুলায় জ্বালিয়ে দিলাম। আমার এ্যালবামে এক যৌন নিপীড়কের ছবি থাকার প্রশ্নই উঠে না।

বার বার মনে হচ্ছিল সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মাস্টার্স পাশ একজন নারীও সমাজের কাছে কতোটা অসহায়। তাঁর মানে পরবর্তী কর্মক্ষেত্রেও বার বার আমায় এমন সিচুএশন ফেস করতে হবে। একজন নারীর রূপ আর দেহই কি তবে তাঁর প্রধান শত্রু। পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি সহ্য করতে করতে তাঁদের যৌন লালসার শিকার হতে হবে আজীবন।

এই লুচ্চা বেয়াদব ইভটিজার রেপিস্ট নাকি শুনছি যোগ্যতা না থাকলেও ইদানীং বিএনপি থেকে এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যদিও ছাত্র জীবনে জাসদের রাজনীতি করলেও ব্যক্তিগত নীতি আদর্শের কোন বালাই ছিল না। নমিনেশনের জন্য বিভিন্ন দুয়ারে ধর্না দিচ্ছে। এমন বদমাইসরা জনপ্রতিনিধি হলে এলাকার কেউ আর খালি পেটে থাকবে না। বাস্টার্ডে ভরে যাবে গোটা সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, আল্লাহ্‌ মালুম কত ছাত্রীর ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে ইতোমধ্যে।

প্রায় ৩০ বছর আগে ৯৩র সেই সময়টাতে নিরীহ আমার এতো সাহস ছিল না । আমার শিক্ষক ডক্টর মশিউজ্জামান ও নিলুফার নাহার আপার তত্তাবাধনে তখন থিসিস করছি। ডক্টর মসিউজ্জামান বিজ্ঞান অনুষদের ডীন সেই সময়টাতে । স্যার ভীষণ নীতিবান মানুষ আমি কমপ্লেইন করলে ওর ছাত্রত্ব চলে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু ঘটনাটি ভিসি অফিস হয়ে পুরো বাংলাদেশে পত্রিকায় ফ্রন্ট পেজে আসবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য ওই হারামজাদা মনগড়া প্রেমের গল্প সাজাবে হয়তোবা।কৌতূহলী মানুষ পক্ষে বিপক্ষে মুখরোচক অনেক রটনা রটাবে । অবিবাহিতা তরুণী কন্যা, আমি সইতে পারলেও আমার পরিবার সইতে পারবে না।

আমার স্বামী জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু কে লজ্জা আর গ্লানিতে কোনদিন বলতে পারিনি। তা ছাড়া ভয় ছিল টিংকু মারতে মারতে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির ফটিককে একেবারে থেঁতলে ফেলবে।

সম্পূর্ণ অ্যানটাচ পুরুষ স্পর্শ বিহীন নারীর উপর যখন জুলুম হয়, যৌন নির্যাতন হয় তাঁর পরবর্তী যৌন জীবনে ঋণাত্মক প্রভাব পরে, প্রচণ্ড ভাবে ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। স্বামীর সাথে আদিম উন্মত্ততায় মেতেছি বহুবার কিন্তু ঠোঁট নিষ্ক্রিয়ই থেকে গেছে। ঠোঁট থেকে চিরতরে অনুভূতিটাই হারিয়ে গেছে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর ঘৃণায়।

আজ এতো বছর পর লেখতে বসার একটাই কারণ, মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার সাথে কথোপকথন, সমাজ সংসার কে কি বলল কে কি ভাবল সবকিছু এখানে তুচ্ছ।

মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে তিনি যদি আমায় প্রশ্ন করেন, “অন্যায় জেনেও তুমি প্রতিবাদ করনি কেন? একটা ধামাকা সেই সময় হয়ে গেলে নুসরাত, তনুকে এইসব রেপিস্টদের হাতে এভাবে নৃশংসতায় যৌন লালসায় মরতে হত না। আমি তো তোমায় দায়িত্ব দিয়েছিলাম পালন করলে না কেন?”

হ্যাঁ, প্রতিবাদ করা আমার দায়িত্ব ছিল।সেদিন প্রতিবাদ করলে আজকের তরুণীরা আরও আগে অনেক বেশী সাহসী হত।

বন্ধুদের মুখে শুনেছি অজোপাড়া গাঁ থেকে আসা ফটিকের প্রথম অভিজ্ঞতা শুরু হয় পাট ক্ষেত কাঁপিয়ে ক্লাস নাইনে পড়া সময়কালে। সাক্ষ্য প্রমাণ সব হাতে রেখেই লিখছি চিন্তা করো না। তুমি চাইলে সত্যতার প্রমাণ দিতে এগিয়ে আসা লোকের অভাব নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য এই নোংরা চরিত্রের সহপাঠীর সাথে পড়তে হয়েছে।দুঃখজনক অশ্লীল ইভ টিজিং এর শিকার হতে হয়েছে।

শুনেছি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পোস্টিং থাকা কালিন অনৈতিক কাজে ছাত্রদের হাতে ধাওয়া খেয়ে বেক্সিমকোয় কর্মরত বন্ধু রফিকের কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ১ মাসের জন্য। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে কলেজ ক্যাম্পাসে ফেরত গেছে।

হাতে সময় কতোটুকু বাকি আছে জানা নেই, মৃত্যুর পূর্বে জীবনের প্রথম চুমুর ঋণ শোধ করে যাবো না তা কি করে হয়?

সেদিন তুমি কার্জন হলের সকলের সাথে বীর দর্পে খুশীর খবর জানিয়েছিলে । আজ এতো বছর পর এই দেখো আমিও স্বীকার করে নিলাম। সেদিন তুমি এক প্লেট বিরিয়ানি খেতে চেয়েছিলে বন্ধুদের কাছ থেকে, আজ তোমার অগণিত ছাত্র-ছাত্রী তোমাকে বিরিয়ানি অফার করবে পেট পুরে খাও।

চলবে