ক্যান্সার (পর্ব২১)

Photo of author

By Khugesta Nur E Naharin

বিয়ের পর ১৬ ই অক্টোবর আমাদের চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা । গ্রীন লাইন বাসে চেপে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। মাঝপথে মেঘনা নদীতে ফেরি পারাপার, সব মিলিয়ে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টার জার্নি।সকাল বেলা নটরডেম কলেজের সামনে থেকে বাসে উঠেছি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ।

আজ আমি পরেছি রাজশাহী সিল্কের নরম একটি শাড়ি। পাশাপাশি বসে টিংকু আমায় বলল একটি কাহিনী তোমায় জানিয়ে রাখি,”আমাদের পরিবারে সবাই অনেক ফর্সা। এ বাড়ির প্রথম কালো বউ হচ্ছে আমাদের গুঁড়া মা (ছোট চাচী) যাকে পালকী থেকে নামাতে যেয়ে আমার দাদী ফিট হয়ে গিয়েছিল। ছেলের বউ কালো এটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তুমি তৈরি থাকো যদি তোমাকে দেখে আমার মা ফিট হয়ে যায় মন খারাপ কর না।”

বাকি পথটুকু ভীষণ চিন্তায় ছিলাম সত্যি সত্যি আমার শাশুড়ি কি রিয়েক্ট করেন। শাশুড়ি আমায় দেখে ভীষণ খুশী হলেন। ছোট্ট খাটো একজন মানুষ আমায় জোড় করে টেনে কোলে বসাতে চাইলেন। আমি বললাম আমায় শুকনা দেখালেও ওজন অনেক আপনার কষ্ট হবে মা’ ।

এ কদিন আমার কানে আসতে থাকা কথা ”বউ কালো” র সাথে ”বউ ভীষণ মিষ্টি করে কথা বলে” আসতে থাকলো। যিনিই আমার সাথে কথা বলেন তিনিই মুগ্ধ হয়ে বলেন কি সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটি অর্থাৎ আমার বাচন ভঙ্গী,কথা বলার ধরন সবার মন জয় করে নেয় নিমিষেই।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক’জনার, কারণ আমার মাঝে ট্র্যাডিশনাল বউ বউ ব্যাপারটি নেই। আমি লজ্জা পাচ্ছি না, নতুন বউ হিসেবে আমার ভেতর যে ভীতি থাকার কথা ছিল তাও অনুপস্থিত। আত্মবিশ্বাসী আমাকে ডমিনেট করতে অসুবিধা।

কোন একজন আমাকে বললেন, ”তোমার পরিবার আমাদের ভাইকে ঠকিয়েছে।” আরেকজন বললেন বিয়েতে মাত্র ৪৫ জন বর যাত্রী এলাও করেছে, অথচ চট্টগ্রামের সাধারণ পরিবারের বিয়েতে কয়েক শত বর যাত্রী যায়।

রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে আমার বিয়েই প্রথম। অনেক কষ্ট করে তাড়াহুড়োয় আমার ভাই এরেঞ্জ করেছেন। তা ছাড়া আমার পরিবার আমাদের মাফ করে দিয়ে বিয়েটা মেনে নিয়েছে এতেই আমি বেজায় খুশী।

সব সহ্য করতে পারি কিন্তু নিজ পরিবারের অসম্মান একটুও না। শান্ত স্বরে জবাব দিলাম আমার পরিবার বিয়েটাকে মেনে নিয়েছে, সমাজিকভাবে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এটাই তো বেশী।

এখানে সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভাষা। ওরা যাই বলে তাই আমার কানে কর্কশ শুনায় । এমনিতেই ভাষা বুঝি না তার উপর দ্রুত গতিতে হরবর করে যা বলে আমার কাছে গালির মত লাগে।আমার সামনে ওরা নিজেরা যে চাঁটগাইয়া ভাষায় কথা বলে সেটাতেও অস্বস্তি হয়।

পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কর্ণফুলি নদী তীরবর্তী সাগর নদী পাহাড়ের সংগমস্থল বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের মানুষরা ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যে আগানো আর সচ্ছল বলে ভাবে দেশের মধ্যে তারাই সেরা। অন্য সবাই নোয়াখাইল্লা, বিদেইশসা নতুবা বইঙ্গা (এগুলো মূলত গালি)। অন্য অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মূলত ছোট করা । তাঁদের কথার আগে গালি ছুটে, গালি দিয়ে কথা বলাটা ওদের এক প্রকারের স্বভাব জাতো দম্ভোক্তি।

আমার শাশুড়ি আমায় বলে দিয়েছেন যখন আমি না বুঝি তখন যেন তাঁকে বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করি।তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা নেন ”কি বলেছি আমি বলতো।” আমি হেসে বলি ”বুঝিনি।” তিনি অনেকবারে বুঝিয়ে বলেন।

ইন্টারপ্রেটর হিসেবে টিংকুর ভাই-বোনের ছেলে-মেয়েরা আমায় সাহায্য করে। এ বাড়ির ছোট্ট নাহিদ আর আশা (টিংকুর দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে) আমার গা ঘেঁষে থাকে সারাক্ষণ।

টিংকু আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে শুনে আমার রুমমেট প্লাস বান্ধবী লায়লা আপা (সুলতানা লায়লা হুসেইন) একদিন শামসুন নাহার হলের মিনা আপাকে (এপির রুমমেট) ডেকে নিয়ে এলেন। মিনা আপা টিংকুর পরিবার নিয়ে অনেক অজানা তথ্য দিলেন। ছোলা আর ডালপুড়ি সঙ্গে চা, রোকেয়া হলের ক্যান্টিনে বসে লায়লা আপা আর মিনা আপা কথা বলছেন আর আমি চুপচাপ শুনছি । লায়লা আপা অনেক চেষ্টা করেছেন বিয়েটা যাতে পরিণতি না পায়।

তাঁর এই উদ্যোগকে অবশ্যই সম্মানের চোখে দেখি কারণ লায়লা আপার নিঃশর্ত শুভকামনা কেবলই আমার প্রতি স্নেহ আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।আমি এও জানি তাঁর জায়গায় আমি থাকলেও ঠিক একই কাজ করতাম।

২০শে সেপ্টেম্বর বিয়ের আগে যখন মিনা আপার বলা কথাগুলো টিংকুকে জানালাম সে বলল, ”আমার বোনেরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোন তুমি দেখবে তোমাকে কি পরিমাণ আদর করে।”

টিংকু অনেক বেশী আগানো এবং প্রগতিশীল । আমি ওকে কিছুই জানাতে পারি না যদি আমায় ভুল বুঝে।আমার নিজের সম্মান হানী হবে তখন।

দু একটি কথা যাই বলার চেষ্টা করি, সে আমায় বলে তুমি আমাদের ভাষা রপ্ত করো আগে। আমাদের ভাষা ঠিকমত বুঝো না তুমি।

কিন্তু আমারও সমস্যা আছে। ভাইদের সাথে তাঁদের মত করে মানুষ হয়েছি। আব্বা কোনদিন আমায় রান্না ঘরে ঢুকতে দেননি । দীর্ঘ ৮ বছর হলে থেকেছি, সবার সাথে মিশতে তো পারি কিন্তু শ্বশুর বাড়ির নিয়ম কানুন জানি না। এখানে রান্না ঘরে ঢুকে সাহায্য করতে হবে, সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়াতে হবে, সেবা যত্ন করতে হবে । প্রত্যেককে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে।এসবই আমার অজানা।

কারণ ভাইদের যখন বিয়ে হয়েছে আমি পড়াশুনা আর নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত । জামালপুরের শিক্ষিত পরিবারগুলোতে এতো বিধি নিষেধ নেই । যৌতুকের বালাই নেই। যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া ভীষণ ছোটলোকি অসম্মান জনক একটি ব্যাপার।

কিন্তু আমার কি দোষ, আমাদের জামালপুরের বাসায় ৪ জন কাজের লোক ।বাড়ি পরিষ্কার করতে গাছ পালা ছাঁটতে এবং সামনের মাঠের ঘাস কাটার জন্য আলাদা লোক আছে। একজন রান্না করে অন্যরা তাঁকে সাহায্য সহ অন্য কাজও করে। আম্মা কোনদিনও রান্না ঘরে ঢুকেন না। তা ছাড়া আমার নানার পরিবারে আমার নানী, দুই খালা আর খালার মেয়েরাও কোনদিন রান্না ঘরে ঢুকেনি। ওদের ধারনা ওরা বই পড়বে, গল্প-উপন্যাস পড়বে সন্তান মানুষ করবে কিন্তু রান্নার মত ছোট খাটো কাজে সময় নষ্ট করবে না।

আমার সব আত্মীয়-স্বজনই বৃহত্তর মায়মেনসিংহ ও ঢাকায় থাকে। মামাতো আর খালাতো বোনেরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আম্মার পরিবারে আমার খালু এবং মামারা কেবল উচ্চ শিক্ষিত এমনটি নয় আমার আম্মার মামারাও অনেক শিক্ষিত ।

রান্না না জানার অপরাধ এবং ক্রমাগত অপবাদে মনে হল এতো লেখা পড়া না করে প্রতিদিন রান্না করাই বুঝি ভালো ছিল ।

ঢাকায় ফিরে টিংকু কস্তূরীর বাবুর্চি ওয়াদুদকে নিয়োগ দিল আমাকে রান্না শেখানোর জন্য ।

আমি রান্নায় মনযোগী হলাম। যাই রান্না করি টিংকু বলে মজা হয়েছে খুব। একদিন মাংসের কিমা রান্নায় ভুল করে লবণের বদলে চিনি দিয়ে রান্না করলাম। সেটাও খেয়ে বলল মজা হয়েছে। আমি মুখে তুলে দেখলাম কি বিস্বাদই না হয়েছে এটা কিছুতেই খাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

চলবে…