Select Page

ক্যান্সার (পর্ব২০)

ক্যান্সার (পর্ব২০)

চলচ্চিত্রে বিয়ে মানে হ্যাপি এন্ডিং আর বাস্তব জীবনে বিয়ে মানে চলচ্চিত্রের শুরু। অনেকবার ভেবেছি সিনেমার মত বাস্তব জীবনটাও যদি ওই বিন্দুতেই থেমে থাকতো ।

১৯৯৩ র ২০ শে সেপ্টেম্বর বিয়ের পরের তিনদিন ঘোরের মধ্যে কাটলো। এই বাসাটায় টেলিভিশনের লাইন টানা নেই। অগত্যা রবিবারে জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ নাটক ”কোথাও কেউ নেই” এর শেষ পর্ব দেখার জন্য অন্য একটি বাসায় গেলাম দুজনায়। নাটক শেষে নাটকের শেষ দৃশ্য নিয়ে আবেগ আপ্লুত আমাকে টিংকু বলল, এবার ফোন করে তোমার পরিবারকে বিয়ের কথাটি জানাও।

এর আগেও কয়েকবার বলেছে কিন্তু আমার ভ্রুক্ষেপ নেই , সাফ জবাব যা হয় হবে আমি কিছুতেই জানাতে পারবো না। সে আমাকে বিয়ে করেছে অতএব এর পরের দায়িত্ব তাঁর। সে আমাকে বলল এই যে আমি তোমার পাশে আছি, তোমাকে ছুঁয়ে আছি এইবার ফোন দাও। ভয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম, কিছুতেই পারবো না আমি। টিংকু আমাকে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ালো। বুঝানোর জন্য বলতে শুরু করল, ”দেখ তুমি যদি না জানাও, আমাকে তোমার পরিবার জেলে ঢুকাবে, মামলা হবে, মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না। কথা বলার সময় আমি তোমার হাত ধরে থাকবো একজনকে অন্তত জানাও তোমার বিয়ে হয়েছে।”

ঘণ্টা দুয়েক বুঝানোর পর আমি মেজো ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম,” টিংকু ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।” মেজো ভাই বললেন,”টিংকুকে দাও।” মেজো ভাই আর্মি ডাক্তার, রাজেন্দ্রপুরে পোস্টিং । ভাই টিংকুকে বললেন, ”আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে অন্যায় করেছ, আমার বোনকে কালই আমার বাসায় রেখে যাবে।”

টিংকু পরদিন চলমান সংসদ অধিবেশনে যেয়ে আজম ভাই(মীর্জা আজম) আর হীরা ভাই (তখন জামালপুরের এমপি) কে বলল, মুন্নিকে আমি বিয়ে করেছি ওর পরিবার সামলানোর দায়িত্ব আপনাদের। যদি সবার সামনে আবারও বিয়ে করতে হয় করবো কিন্তু এ বিয়ে ভাঙতে দিব না কিছুতেই।

এর পরের দিন টিংকু আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে ভাইয়ের বাসায় গেলো। যাওয়ার সময় রাজলক্ষ্মী থেকে অনেক প্যাকেট মিষ্টি কিনল। ভাবী বলল তোমাকে এতো মিষ্টি লাগছে দেখতে, টিংকু তুমি বেশ হেন্ডসাম মাশাআল্লাহ্‌ ।

বিয়ের দিন ক্ষণ, প্ল্যান, প্রোগ্রাম কোন কিছু যদিও আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতাম না তবুও বিয়ে সঙ্ক্রান্ত সমস্ত দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে অল্প সময়ে টিংকু কথা বলে ইমপ্রেস করে ফেলল আমার ভাই- ভাবীকে। ভাইকে বলল ”আমার কোন দোষ নেই মুন্নি আপনাদের জানাতে নিষেধ করেছে।”

টিংকু চলে যাওয়ার পর ভাই আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলেন কেন তাঁদের আমি জানালাম না ? আমি বললাম আমার সবচেয়ে আদরের হচ্ছে অদিতা আর ঈশিতা (আমার দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে, ওরা তখন অনেক ছোট) । ওরা যদি টিংকুর মত কোন পাত্রকে বিয়ে করতে চাইত আমি কিছুতেই রাজি হতাম না। কোন সাহসে এই বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলবো, তোমরা এই বিয়েতে কোনদিন রাজী হতে না জানি আমি ।

ঠিক হল রাজেন্দ্রপুরে আবার আমাদের বিয়ে হবে। নতুন করে কাবিন হবে দুই পরিবারের সবার উপস্থিতে। আমাদের পরিবারে উৎসবের আমেজ। ৭ ই অক্টোবর আমার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। যদিও আমার তিন মামার পরিবার পরিজন সহ আমার দুই খালার ছেলে-মেয়েরাও সবাই ঢাকায় থাকে কিন্তু ছোট মামার দুই কন্যার সাথে আমার সখ্যতা বেশী। ওরা রাজেন্দ্রপুর চলে এসেছে আগে ভাগেই। ছোট মামার ছোট মেয়ে জয়ী তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ও বলল মুন্নি আপু আজ আমরা ব্যচেলর নাইট করবো।বড় কন্যা কলেজে পড়া লাবনী অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন ”মুন্নি আপু তুমি কি এখনো ব্যচেলর আছ?” আমি কিছু বললাম না কেবল হাসলাম।

আম্মা তো ননস্টপ গালি গালাজের বন্যা ছুটিয়েই যাচ্ছেন। রাতে মেজো ভাই ডেকে বললেন কাল তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবে , ”স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা জরুরী।একবার বিশ্বাস হারালে তা আর কখনো ফেরত আসে না, স্বামীর সাথে কখনো মিথ্যে বলবে না, আর কোন কথা গোপনও করবে না।”

আম্মা বললেন, ” স্বামীর কাছে অযথাই টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র চাইতে নেই, এতে সম্মান হানী হয়।নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলার দায়িত্ব তোমার নিজের।”

আব্বা বললেন, ”এতো বড় মেয়ে মাস্টার্স পাশ করেছ অথচ সাহস করে বলতে পারলে না ওকে তুমি বিয়ে করতে চাও।”

সবার কথার উত্তরে চুপ থেকে আমি কেবল মাথা নাড়ালাম।

৮ই অক্টোবর যখন পুনর্বার আমাদের বিয়ে হল মনে হল এটা কোন আনন্দ উৎসব নয় আমার চল্লিশা হচ্ছে।সবার কান্না আর মন খারাপ দেখে আমি অধিক শোকে পাথর হয়ে কাঁদতে ভুলে গেলাম। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল।

আজ বিয়ের দিন, আমি পরেছি লাল বেনারসি, সঙ্গে গা ভর্তি গহনা।গলায় সীতা হার, চেইন লাগানো লম্বা কানের দুল, টিকলি আর মানতাশা আরেক হাত ভর্তি সোনার চুড়ি, এ সবই আম্মার দেওয়া মূলত নানীর গহনার নতুন সংস্করণ ।অনেক আগে থেকেই আমার বিয়ের জন্য তৈরী করা হয়েছিল এলিফেন্ট রোডের জড়োয়া হাউস থেকে। টিংকুও দিয়েছে, আমার ভাইয়েরা আর মামারাও অনেক গহনা দিয়েছে, কাজিনরাও দিয়েছে। কলাবাগানের ”মে ফেয়ার” বিউটিপার্লার থেকে সেজে এসেছি।চাইনিজ এক মহিলার পার্লার, সমস্ত মুখ ময়দার মতো সাদা করে সাজিয়েছে ।তবুও আজ আমার খুশী লাগছে।

টিংকুকে দেখা মাত্র সমস্ত শোক ভুলে নিমিষেই আনন্দিত হলাম আমি। কোন পুরুষ বুঝি এতোটা সুদর্শন হয়। হালকা ঘিয়ে কালার গরদের পাঞ্জাবীর উপর একটি লাল-সাদা তাজা ফুলের মালা তাতেই আমার সারা জীবনের ক্রাশ অমিতাভ বচ্চন ফেল । কি ভীষণ সুদর্শন আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে আজ টিংকুকে।

চলবে…

About The Author

Khugesta Nur E Naharin

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন; খুঁজি তারে আমি আপনায়

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *