Select Page

ক্যান্সার (পর্ব১৭)

ক্যান্সার (পর্ব১৭)

পৃথিবীতে কোন কোন মানুষ কেবল বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ হয় আবার কেউ কেউ আনন্দ উল্লাসে তাঁকে ভুলে থাকে।

কিছু কিছু মানুষের জীবনে কেবলই বেদনা আর না পাওয়া আবার কিছু কিছু মানুষের ঝুলি ভর্তি কেবলই জয় জয়কার।
পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছেন বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী। যারা অবিশ্বাসী বা নাস্তিক তাঁরা আল্লাহ্‌, খোদা,ভগবান বা গডে বিশ্বাসী নন কেবলই প্রকৃতিতে বিশ্বাস করেন। যা প্রকারন্তরে বিশ্বাসেরই নামান্তর, কেবল ভাষাটা আলাদা। তাঁরা বলেন প্রকৃতির প্রতিশোধ, তাঁর নিজস্ব হিসাব আর আমরা বিশ্বাসীরা বলি আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কিংবা তাঁর বিচার।

ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা বলে কষ্ট, বেদনা আর না পাওয়াটাও এক ধরনের পাওয়া যা তোমাকে পরিশুদ্ধ করে জীবনকে পরিপূর্ণ রূপে বুঝতে সাহায্য করে।প্রকারন্তরে যা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের সহায়ক ।

২০০৫ এ হজ্ব করতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ৩রা জানুয়ারিতে বিশাল এক কার এক্সিডেন্টের কবলে পরি। এক্সিডেন্টে আমার মুখের এক পাশ জানালার ভাঙ্গা কাঁচ ঢুকে ক্ষত বিক্ষত করে। অনেক ঘণ্টা আমি অচেতন থাকি। জ্ঞান ফিরলে বুক পিঠ হাত পা সহ পুরো শরীরে ব্যথা। যখন আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম নিজের কুৎসিত রূপ দেখে চমকে উঠলাম।এর থেকে বুঝি বা মৃত্যুও ভালো ছিল।

আমার শাশুড়ি সহ টিংকুর পুরো পরিবার হজ্বে যাচ্ছে। ওর মেজো বোন বললেন ”অসুস্থ মুন্নি সঙ্গে যাওয়া মানে আমাদের সকলের হজ্বে ডিস্টার্ব হওয়া।” কিন্তু টিংকু নাছোড় বান্দা আমাকে হজ্বে নিয়েই যাবে। ওর কথা হচ্ছে আমাকে সঙ্গে না নিয়ে গেলে মানুষ আমাকে অপবাদ দিবে ”আল্লাহ্‌ আমার হজ্ব কবুল করেননি।” আমি আহত হব, মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরবো।

হজ্বের উদ্দেশ্যে মদিনায় যাওয়ার পর মনে হল না আসাটাই বুঝি ভালো ছিল। গায়ে ভীষণ জ্বর, বুকে পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা। কিছু খেতেও পারছি না, বিন্দুমাত্র নড়াচড়াও না। ওরা সবাই মসজিদে নববিতে নামাজ পড়তে যায় আর আমি বিছানায় শুয়ে নামাজ আদায় করি। সাতদিনে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলাম।আমিও মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করা শুরু করলাম।
একদিন মসজিদে এক পাকিস্তানী মহিলা চেহারায় আঘাত দেখে কারণ সুধালেন, সব শুনে তিনি বললেন, ”তুমি কত ভাগ্যবতী, স্বয়ং আল্লাহ্‌ তোমাকে পরিশুদ্ধ করে এখানে এনেছেন, মনোযোগ সহকারে মন প্রাণ ঢেলে যাতে তুমি হজ্ব পালন করতে পারো, দোয়া করতে পারো তাঁর ব্যবস্থা করেছেন, নিশ্চয়ই তুমি তাঁর প্রিয় বান্দা, তোমাকে তিনি অনেক ভালো না বাসলে এই অবস্থায় কোনদিন আনতেন না এখানে।” তাঁর কথা শুনে আমি কাঁদতে লাগলাম।
সত্যিই তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

জীবন-মৃত্যুর এই অনিশ্চয়তায় জীবনকে যতটা বুঝা যায় তোতোটা আর কোন কিছুতেই নয়।

মক্কায় যখন মূল হজ্ব পালন করতে গেলাম তখন আমি প্রায় পুরপুরি সুস্থ। যখনই কাবা শরিফে যাই জমজমের পানি দিয়ে মুখ ধুই আর আল্লাহ্‌র কাছে করুনা ভিক্ষা করি।এখানে এসে পরিবারের অনেকেই অসুস্থ হলেন কিন্তু মিনা আরাফাত ময়দান সহ প্রতিটি জায়গায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থতায় ভালো ভাবে হজ্ব পালন করতে পারলাম । হজ্ব শেষে আশ্চর্য জনক ভাবে আমার মুখের ক্ষতগুলো অনেকটাই সেরে গেলো।

এই ঘটনাটি যতবার ভেবেছি ততোবারই মনে হয়েছে হজ্বের আগে এক্সিডেন্ট আমাকে কনসেন্ট্রেশন এনে দিয়েছে। মানসিকভাবে পরিবর্তিত আমাকে কষ্ট সহিষ্ণু আর ধীরতা সহকারে মূলত বিচক্ষণ করেছে। আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে সৌন্দর্য এবং জীবন ক্ষণস্থায়ী, যে কোন মুহূর্তে যার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।

২০১০ এ আকস্মাৎ টিংকুর ব্রেইন ক্যান্সার আর তাঁর মৃত্যুতে মনোজগতে তোলপার করে ফেলেছে, অনেক বেশী মানবিক করেছে, জীবনকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। বুঝতে শিখিয়েছে পৃথিবীতে বিরুদ্ধ শক্তির সাথে লড়তে হবে একাই।চারিদিকে লোভী মানুষের মাঝে টিকে থাকা সহজ নয়, এই কষ্ট সাধ্য ব্যাপারটিকেও সহজে মেনে নিয়েই পথ চলতে হয় ।

টিংকুর কাছ থেকেও আমার শিখার কোন শেষ নেই। মাত্র ৪ বছর বয়সী পিতৃ হারা টিংকু জানতেনও না, বুঝতেনও না যে স্বামীরও অনেক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু মানুষ হিসেবে টিংকুর তুলনা কেবলই টিংকু।

সৃষ্টিকর্তা বিপদ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন আর অসুখ দিয়ে পরিশুদ্ধ করেন। তাঁর নির্দেশিত কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলেন। যাকে তিনি পছন্দ করেন তাঁকেই তিনি উপযুক্ত হিসেবে বেছে নেন।

এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে অসুস্থ অনেকেই লিখেছেন তাঁদের অসুস্থতাকে চারিপাশের মানুষ অভিশাপ বলেছেন।বলেছেন কোন না কোন মন্দ কাজের ফলস্বরূপ তাঁদের এই শাস্তি। এই সমাজের কিছু অসৎ এবং মূর্খ লোক তাঁদের মন্দ বলে মজা লুটছেন।

কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এটা কেবলই পিউরিফাই বা পরিশুদ্ধের পথে হাঁটা।

এই শুদ্ধতা মানে কেবলই নামাজ, রোজা হজ্ব জাকাত নয় এই শুদ্ধতা মানে হচ্ছে মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন।
দীর্ঘ এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষে আমি নিশ্চয়ই আগের থেকে বেশী কষ্ট সহিষ্ণু হব, মানবিক হব, স্থির হব, অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পরে সাহায্য করব। প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে ভাঙবো আবার নতুন করে গড়ে তুলবো, ভালো থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকবো।

মহান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসেন এবং সমস্ত দুঃসময়ে তিনি তাঁর পাশে থাকেন। স্রস্টা তাঁর সৃষ্টিকে ছেড়ে যেতে পারেন না কিছুতেই।

চলবে…

About The Author

Khugesta Nur E Naharin

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন; খুঁজি তারে আমি আপনায়

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *