Select Page

ক্যান্সার (পর্ব১৬)

ক্যান্সার (পর্ব১৬)

আজ অনেকদিন পর একনাগাড়ে ৭ ঘণ্টা ঘুমাতে পারলাম। ঘুম ভেঙ্গে এক অপার ভালো লাগা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে ”মানুষ নিজের আয়নায় অন্যকে দেখে।” নিজের চাওয়া-পাওয়া মিলিয়ে অন্যকে হিসেব করে।

মানুষ এমন এক প্রাণী যাকে বীজগণিতের অংকের মত ফর্মুলায় ফেলে মিলানো যায় না। কাউকে কাউকে হয়তো যায় কিন্তু সবাইকে নয়। অন্য একজনের হিসেব নিকেশ চাওয়া পাওয়া অপর একজনের মত নাও হতে পারে।

একই সময়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকা অসুস্থ এক বন্ধুর সাথে কথা হল। যে কিনা শুধু মাত্র ”কেমন আছ” বললেই ক্ষেপে যায়। তাঁর কথা হচ্ছে ”আমি অসুস্থ এই কথাটি বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে কেন? তা ছাড়া তোমরা তো সবাই আনন্দ ফুর্তিতে আছ আমাকে অযথাই জিজ্ঞেস করে কষ্ট দিচ্ছ কেন ?

দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবধান থাকা স্বাভাবিক। আমরা বুঝতে চাই না চেতনে অবচেতনে আমরা কেবল নিজের পরিবার নয় সমাজেও ছাপ রেখে যাচ্ছি।

আমার সুস্থতা-অসুস্থতায় অন্য কারো কিছু যায় আসে না। কিন্তু অসুস্থ যারা আছেন কিংবা ভবিষ্যতে একই ট্রমার ভেতর দিয়ে যাদের যেতে হবে তাঁদের জন্য আমি অবশ্যই উদাহারন।

তাঁরা আর একাকীত্বে ভুগবে না, অভিশাপও ভাববে না। ভেবে কষ্ট পাবে না ”একা আমিই কেন?” জানবে অসুখ হওয়ার জন্য মূলত কোন কারণ লাগে না।

আমি অসুস্থ জানার পর চারিপাশের একই ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকে তাঁদের নিজেদের অসুস্থতার খবর জানিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। এখন আর নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। আমাদের দেশের অনেক বড় এক রাজনৈতিক নেত্রীও এই রোগে আক্রান্ত অথচ আমাদের তাঁরা জানতেও দেননি।

অনেকে বলেন আপা সমাজের চিন্তা বাদ দেন । কিভাবে বাদ দিবো ? অন্যের জন্য পথ কে সহজ করার দায়িত্ব নিয়েই মূলত আমাদের জন্ম হয়। বড় কোন কাজের দায়িত্ব পাইনি ছোট ছোট কাজ গুলোই না হয় করে যাই।

সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব কারো একার নয় আমাদের সবার। কত কাজ বাকি রয়ে গেলো। কত কুসংস্কার নারীর জন্য অবমাননাকর কত প্রথা রয়ে গেছ আজও।

বেশীর ভাগ মানুষই ভাবে আমি সয়েছি তুমি সইলে ক্ষতি কি ? আমি ভাবি যে কষ্ট আমি সয়েছি তোমায় সইতে দিবো না কিছুতেই।

বিধবা মহিলাদের জন্য কত কি যে করার ছিল। অল্প বয়সে বিধবা নারী মানেই যেন অসহায় আর অন্য নারী-পুরুষের অপবাদের বস্তু। পুরুষরা ভাবে আহা একা আছে অথচ আমি ভোগ করতে পারছি না আর নারীরা পুরুষের এই মনোভাব বুঝে বলেই ইনসিকিউরিটিতে ভুগে।

তবে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেইনি আমি। মুখ বন্ধ করা জবাব দিয়েছি সবসময়।

টিংকু টিজ করে বলত ”মুন্নি এতো নরম কোমল কাউকে কষ্ট দিতে পারে না, জবাই করে দিবে কিন্তু এক ফোঁটা রক্তও ঝরবে না।”

সমালোচনার তোপে বলতে ছাড়িনি ”তোমরা শো কলড হাঁই সোসাইটির শরীর সর্বস্ব মহিলারা সাজিয়ে গুঁজিয়ে মূলত নিজেদের পণ্য বানাও, ফট ফট ইংরেজি বলে নিজেকে বাহবা দাও অথচ তোমাদের মাথা ভর্তি যে গোবর সে খবর জানো না। যতই প্রসাধন চর্চিত হও তোমাদের ঈর্ষা আর হৃদয়ের কদর্যতা ঢাকতে পারনা কিছু দিয়েই।”

আমার লেখার ভীষণ ভক্ত আর সবচেয়ে বড় সমালোচক হচ্ছে আমার কন্যা শ্রেয়া। ফটিকের অনভিপ্রেত ঘটনাটি সামনে আনতে ও’ই আমায় অনুপ্রাণিত করেছে। এখনকার আধুনিক কন্যারা অনেক বেশী সাহসী আর স্পষ্টভাষী।

আমার পুত্র আর কন্যাদের বান্ধবীরা যখন বলে ” অ্যান্টি আমি আপনার মত হতে চাই,” আবেগে আপ্লুত হয়ে বলি, ”আমার তো এক হৃদয় ছাড়া আর কিছু নেই তোমরা আমার থেকে অনেক অনেক বেশী বড় হবে।”

কিমোর প্রভাবে মাথা থেকে চুল উঠে যাওয়ার খবর শুনে চট্টগ্রাম থেকে জাকির ভাই ফোন দিয়ে বললেন এটা কি তোমার জন্য বড় কোন বিষয় সেই তরুণী বেলাতেই চুল ন্যাড়ে করেছ এখন তো কোন ব্যাপারই না। দুজনেই হাসতে থাকলাম।
প্রায় ২৬ বছর আগে ২৭ বছর বয়সী এক তরুণী ন্যাড়ে মাথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর শ্বশুর বাড়ির সবাই তাঁকে কখনো পাগল কখনো বোকা বলে উপহাস করছে।শান্ত মেয়েটি কারো কথার জবাব দিচ্ছে না, কোন প্রতিবাদও না, নত মুখে কেবলই হাসছে। নরম, কোমল, মিষ্টি হাসি।

আমার কোমর ছাপানো লম্বা চুল। এতো বেশী সোজা আর সিল্কি যে হাত খোঁপা খুলে যায় একটু পর পর। টিংকুর সাথে ঝগড়ার এক পর্যায়ে একদিন খোঁপায় হাত দিল আর নির্বাক আমি চুপ হয়ে গেলাম। টিংকু ধরে নিল এটা আমাকে চুপ করানোর অস্র ।

এক দিন, দুই দিন, তিন দিন।আজ টিংকু বাইরে চলে গেছে আর আমি সেলুন থেকে নাপিত ডেকে এনেছি। বললাম, আমার টাইফয়েড চুলটা ন্যাড়া করে দিন।এতো সুন্দর চুল, নাপিত হাতে ধরে বসে আছে কিন্তু কাটতে পারছে না। জোরে এক ধমক লাগিয়ে দিলাম, ”কাটুন।” নাপিত খুর বের করলেন ।

এতো বছর পর আজ আবারও নাপিত ডাকতে পাঠিয়েছি। আজ মিথ্যে নয় সত্যি সত্যিই আমি অসুস্থ, চুল ন্যাড়া করতে হবে।

চলবে…

About The Author

Khugesta Nur E Naharin

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন; খুঁজি তারে আমি আপনায়

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *