অসুখটা কমন পরে গেছে বিধায় টিংকুকে মনে পরছে অবিরত। ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত ওর জীবনের শেষের দুমাস অচেতন ছিল। আসলে কষ্ট কমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হত। ওর বন্ধু পপসি ভাই বললেন, ” পারমিশন দাও কেমো আর রক্ত না দেওয়ার। বি-নিগেটিভ, এতো রেয়ার গ্রুপের রক্তের প্লাজমা নষ্ট করছ কেন, কিসের আশায়।”
পপসি ভাই কেবল টিংকুর বন্ধু নয় আমাদের বড় আপনজন। কেউ সাহস পাচ্ছে না এই জন্য পপসি ভাইকে দিয়ে বলিয়েছে। এই ডিসিশন দেওয়া মানে টিংকুর মৃত্যুকে দ্রুত আমন্ত্রণ জানানো। আমি বললাম ওর বাচ্চাদের জানান। আমার ভাই বললেন পাগল নাকি ওরা এতো ছোট এই মানসিক প্রেশার ওদের দিবে কেন । তবে ওর মা’কে জানান, ভাই-বোনদের জানান। পপসি ভাই বললেন এই কষ্ট আর কাউকে দিও না মুন্নি তুমি একা নাও।
সবচেয়ে প্রিয় আর আপন মানুষের মৃত্যুর ডিসিশন আমার দিতে হল।
বাসায় ফিরে আমার নিজের মায়ের সাথে চিৎকার করলাম, খারাপ ব্যাবহার করলাম অযথাই।আসলে ডিসিশনের এই ট্রমা নিতে পারছিলাম না আমি।
অচেতন থাকলেও নিয়মিত চুল ছেঁটে দিতাম, দাঁড়ি ক্লিন শেভ করাতাম।কারণ হচ্ছে মেয়েটা এতো ছোট ও যেন বড় হয়ে পিতার চেহারা পরিষ্কার মনে করতে পারে। চুল আর দাঁড়ির আড়ালে যেন এলোমেলো হয়ে না যায়।
এখন আমি নিয়মিত চুল ছোট করছি। কারণ কেমোর প্রভাবে চুল পরা শুরু হয়ে গেছে। হাতের তালুতে চামড়া উঠছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ধীরে ধীরে সমস্ত চুল নাই হয়ে যাবে।
আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার দুই সন্তান, ড্রাইভার জাহিদ আর আজিজও চুল নেড়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু ওদেরকে বলেছি তোমাদের সুন্দর চুল নিজের চুল হীনতার কষ্টকে ভুলিয়ে দিবে।
ক্যান্সারের খবরটা আমি শুরুতে সবাইকে হাসি মুখেই দিতে চেয়েছি। মৃত্যু শাশ্বত চিরন্তন । অযথাই কাঁদব কেন !
যাকেই বলি সেই বলে মিথ্যে বলছ । শিখা ভাবি বাসায় এলেন, আমায় হাসি- খুশী আর স্বাভাবিক আড্ডার আবহে দেখে বললেন তোমার অপারেশনের জায়গাটা আমায় দেখাবে। আমি বললাম নয় কেন এ পর্যন্ত কত জনকে দেখাতে হয়েছে, লজ্জা আর দ্বিধা এখানে নির্বাসিত। তবুও সন্দেহ যায় না, আবারও বললেন সত্যিই তোমার ক্যান্সার ? হাসতে হাসতে বললাম হে রে বাবা।
লাইলুন আপা বড় এক বাস্কেট ভর্তি ফল পাঠিয়ে দিলেন । ফোনে ধন্যবাদ জানাতে না জানাতেই বললেন আমার শরীরটা অনেক খারাপ মুন্নি, নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে হয় না।
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কত কিছু যে শেখার আছে। নিজে এতোটা অসুস্থ অথচ আমার জন্য উপহার পাঠাতে ভুলেন নি। আমি বললাম ”আপা আমরা আর কতদিন বাঁচবো জানা নেই। মন যা চাইবে তাই খাবে । ঢাকা ক্লাবে খাবার অর্ডার করে গাড়ি পাঠিয়ে দিবে । প্রয়োজনে ১০০ টাকার জিনিস ১০০০ টাকা পরবে, ওই হিসাব তোমার জন্য নয়।কারণ এখন টাকার থেকে সময় অনেক বেশী মূল্যবান।”
আমার পাশের বাসার বান্ধবী কলি খাবার পাঠিয়েছে। খেতে বসে মনে হল দীর্ঘদিন বুঝি উপোস ছিলাম, গোগ্রাসে খেলাম।
ধানমণ্ডির বান্ধবী মুনিরা সহ অনেকেই বলেছেন কেবল বলবে হাসপাতালে খাওয়া হাজির। আমি হাসি আর বলি তোমরা আমাকে মোটা বানিয়ে ফেলবে।
কত জন কত কথা বলেন সাহস দেন।
পান্না ভাই ফোন দিলেন। টিংকুর চিকিৎসাকালীন সিঙ্গাপুরে থাকার সময় পান্না ভাই আর ওনার স্ত্রী বাঁধন আপা আমাদের কি লাগবে না লাগবে খেয়াল রেখেছেন সবসময়। দীর্ঘ দিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে কয়েক বছর আগে হেরে গেছেন বাঁধন আপাও । আপার ছোট বোনেরও শুনেছি একই রোগ। আমার এই কষ্ট উনি না বুঝলে আর কে বুঝবে।
হাসতে হাসতে পান্না ভাইকে বললাম তোমার সাথে আমার ন্যূনতম প্রেমও হল না অথচ রোগটা হল ঠিকই। পান্না ভাই বললেন ফাজলামো করে আমাকে হাসাতে চাচ্ছ ভেতরে ভেতরে তোমার কান্না আমি বুঝতে পারছি না ভবছ ?
বাঁধন আপার অসুখের সময়ের অজানা কথাগুলো আলোচনা করতে করতেই পান্না ভাই কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই তীব্র ভালবাসা খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই জোটে । বাঁধন আপা নিঃসন্দেহে তুমি অনেক ভাগ্যবতী।
এভাবে বেদনা জাগাতে হয় না পান্না ভাই।আজ তুমি আমায় কাঁদিয়েই ছাড়লে।
চলবে…