ক্যান্সার (পর্ব১৪)

Photo of author

By Khugesta Nur E Naharin

কদিন থেকে আমার ভীষণ মন খারাপ। জামালপুর গেলাম। আমাদের পরিবারে সবাই সবার বন্ধু। অনেক দিক থেকে আমার অনেক স্বাধীনতা এখানে। সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা ”আম্মা।” আম্মাকে আমি সব কিছু বলতে পারি।

বললাম আম্মা, ”আমার মন খারাপ ইঞ্জিনিয়ার তো বিয়া কইরা ফালাইলো।”

আম্মা বললেন, ” মা হারা ছেলেটার দোষ কি, তুমি ওরে বেশী কষ্ট দিছ, মাও(আহমেদ সাইদ মাও) আর আসফিয়া (তাঁর স্ত্রী) তো অনেকবারই ওর সাথে বিয়ার কথা কইছে, তাগিদ দিছে , তুমিই তো পরীক্ষা আর থিসিসের অজুহাতে কেবলই পিছাইলা । ডাঃ মাও ভাই তখন চাকরী সূত্রে জামালপুর থাকতেন। কয়দিন ছাত্রলীগের নেতায় তোমারে ডিস্টার্ব করল, সে আর কত সইবে ।”

আম্মা আমাকে এবার সাবধান করে বললেন, ”এইবার তুমি টিংকুর কথা বেশী গল্প করতাছ, তুমি অবিবাহিত মেয়ে, মায়ায় ভর্তি নরম মন, স্পর্শ কাতর। অভিজ্ঞ ওই পোলা তোমারে পটাইয়া ফেলব।ওর সাথে দূরত্ব মেইনটেইন কর আর মিশবা না।”

আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। অ্যাপ্লাইড কেমেস্ট্রির এক বড় ভাই বললেন কাল রাতে তোমায় দেখেছি ”তুমহারি অমৃতা” (শবানা আজমির পত্র নাটক) দেখতে গিয়েছিলে । আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম প্রশ্নই উঠে না। ছেলেটি আবারও বলল তবে আমি কাকে দেখলাম ?

বিকেল বেলা টিংকু ভাই এলেন আমরা দুজন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিং এর সামনের সিরিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মুখোমুখি বসে কথা বলছি। গোটা কার্জন হলের এই বিল্ডিং টা সবচেয়ে বেশী সুন্দর,আবার একই সাথে ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর বলার কারণ হচ্ছে এখানে বসে আমাদের সব পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।

তিনি জানালেন ”তুমহারি অমৃতা” দেখতে গিয়েছিলেন । হাসতে হাসতে বললাম সঙ্গে নিশ্চয়ই গার্ল ফ্রেন্ড ছিল । অপ্রস্তুত টিংকু ভাই এবার পাল্টা প্রশ্ন করলেন কে বলছে তোমাকে ? আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম কার্জন হলের অনেক ইয়াং টিচার ভাবছে আপনি বুঝি আমার প্রেমিক একই সাথে ডাবল গেম খেলছেন। আমরা ভালো বন্ধু কিন্তু বন্ধুত্বটা সবাই বুঝে না।প্রশ্ন করলাম কে সেই নারী? টিংকু ভাই লজ্জা পেলেন কিন্তু উত্তর দিলেন না। আমি নিশ্চিত তাঁর অন্য কোন নারীর সাথে সম্পর্ক চলছে।

বন্ধুত্ব হচ্ছে লেনদেন বিহীন এক সম্পর্ক যেখানে কোন প্রত্যাশা ছাড়া একে অপরের শুভ চিন্তক।

টিংকু ভাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে চিঠি লিখেন। বেশীরভাগ চিঠিই হতাশা, স্বপ্ন হীনতা আর বেদনায় নীল।

আমি মাঝে মাঝে উত্তর লেখি কিন্তু ঠিক চিঠির মত করে লেখি না। আমার মনে অবিশ্বাস জন্মেছে তিনি অন্যদের দেখাবেন প্লাস তাঁর কাছে চিঠি থাকুক চাই না আমি। রাফ করার জন্য নিউজ প্রিন্টের কাগজ। সেই কাগজে উত্তর লেখি। বেশীরভাগ চিঠিতেই ফুল ফল লতা পাতার ছবি আঁকি । এই যেমন ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা এঁকে লিখলাম আমি এখন চা খাচ্ছি আপনি খাবেন ? আপনার মন আজ কেমন আছে ? আপনার বাসায় ছোট ভাইরা কি করছে ? সেই সময় চলতে থাকা টেলিভিশন সিরিজ নাটক ”কোথাও কেউ নেই” এর কোন সিনটা ভালো লেগছে এসব লেখি। এই চিঠিতে প্রেমিকা ভাবার কোন অবকাশ রাখি না । আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ যে কেউ দেখলে ভাববে বুঝিবা স্কুলের গণ্ডী পার হইনি। সম্বোধনে লেখি শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাই ইতিতে লেখি স্নেহের মুন্নি ।

বিরক্ত হয়ে টিংকু ভাই বললেন তুমি দেখি ভালো করে চিঠিও লিখতে জানো না।তুমি কি এতোই ফকির তোমার একটি রাইটিং প্যাড কেনারও টাকা নেই। আমি হাসতে হাসতে জবাব দিলাম আমি তো সাহিত্যের ছাত্রী নই বিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি অংক বুঝি, অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন বুঝি, সমীকরণ বুঝি কিন্তু সুন্দর চিঠি লিখতে পারি না।

চিঠির উত্তর দেওয়ার কারণ হচ্ছে সম্পূর্ণ বিষাদে ডুবে থাকা মানুষটা যেন কষ্টের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারে। আমি তাঁকে সাহায্য করতে চাই ।

একদিন বিকেলে মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে জানালেন ইকবাল (হুইপ ইকবালুর রহিম) বলেছে ” মুন্নির গলাটা রাজ হাঁসের মত অহংকারী কিন্তু কার্জন হলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই ও আপনাকে বিয়ে করবে না। ইকবাল ভাই আমার অল্প সিনিয়র। দিনাজপুরের তহু, ডেইজী সহ ছোট বড় আমরা মাঝে মাঝে কলা ভবনের মাঠে আড্ডায় মেতে উঠি। আমাদের সম্পর্কটা নিখাদ বন্ধুত্বের।

আমি বললাম কি আশ্চর্য বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন ? তা ছাড়া আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে । বেইলী রোডে খাবারের দোকানে চটপটি খেতে আপনাদের দেখা গেছে । রিকশার হুড ফেলে হাসসজ্জল আপনারা একসাথে সেখানে খেতে গেছেন।

টিংকু ভাই খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু সামলে নিলেন ।

সেশন জ্যামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী একসাথে । হলে যারা থাকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুর ঘুর করে। এখানে সংবাদ পাওয়া মোটেও কষ্ট সাধ্য নয়। উপরন্তু আমি মিশুক প্রকৃতির আমাকে সাবধান করা শুভ চিন্তকের অভাব নেই।

আমি ব্যস্ত আমার থিসিস পেপার রেডি করা নিয়ে। টিংকু ভাই বললেন আনন্দ প্রিন্টার্সে রাব্বানি জাব্বার ভাইয়ের প্রেসে প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছি নটরডেমের পাশে এখানে আসো ।বার বার বললাম দরকার নেই আমি নিজেই করে নিতে পারব কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা।

হঠাৎ একদিন বললেন আমার বোনরা সবাই ঢাকায় তুমি ওদের সাথে দেখা করবে মুন্নি ? আমি বললাম আমি কেন দেখা করবো ? তিনি বললেন তুমি আমার ভালো বন্ধু একারণেই না হয় দেখা করলে । আমি বললাম ওনারা আমাকে পাত্রী হিসেবে ভাবছেন না তো ? তিনি বললেন ভাবলেই ক্ষতি কি এটলিস্ট আমার জন্য পাত্রী দেখা বন্ধ হবে।ওরা পাত্রী দেখে দেখে আমার ইজ্জত সম্মান শেষ করে ফেলছে সেটা অন্তত বন্ধ হবে। আমি বললাম আপনার চটপটি খাওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে কি ব্রেকআপ হইছে ? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড একটা, নাকি একাধিক ?

টিংকু ভাইয়ের পরিবার দেখার আগ্রহ আমারও আছে। যাই দেখে আসি অসুবিধা কি । ডাসের সামনে সবাই এসেছে । আমি একটি মাড় ছাড়া ত্যানা শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।

আম্মা প্রায়ই পাত্র নতুবা পাত্রের পরিবার পাঠায়, তাঁদের সাথে দেখা করে কথা বলা আমার জন্য বাধ্যতামূলক। এই অসম্মান জনক কাজটিকে আমি খুব একটা পাত্তা দেই না। গত আট বছরে এটা আমার অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে বিধায় নতুন কিছু নয়। আম্মাকে অনেক বলেও বুঝাতে পারি না পড়াশুনা শেষ করার আগে বিয়ে করলে রসায়নের মত কঠিন বিষয় সমাপ্ত করা সম্ভব নয়।আবার বিয়ের জন্য আম্মা কখনো জোড় করেননি এটাও সত্য।

বিকেল বেলা টিংকু ভাই দেখা করতে এসেছেন । তিনি আজ পদার্থ বিজ্ঞান ভবনের সামনের অল্প উঁচু রেলিং এর উপর বসেছেন, আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি । আমি বললাম আপনি কোনদিন বলেননি আপনার পরিবারের সবাই বোরকা পরেন । তিনি বললেন তোমার পরতে হবে না। আমি বললাম আমার পরিবার কোনদিন আপনার সাথে আমার বিয়ে মেনে নিবে না। তা ছাড়া আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আছে আমি নিশ্চিত।

তিনি বললেন তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। আমি বললাম আমাকে মেরে কুটি কুটি করে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দিবে তবুও আপনার সাথে বিয়ে দিবে না কোনদিন।

তিনি বললেন প্রস্তাব পাঠিয়েই দেখি আমি বললাম অহেতুক আমার জীবনটাকে অসহ্য করে ফেলেন না আপনি। আমাকে ওরা বাসা থেকেই বের হতে দিবে না , জামালপুরেই আটকে রাখবে। আমার আম্মা ভীষণ জেদি আর রাগী, মেরে ফাটিয়ে দিবে।

অনেকদিন আর তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। তিনি চট্টগ্রামের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে বলেছেন আমি যেন অবশ্যই তাঁকে টেলিফোন করি। ১৯ শে সেপ্টেম্বর আমার ভাইভা পরীক্ষা শেষে ফরেন মিনিস্ট্রিতে লায়লা আপার অফিসে যেয়ে ফোন দিয়ে বললাম,কাল সকাল সাড়ে সাতটার তিস্তা ট্রেনে চেপে জামালপুর চলে যাচ্ছি। টিংকু ভাই বললেন কালই যাবে কিন্তু টিকেট টা একটু চেঞ্জ করে নাও। সকালে না যেয়ে বিকেলে যাও। সকালে আমি ঢাকায় ফিরবো আমার বাসায় কোনদিন আসনি একবার এসে অন্তত দেখে যাও। অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেও না বাসায় আমি একা থাকবো না টিটন আর রাজ্জাকও থাকবে। কাজের লোকও আছে।

বাসায় যাবো একা ! কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু উনি আমার সাথে কোনদিন অপ্রীতিকর কোন আচরণ করেননি। পুটু মনিকে বললাম আমার সঙ্গে চল।পুটু বলল ওর আজ মিডটার্ম পরীক্ষা সাথে যাওয়া সম্ভব নয়। সাহস করে বের হলাম সকাল ঠিক দশটায় ।আজ আমার পরনে সাদা একটি সূতির শাড়ি।

২৬ পুরানা পলটনের ৪ তলা, সেরিনা এপার্টমেন্টে ঢুকে আমি ‘থ’ বনে গেছি । রাজ্জাক, টিটন তো আছেই কিন্তু আরও আছে মগ বাজারের কাজী সাহেব। শাহিন ভাই (জাস্টিস ওবাইদুল হাসান শাহিন) আর এনায়েত ভাই (জাস্টিস এনায়েতুর রহিম) । বিয়ে পড়ানোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। অথচ কাল ঘুণাক্ষরেও আমায় বলেন নি।

বিয়ের আয়োজন দেখে আমি স্তব্ধ, কোন কথা বলতে পারছি না। পাশের রুমে টিংকু ভাই আমাকে রাজী করানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন তুমি আমাকে পছন্দ কর না, আমি বললাম করি, তিনি বলছেন ভালোবাসো না আমি বললাম হয়তো ভালোও বাসি কিন্তু পছন্দ করা আর বিয়ে করা কিছুতেই এক নয়, আমার আব্বা-আম্মা হার্ট ফেইল করবেন । আমি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

বললাম আপনার ”তুমহারি অমৃতা” দেখতে যাওয়া গার্ল ফ্রেন্ড কই?

বেইলি রোডে চটপটি খেতে যাওয়া গার্ল ফ্রেন্ড কই ?

তাঁদের যেয়ে বিয়ে করেন, আমি কেন ?

আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।

অনুনয় করে বুঝিয়ে বললাম কয়েক মাস পর বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় ফিরবো তা ছাড়া সামনের মাসেই আসছি তখন না হয় আমরা বিয়ে করবো।

এই মুহূর্তে আমি কিছুতেই তৈরি নয় এই বিয়ের জন্য ।

আমার কান্না শেষ হওয়া মাত্র টিংকু ভাই কান্না শুরু করলেন।

তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না মুন্নি।

আজ তুমি চলে গেলে এক মাস, এক বছর নয় কোনদিন আর ফিরে আসবে না আমি নিশ্চিত জানি।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো বুঝে গেছি বিয়ে না করে বের হতে পারবো না কিছুতেই। বাথরুমে ঢুকে কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগালাম, হাতের তালু দিয়ে চোখের কিনারের কাজলটুকু মুছে ফেললাম, কানের ছোট্ট রুপার দুল, হাতে পরা লাল রেশমি চুড়িও খুলে ফেললাম।

এই বিয়েতে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নেই, কোন আনন্দ- উল্লাস নেই । বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হই হল্লা, কন্যাদান, উৎসব মুখরতা কিচ্ছু নেই।

সামাজিক এবং পারিবারিক ভাবে বিয়েতে যে সম্মান, আদর, তৃপ্তি আর গুরুত্ব সবকিছুই এখানে অনুপস্থিত।

বিয়ের লাল বেনারসি, দু হাতে ভরে মেহেদী, গায়ে হলুদ আর পুরো শরীরে তাজা ফুলের মালা নেই । ন্যূনতম একটি নতুন শাড়িও নেই।

বিয়ে, আনুষ্ঠানিকতা আর সাঁজ নিয়ে প্রতিটি মেয়ের অনেক রোম্যান্টিক স্বপ্ন থাকে। সেই সব স্বপ্নগুলো চোখের সামনে একটি একটি করে ঝরে পরছে আর আমি নিঃশব্দে কাঁদছি ।

বিয়ে মানে বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসার আশ্রয়। বিয়ে মানে বাঁধ ভাঙ্গা খুশীর জোয়ার। কিন্তু আমার বিয়ে তো অন্য আর দশটা বিয়ের মত নয়।এ বিয়েতে খুশী কই, আনন্দ কই, নির্ভরতা কই, বিশ্বাস আর ভালবাসাই বা কই ?

ভবিষ্যৎ জীবনে এতো বড় চ্যালেঞ্জ, ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর স্বপ্ন ভঙ্গের অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কেবলই।

ওজু করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললাম আমি রাজী, কাজী সাহেব কে ডাকুন।

ভীষণ খুশী হয়ে হাসি হাসি মুখ করে টিংকু ভাই জিজ্ঞেস করলেন কাবিন কত হবে ?

মনের ভেতরে থাকা অসহায়ত্ব, তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইল। অভিমানকে আড়াল করে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ”এক টাকাও না, আমি আপনাকে মাগনা বিয়ে করবো।”

চলবে…

( ছবিটি এপ্রিল ১৯৯৪ এর )