ক্যান্সার (পর্ব১৩)

Photo of author

By Khugesta Nur E Naharin

আজও সকাল ৮ টাতেই ল্যাবে ঢুকেছি । কিন্তু কাজে মন বসছে না কিছুতেই। কেমন একটা অপরাধ বোধ ভেতর থেকে বার বার আহত করছে।

দুপুর তিনটায় হলের ডাইনিংরুম বন্ধ হয়ে যায় ।আর সন্ধ্যা সাত টায় হলের গেইট। সময়ের এক ঘণ্টা আগেই হলে ফিরে আনমনে ডায়নিং এর পাশের কয়েন বক্সটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো হ্যালো। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম ”আমি দুঃখিত টিংকু ভাই।”

টিংকু ভাই বললেন, ”তুমিও আমাকেই অপরাধী বানিয়ে দিলে? একবার জানতেও চাইলে না কেন, কি হয়েছিল সেদিন।”

এর পর হাউমাউ করে কান্না । পুরুষের এমন কান্নার সাথে পরিচিত নই, কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কান্না থামিয়ে একটু পর বললেন আমার সাথে এখন একটু দেখা করতে পারবে ?

আমি বললাম আপনি হলের গেটে আসবেন ?

তিনি বললেন, ”না মানুষ অযথাই তোমাকে ভুল বুঝবে।” ঝটপট নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে আসো । ১০ মিনিট যেতে লাগবে, ১০ মিনিট বইয়ের দোকানে ঘুরবে তারপর ১০ মিনিটে ফিরবে। ৭ টা বাজার আগেই ফিরতে পারবে।

নিউ মার্কেট আর নীল ক্ষেতের বইয়ের দোকান আমার প্রিয় জায়গা । মাসের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে প্রায়ই বই কিনতে যাই।ওখানে না যাওয়ার কোন কারণ নেই।

নিউ মার্কেটে বইয়ের দোকানে ঘুরছি। হঠাৎ পেছন থেকে টিংকু ভাই এসে বললেন চল আজ তোমাকে আমি বই কিনে দিব । উত্তরে বললাম আমি তো নিবো না। তিনি বললেন বিনিময়ে তুমিও আমাকে একটি বই উপহার দিবে।

টিংকু ভাই আমাকে সমরেস মজুমদারের বিখ্যাত ট্রিলজি উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ উপহার দিতে চাইলেন কিন্তু আমার এগুলো পড়া হয়ে গেছে।

আমি পছন্দ করলাম হুমায়ুন আজাদের ”নারী।”

বইটিতে তিনি আবুল হাসানের পংক্তি থেকে ধার করে লিখলেন –

” প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে

মনেও রাখবে না আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম

কেন আমি সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী

হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!”

নীচে লিখলেন প্রিয় মুন্নিকে ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু।

এবার তাঁর বই পছন্দের পালা। এতো এতো বইয়ের ভিড়ে শামসুল হকের ”আমি বাসি তুমি বাসতো” বইটি বেছে নিয়ে বললেন আমি এটা নিবো কিছু একটা লিখে দাও। বইয়ের নাম দেখে আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা এই বইয়ের পেজে আমার নাম আমি কি ভাবে লিখবো ! না লিখে উপায় নেই। অতঃপর লিখলাম ”টিংকু মানে নরম কোমল শিশুর ছায়া।” শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাইকে স্নেহের মুন্নি ।

১৯৯৩ এর বই মেলায় টিংকু ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল আচমকাই । তাঁর সাথে কে কে ছিল মনে নেই, আমার সাথে ছিল ছাত্রলীগের আনিস (বর্তমানে আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য)। সেদিন তিনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন খলিল জিব্রানের ”The Prophet” । বইয়ের পাতায় লিখেছিলেন ”Only the skay is your limit dear Munni” তারপর তারিখ দিয়ে তাঁর নাম।”

ঘটক হিসেবে টিংকু ভাইয়ের আবির্ভাবের আগে ঘটকের তালিকায় তদানীন্তন ছাত্রলীগ নেতা সুজন ভাই, আনসারি ভাই, অসীম দা, কামাল ভাই সহ অনেক পরিচিত মুখের সাথে আমার আদরের ছোট ভাই আনিসও ছিল।

আনিসের সাথে পরদিন সন্ধ্যায় কার্জন হল ফিরতি আমার দেখা। আনিস অবাক চোখে বলল ”শামসুল হকের বইডা তো তুমি আমার লগে কিনসিলা কিন্তু ওই বইয়ে তাঁর অটোগ্রাফ ছিল, টিংকু ভাই রে যে বইডা দিছ হেইডায় তো সেই অটোগ্রাফ নাই। কাহিনী কি কও দেহি ।”

তাঁর মানে টিংকু ভাই আমার কাছ থেকে ওই নামের বই কিনে নিয়ে এখন সবাইকে দেখাচ্ছে ! অপমানে আমার ভীষণ কান্না পেলো।

বেশ কিছুদিন তাঁর দেখা নেই ।

সারাদিন আমার ঠিকানা অর্গানিক কেমিস্ট্রি ল্যাব। কার্জন হলের মূল ফটক বন্ধ করার আগে আমার খোঁজ নিতে হবে আমি আছি কি নেই মশিউজ্জামান স্যারের নির্দেশ । ডিপার্টমেন্টের চাবিও মাঝে মধ্যে আমার কাছে থাকে। হলে পারমিশন নেওয়া আছে দেরী হলে অসুবিধা নেই। নিলুফার ম্যাডাম প্রভোস্টের কাছ থেকে এই পারমিশন নিয়ে দিয়েছেন। দেরী হলে একটু পর পর দারোয়ান রা এসে দেখে যায় বলে ঠিক আছেন আপা? কিছু কি লাগব?

ভর সন্ধ্যায় একদিন হঠাৎ টিংকু ভাইয়ের আগমন। এই সময়টা মূলত প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য। চারিদিকে প্রেমিক যুগল । কার্জন হল থেকে হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে বললেন ”আমি ইন্ডিয়া গেসিলাম তোমার জন্য একটা শাড়ি আনছি।”

রাগত স্বরে বললাম এক বই ই আপনি সবাইকে দেখাইছেন এখন আবার শাড়ি নিবো, কক্ষনো না। আমার কাছ থেকে বিনা পারমিশনে শাড়ি কিনছেন কেন? শাড়ি সবার কাছ থেকে নিতে নেই। আমি তো নিবোই না।

পাশ দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল তাঁর কাছ থেকে লাইটার নিয়ে বললেন আমি এক্ষণই জ্বালাইয়া দিব। ধুঁয়া উঠবে। এইখানে পোলাপান, দারোয়ান সবাই তোমাকে চিনে, তুমিই এখন সিনিয়র। সিন করতে না চাইলে শাড়িটা ব্যাগে ঢুকাও, জলদী।

শাড়িটা নিয়ে কোন কথা না বলে রিকশা ডেকে চলে যাওয়ার আগে বলে দিলাম কোনদিন পরব না আমি।

পরদিন বেহায়া লোকটা আবারও এসেছে। হাসতে হাসতে বলছে কালকের ব্যাবহারের জন্য দুঃখিত। তাঁর মাঝে এমন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল না হেসে উপায় নেই। হাসতে হাসতেই কত গল্প। এতদিনে সে জেনে গেছে এটা আমার হলে ফেরার সময়। হাসতে হাসতেই বলে ফেললেন, ”তোমার ইঞ্জিনিয়ারকে বাদ দিয়ে আমাকেই বিয়ে করছো না কেন ?”

ভীষণ রেগে যেয়ে দৃঢ়ভাবে বললাম এসব কথা পছন্দ করছি না আমি একদম। আমার গলায় এমন কিছু ছিল যা তাঁকে আহত করলো। নিচু গলায় আদ্র স্বরে বললেন, ”আমি জানি আমার যোগ্যতা নেই তোমাকে বিয়ের প্রপোজ করার।”

আমার কেমন মায়া হল।

একদিন রাতে হাউস টিউটরদের রুম থেকে ডাক এসেছে ফোন এটেইন করার জন্য। বন্যায় কক্সেসবাজার আঁটকে আছেন তিনি।বলছেন তোমায় দেখতে না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে মুন্নি। লাইনে ডিস্টার্ব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাঁচলাম।

আমার থিসিস পেপার জমা দিতে আর মাত্র একমাস বাকি।তারপরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ আমার মুক্তি। টিংকু ভাইয়ের সাথে আর কোনদিন গাড়ী চড়ে বেড়াতে যাইনি, ক্যাম্পাসের বাইরেও না, এক রিকশায়ও উঠিনি কোনদিন। পুলসিরাতের মত বড় সাবধানে পথ হেঁটেছি।

ফোন দিয়ে বললাম আমায় আজ লং ড্রাইভে নিয়ে যাবেন টিংকু ভাই।খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ”আসছি।”

গাড়ী ছুটছে, ক্যাসেটে গান বাজছে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ”কোন কারণে তোমার কি আজ খুব মন খারাপ?”

সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম। চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমি বললাম, ”আজ আমার ইঞ্জিনিয়ারের বিয়ে।”

গাড়ী সজোরে ব্রেক কষলেন, কিন্তু ধাক্কা খেলেন নাকি খুশী হলেন ঠিক বুঝলাম না। আমার হাতের উপর আলতো ছোঁয়া লাগিয়ে বললেন মন খারাপ করো না।ফিরতি পথে সাহাবাগের ফুলের দোকান থেকে বিশাল এক গোলাপের তোড়া কিনে দিলেন।

কদিন পর রুমে পত্র এলো । এরপর আসতেই থাকলো। প্রথম দিকের চিঠিগুলো বিষণ্ণতায় ভরা কিন্তু পরেরগুলো যেন এক একটি কবিতা। মানুষ এতো মেধাবী হয় এতো সুন্দর লিখতে পারে কি করে !

চলবে…