তখন সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে রংপুরে শুভেচ্ছা কোচিং এ ভর্তি হয়েছি….এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে বাইরে থাকা….যে কথা না বললেই নয় তা হলো, পড়াশোনায় বেশ ভালো হলেও আমার সমবয়সীদের তুলনায় আমি একটু বোকাসোকা ছিলাম…. সদ্য মায়ের আঁচল ছেড়ে আসা একটা ইমম্যাচিউরড মেয়ে —- যেদিন বাবা মা রেখে গেলো রংপুরে হাপুস নয়নে কাঁদছিলাম…. অই সময় আমার এলাকার এক আন্টি (পলি আন্টি) আমার থেকে সামান্য বড় হবে সেও একইসাথে কোচিং করতে এসেছিলো….সে আমাকে শান্ত করে, সেখানে একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে উঠে সেই সমবয়সী আন্টি…. একাধারে বান্ধবী আর অভিভাবক দুটোই…. ভালোই কাটছিলো কোচিং এর দিনগুলো….
প্রায় দুমাস পর সময়টা জুন -জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় হবে… প্রচন্ড বৃষ্টি… থামার নাম নেই… তিনদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি… আমাদের কোচিং সেন্টার ডুবে গেলো… হোস্টেল এর প্রথম তলা পানিতে ডুবে গেলো…. বন্যা আসছে, সবদিক থেকে খবর আসতে লাগলো…. হঠাৎ সিদ্ধান্তে আমাদের কোচিং বন্ধ দিয়ে দিলো…. বলা হলো সবাই নিজ দায়িত্বে যেনো নিরাপদ জায়গায় চলে যায়… বলাই বাহুল্য যে রংপুরে আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই……কোচিং এর মোটামুটি সবাই বেডিং বোচকা নিয়ে আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে যাচ্ছে….. শুধু বাকি আমি, পলি আন্টি আর খুশি নামে একজন….. তখন তো আর মোবাইল এর যুগ না…. টেলিফোনে কখনো লাইন পাওয়া যায় কখনো যায়না…. তবুও বুদ্ধি করে পলি আন্টি বাড়িতে শুধু এটুকু খবর দিতে পেরেছিলো যে কোচিং বন্ধ দিয়ে দিয়েছে আমরা যেভাবে হোক বাড়িতে আসছি…. অভিভাবকরা চিন্তায় পড়ে গেলো তারাও টিভিতে বন্যা পরিস্থিতির খবর পাচ্ছে আর আমরা দুইটা মেয়ে কিভাবে বাড়ি ফিরবো সেই চিন্তায় অস্থির …. বিকেল চারটার দিকে আমরা হোস্টেল থেকে নেমে আসলাম ব্যাগ বোচকা সহ…. হাটু পানি পেড়িয়ে যখন রাস্তায় উঠবো কিছু একটা লেগে আমার পায়ের অনেকটা জায়গা ছিলে গেলো…. উঃ মাগো বলে ককিয়ে উঠলাম… কিন্তু সব ভুলে আবার সামনে এগুলাম…. যেভাবেই হোক বাড়িতে যেতেই হবে…. তিনজনে রিকশা নিয়ে বি আর টিসি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম….. বাসে উঠে অনেকটা হালকা লাগছিলো…. কিন্তু সমস্যা হলো বাস দেরিতে ছাড়বে…. বৃষ্টির কারণে অনেকে আসতে পারছেনা…. এর মধ্যেই আবার আকাশ কালো হয়ে গেলো, সন্ধ্যা ছটা বাজে অথচ মনে হচ্ছে রাত আটটা…. মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো, এর মধ্যেই সাড়ে ছটা নাগাদ আমাদের বাস ছাড়লো…..বৃষ্টির কারনে খুব একটা স্পিড এ চলছিলো না বাস…. যাই হোক আটটা কি সাড়ে আটটা হবে আমরা সৈয়দপুর পৌঁছলাম…. পায়ের কাটা জায়গার ব্যাথা বাড়ছে….আর ভিতরে ভয় কাজ করছে আমরা ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছাতে পারবো তো? এক পর্যায়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম…. পলি আন্টি সাহস দিলো, বললো ভয় পেয়োনা, এখানে নেমে একটা ফোন করবো… আর নাপা নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করছি…. গাড়ির হেলপারকে দিয়ে ওষুধ আনানো হলো….আমি লক্ষ্য করলাম গাড়িতে আমরা তিনজন মেয়ে ছাড়া সবাই পুরুষ …. আর লোকসংখ্যা খুবই কম…… বাস ছাড়লো সৈয়দপুর থেকে…. আমি খুবই ভয় পাচ্ছি আর শুধু কান্না পাচ্ছে……কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া দিনাজপুরের ইয়াসমিন এর ঘটনা মনে আসছে…. আমি পলি আন্টিকে বললাম ভয়ের কথা…. সে বললো চলো সবাই একসাথে “”লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুন্তু মিনাজ্জোয়ালেমিন”” পড়তে থাকি….. চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়তে শুরু করলাম তিনজন….
এরমধ্যেই বাস চম্পাতলি এসে পৌঁছালো……এবার বাস থেমে গেলো… সামনে হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে…… কি হয়েছে?
সামনে কোনো রাস্তা নেই, সব পানিতে ডুবে একাকার…. চারদিকে শুধু পানি আর পানি….আর বৃষ্টি তো চলছেই…. কি ভয়ংকর অবস্থা…. বাস শুদ্ধ সবাই আল্লাহকে ডাকছে…… কতক্ষণ অপেক্ষা করলো, কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না…. হেলপার, সুপারভাইজার গাড়ি থেকে নেমে গেলো….. গাড়ির আলো পর্যাপ্ত না, তারা বড় বড় টর্চ জ্বালিয়ে সামনে রাস্তা দেখাতে লাগলো আর ড্রাইভার খুব আস্তে আস্তে গাড়ি নিয়ে আগাচ্ছে…… এভাবে প্রায় একমাইল রাস্তা পার হতে সময় লেগে গেলো একঘন্টারও বেশি…. পুরো সময়টা যে কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র গাড়িতে থাকা লোকজনই বুঝেছে….অবশেষে রাস্তার দেখা মিললো…. সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো…..আলহামদুলিল্লাহ পড়ে আবার যাত্রা শুরু……
এই অঝোর বৃষ্টি পাশ কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে আমাদের বাস এগিয়ে চলছে… এর মধ্যেই যাত্রী নামছে ভিজে জবুথবু হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে…. এভাবে চলতে চলতে ঠাকুরগাঁও রোডে যখন পৌঁছলাম তখন বাজে রাত বারোটার কিছু বেশি….আমার ঠিক মনে নেই কোনো একটা ব্রিজ এর কাছে একজন আমাদের জন্য ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে……আমরা নামলাম ব্যাগ বোচকা নিয়ে… এখানে যেটা না বললেই নয় সেটা হলো গাড়ির হেলপার, সুপাভাইজার, ড্রাইভার মামারা খুব বেশি আন্তরিক আর অনেক হেল্পফুল ছিলো…… সামনে ছাতা নিয়ে দাঁড়ানো যিনি উনি আমাদের দুজনেরই গান শেখানোর মামা “”বাবলু মামা””…… আমি একটু অবাক হলাম…. পলি আন্টি অনেক বুদ্ধিমতি ছিলো, সে সৈয়দপুর থেকে মামাকে ফোন দিয়ে বলেছিলো আমাদের বেশি দেরি হলে এখনে নামবো…. আর বাবলু মামা কতটা দায়িত্ববান সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা….. আমরা ভিজে জবজবে অবস্থায় মামার বাসায় গেলাম…. কাপড় চোপড় পাল্টে খাওয়ার টেবিলে দেখি মামি আমাদের জন্য সে এক বিশাল আয়োজন করেছে…..খিচুড়ি, ডিম ভুনা, বেগুন ভাজি, মাংসের যেনো কি একটা পদ ছিলো….. গরম গরম ধোঁয়া উঠা খাবার…. সারাদিন আর রাতের টেনশন নিমিষে দূর…
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে মামা গানের আসর বসালো…. মামা, মামি, পলি আন্টি, আমি একে একে সবাই গান গাইলাম…. আর এর মধ্যে চা পর্ব চললো…..এ করে ভোর চারটা…. এরপর ঘুমাতে গেলাম….. সকাল নয়টায় উঠে নাস্তা সেড়ে দশটার ট্রেনে উঠলাম পীরগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে….বাবলু মামাই আমাদের তুলে দিলো ট্রেনে…..প্রায় দেড়ঘন্টা পর পৌঁছলাম বাসায়…… বাসায় পৌছানোর সাথে সাথে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য, আম্মু আব্বুর টেনশন আর কান্না মাখানো মুখ, বুকের সাথে জাপটে ধরে চুমু খাওয়া…..আমার বাসা আমার স্বর্গে ভালোভাবে আসতে পেরে মনে আর শরীরে তখন এক প্রশান্তি…… সব আত্মীয় স্বজন একে একে আসতে লাগলো আর আমি আমার সেই ভ্রমণ এর সবটুকু তাদের খুব আগ্রহ ভরে বলতে লাগলাম…
এভাবেই শেষ হলো একটা বিভীষিকাময় যাত্রা….
~শিমু কলি