কখনও কবিতা লিখিনি জীবনে ।অনেকে শখ করেও তো দু এক লাইন লিখে কিন্তু কবি কন্যা হয়েও আমি ২০২০ ইং সালের আগে পর্যন্ত কখনও একলাইন ও কবিতা লিখি নাই ।আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা এক সাহিত্যে পরিমন্ডলে,আমাদের দিন শুরু হতো আব্বার কবিতা আবৃত্তি শোনার ভিতর দিয়ে। আব্বা কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও প্রবন্ধকার ছিলেন ।আমাদের বাসায় অনেক গল্পের বই, পত্রিকা, রাশিয়ান ম্যাগাজিন ছিলো।পড়াশোনার বাইরে আমার খুব আগ্রহ ছিলো বই পড়া। বাসায় যেহেতু আলমারী ভর্তি বিভিন্ন ধরনের বই ,তাই সুযোগ পেলেই আমি গল্পের বই, পত্রিকা নিয়ে বসে যেতাম।খুব ইচ্ছে হতো গল্প লিখবো, স্কুলে পড়বার সময় লুকিয়ে দু একটা ছোট গল্প লিখেছিলাম কিন্তু কখনও কবিতা লিখি নাই।
২০২০ ইং সালের জানুয়ারীতে এক বন্ধুর আমন্ত্রনে WAS83-তে আমাদের এস এস সি পাশের বন্ধু গ্রুপে যোগ দিলাম, এখানে এসে দেখলাম বন্ধুরা কি সুন্দর সুন্দর পোস্ট দেয় গল্প, কবিতা বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সুন্দর সুন্দর লিখা লিখে পোস্ট দেয়। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি । খুব ইচ্ছা হলো আমিও কিছু লিখি। শুরু করলাম যাপীত জীবন কাহিনী নিয়ে লেখালেখি। লিখে পোস্ট দেই গ্রুপে বন্ধুরা পছন্দ করে আমি উৎসাহ পাই, এইভাবে লিখা চলতে লাগলো। আমার আব্বা যেহেতু একজন সনেট কবি ,গ্রুপে কবি বন্ধুদের সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখা পড়ে খুব ইচ্ছা হলো, আমিও কবিতা লিখবো। তাই শুরু করলাম কবিতা লিখা। যদিও প্রথম প্রথম ঠিকমত লিখতে পারতাম না, নিজের লেখা নিজের কাছে সবসময় ভালো লাগতো না। তারপরও কি এক নেশা আমাকে পেয়ে বসলো সেটা হলো কবিতার নেশা।
রাত জেগে কবিতা লিখে গ্রুপে ও ফেসবুকে পোস্ট দেই। করোনা মহামারী চলছে সেভাবে আব্বার বাসায় যেতে পারি না, নিজের লেখা আব্বাকে দেখাতেও পারিনা কিন্তু দাদাভাইকে বলি আব্বাকে দেখাতে, কেমন লিখলাম! আব্বা পড়েন, মাঝে মাঝে যখন কথা হতো ফোনে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করতাম, কেমন হয়েছে? আব্বা বলতেন, খুব ভালো, লিখে যাও।
আব্বার মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে আব্বার বাসায় আমরা তিনবোন ও বাচ্চারা গেলাম, দুদিন থাকবো বলে। আব্বা সন্ধ্যার সময় আমাকে বললেন, তুমি তোমার কবিতাগুলো খাতায় লিখে আমাকে পড়ে শোনাও। আব্বা পাশে বসে আছেন, আমি একটি একটি কবিতা আব্বাকে পড়ে শোনাচ্ছি আর দেখছি আব্বার মুখ খুশীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। আমাকে বললেন, এইগুলো সব তুমি লিখেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ আব্বা। আব্বা বললেন তুমি খুব সুন্দর লিখেছো, তুমি কখনও আমার কাছে কবিতা লেখা শেখোনি, কত মানুষ আমার কাছে শিখেছে। কিন্তু তুমি এতো ভালো লিখেছো, আমি শুনে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি!! আমাকে আর শোনাতে হবে না, তুমি কবিতার বই বের কর।
আম্মাকে ডাকলেন আর বললেন ,শুনেছো তোমার মেয়ের কবিতা ও কত ভালো লিখেছে ,আমার থেকেও ভালো লিখেছে!! আমি হেসে দিয়ে বললাম, আব্বা কি বলেন এটা! কিন্তু আজ আমি ভাবি তখন সবে মাত্র লেখা শুরু করেছি অজস্র ভুল লেখায় কিন্তু সন্তানকে উৎসাহ দেবার জন্য বললেন, আমি আব্বার থেকে ভালো লিখছি!! এই রকমই স্নেহময় ছিলেন আমার আব্বা।
একসপ্তাহ পর ১৮ই জানুয়ারী ২০২১ ইং আব্বা মারা যান, মৃত্যুর আগের দিন আমাকে ফোন দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, লিখেছো নতুন কোনো কবিতা? আমি আমার পরিচিতজন, বন্ধু সবাইকে বলেছি, আর আপনাদের চিন্তা নাই, আমি মরে গেলেও আপনারা আমার উত্তরাধিকার পাবেন যে লিখবে, আমার বড় মেয়ে কবিতা লিখছে!! আমাকে বললেন মিতা, লিখবে কবিতা। লেখা ছাড়বে না কখনও। কবির মৃত্যু নাই, কবিরা বেঁচে থাকে মানুষের মনে তার লেখায়, কবিতা ও গানে।
আব্বার আকস্মিক মৃত্যুর পর আমি যখন গভীর শোকে আচ্ছন্ন তখন সারাক্ষন আব্বার ওই কথাগুলো আমার মনে বেঁজে চলতো, লেখো কবিতা লেখো। আমি আকড়ে ধরলাম কবিতাকে। আমার ভালোবাসা বেঁচে থাকবার অবলম্বন হলো কবিতা। আমি শোক কাটিয়ে আস্তে আস্তে শান্তি খুজে পেলাম কবিতার মাঝে।
আজ সব বন্ধুদের কাছে আমার পরিচয়, কবি শাহনাজ পারভীন মিতা। আমি যাই লিখি বন্ধুরা পছন্দ করে উৎসাহ দেয়। আমিও আমার প্রথম কাব্যগ্রনহ ‘কথামালা তুমি ‘বের করছি সব বন্ধুদের উৎসাহে আগামী বছর বাংলা একাডেমির একুশে বই মেলায় ইনশাল্লাহ।
করোনা মহামারী নিয়ে আমার লিখা কবিতা
মুক্তি দাও প্রভু
শাহনাজ পারভীন মিতা
কতদিন ছুঁয়ে দেখি না তোমায় সমুদ্রজল
কতদিন মাথার উপর উড়ে চলে না গাঙচিল,
যে নীল পাহাড় আমি চোখ মেলে চেয়ে দেখতে চাই
তাও রয়ে যায় আমার দু’চোখের আড়ালে।
আর কত কাল ,কত কাল করোনা তুমি
রইবে পৃথিবীর রুপ আড়াল করে,
দেখিনা প্রিয়জন আপনজন স্বজন আগেরই মতো
দু-ক্রোশ দূরে নয় কিন্তু যোজন যোজন দূরে সব ।
মুক্তি দাও প্রভু আমায় এই মহামারী হতে
মুক্ত কর এ দু’চোখ , দু’বাহু আমার ,
আমি স্পর্শ করতে চাই সব প্রিয়জন
মনের ভালোবাসায় বুকের বন্ধনে।
এই প্রানে এই মনে হৃদয়ে আমার
করোনা মুক্ত এক নতুন ধরণীতে ,
যেখানে হাসবে চাঁদ ,পাখি গাইবে গান
ফুটবে ফুল মানুষের গানে সুরে সুরে ,
আকাশ বাতাস সাগর পাহাড়ে
মানুষের মাঝে মায়াময় ভুবনে।