উত্তরা টু আজিমপুর – নীতুর জন্য ভালোবাসা

Photo of author

By Anwar Hakim

উত্তরা টু আজিমপুর
নীতুর জন্য ভালোবাসা।
আনোয়ার হাকিম।

নীতু বরাবরই ভাল স্টুডেন্ট। আমি মাঝারি মানের। এ নিয়ে নীতুর কোন এলার্জি নেই। আমারও। আমরা একই স্কুলে ও একই কলেজে পড়েছি। আমাদের বাসাও মফস্বল শহরের একই এলাকায় পাশাপাশি ফ্ল্যাটে। নীতুর বাবা সরকারি অফিসার। আর আমার আব্বা ডাক্তার। মূলতঃ কোচিং একাডেমী থেকেই আম্মার সাথে আন্টির পরিচয়। সময়ের সাথে সাথে সেই পরিচয় পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা পেয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে গলায় গলায় খাতির থাকলেও আমাকে নিয়ে আব্বা-আম্মার রাজ্যের ক্ষোভ। আব্বা ডাক্তার আর আম্মা ভার্সিটির উচ্চ শিক্ষিত। তাদের ছেলে মিডিওকার হবে এটা মেনে নিতে তাদের যার পরনাই কষ্ট। নীতুর আব্বা সরকারি অফিসার হলেও নীতুর মা’র শিক্ষা কলেজ অবধি। অথচ তাদের মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। এই সুক্ষ্ম খোঁচা তাদের অন্তরকে অনবরত খোঁচাতে থাকে। আমি তাদের একমাত্র সাবজেক্ট। আব্বা-আম্মার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবে। আমারও ইচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারিনা। কারণ ট্র্যাক রেকর্ড ভালো না। মনে আছে ক্লাস টেনে পড়ার সময় নীতুর সাথে বই আর নোট বিনিময় হত। সেটা পরিবারের গোচরেই। মেয়েদের বই-খাতা বেশ পরিপাটি আর সুগন্ধযুক্ত হয়। নীতুরও তাই। অন্যদিকে আমারটা যাচ্ছেতাই গোছের। আমার কথা হলো বই-খাতা ব্যবহারের জন্য, সুগন্ধি মাখিয়ে ইস্ত্রী করে পরিপাটি করে রাখার জন্য না।
এই নিয়ে নীতুর সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়। ঝগড়াটা আমার তরফ থেকে না। নীতু অনেকটা ইচ্ছে করেই করে। বলে, “ ছেলেরা সবাই কি এমন ছন্নছাড়া হয় নাকি”? আমি বুঝি নীতু ঝগড়া শুরু করার পাঁয়তারা করছে। আমি উত্তর দেই না। নীতু ছাদে ঘুরঘুর করছে আর এগাছ-ওগাছ নিরীক্ষণ করছে। উত্তর দিচ্ছি না দেখে প্রসঙ্গ ঘুরালো। বললো, “আমার টব কে ভেঙ্গেছে”? আমি কোন উত্তর দেই না দেখে বললো, “ নিশ্চয় তুমি”? আমি এবার আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। বললাম, “দেখো গায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করবা না। আমার এগুলো ভালো লাগেনা”। নীতু হাসে। বলে, “আরে গাধা গায়ে পাড়া না, ওটা হবে পায়ে পাড়া”। আমি তার দিকে কট্মট্ করে তাকালাম। দেখলাম তার চোখে মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। বুঝতে কষ্ট হয়না সে আমাকে উত্যক্ত করে মজা পাচ্ছে। আমি ছাদ দেওয়ালের কাছে গিয়ে বললাম, “ মজা নিচ্ছো? আমিও মজা নিতে জানি। তখন টের পাবা”। নীতু হাসিতে গড়াগড়ি যায় আরকি। বললো, “যে আমার বীরপুরুষ। তুমি মজা করতে জানো নাকি”? এরকম উত্তরের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার প্রতি নীতুর দুর্বলতা আমি প্রথম টের পাই ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার পর। টেস্টে বরাবরের মত নীতু ফার্স্ট। আর আমার পজিশন মাঝামাঝি। সব ভালো ছাত্রেরই কমবেশি আলাদা একটা গরিমা থাকে। নীতুরও আছে। আমি নীতুকে এড়িয়ে চলি দুই কারণে। এক, সে আমার চেয়ে ভালো ছাত্রী, আর আমাদের প্রতিবেশী। আর দুই নম্বর কারণ হলো, তাকে নিয়েই আমার পৌরুষে যত আঘাত। আব্বা-আম্মা সারাক্ষণ খোঁটা দেয়। নীতুর কথা পাড়ে। তার মত রেজাল্ট করতে বলে। তাকে দেখে শিখতে বলে। এস এস সি তে নীতু গোল্ডেন এ প্লাস। আমি জিপিএ ফাইভ। যা হবার তাই হলো। রেজাল্ট বেরোবার বেশ কয়েক মাস আব্বা-আম্মার শোক চলতেই থাকলো। উভয় পরিবারের যাতায়াতে, গেট টুগেদারে এই যাতনার মাত্রা আরো বাড়ে। নীতু আহ্লাদি করে আসর সরগরম করে রাখে। সবাই তাকে তোলা দিয়ে কথা বলে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আব্বা-আম্মাও নীতুর তারিফ করতে থাকে। প্রথম প্রথম আমল না দিলেও পরে বিষয়টা ব্যক্তিত্বের কোথায় যেন খচ্ খচ্ করে। যতই এভয়েড করে চলি নীতুকে সে ততই ঘন ঘন সশরীরে বাসায় এসে নানা প্রসঙ্গ পাড়ে। আব্বা-আম্মা তাকে খুব পছন্দ করে। আর আমি তাকে এড়িয়ে চলি। নীতু বাসায় এলে আমি কাজের অজুহাতে বেরিয়ে যাই। নীতু বুঝতে পারে। বলে, “আজকাল আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে”? আমি কোন উত্তর করিনা। দুর্বলের শক্তিই হলো নিরব থাকা। এতে অন্যরা মনে করে ভারি কলসি বাজে কম। অথবা নিভৃতচারী এবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর গোছের হবে। নীতু কি ভাবে জানিনা। তবে এই দুয়ের একটাও যে ভাবে না সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারি।
একদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল খাতার ভেতর একটা চিরকুট মিললো। তাতে লেখা “বেশি বেশি ভাব। মাকাল ফল”। আমি হতভম্ব। মানে কি? আমিও কম যাই না। খাতা ফেরত দেওয়ার সময় আমিও চিরকুটে লিখলাম, “মাকাল ফল থেকে দূরে থাকুন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতে গড়ুন”। ব্যস! শুরু হয়ে গেলো আমাদের চিরকুট বিনিময় খেলা। আমাদের মধ্যে এত দেখা-সাক্ষাত, ঘনিষ্ঠতা সত্বেও মোবাইল নম্বর বিনিময় হয়নি। আমার সাহস হয়নি নানা কারণে। এমনিতেই মেয়েদের মোবাইল নম্বর চাওয়া অভদ্রতা। আর চাওয়ার পরে যদি না দেয়? তাহলে আত্মসম্মানে লাগবে। মুখ দেখাবো কি করে? অবশ্য নীতুও কোনদিন চায় নি। কেন চায় নি জানিনা। একদিন নোটের কোণায় একটা মোবাইল নম্বর আবিষ্কার করলাম। কার? নীতুর? এক নোট চোদ্দ হাত ঘুরে। কার কে জানে? তবু টুকে রাখলাম।
রিং দেবো কি দেবো না ভাবতে ভাবতেই তিনদিন কেটে গেলো। নোট ফেরত দেওয়ার সময় মোবাইল নম্বরের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিলাম। ভাবলাম সাক্ষাতে নীতু এ প্রসঙ্গটা উঠাতে পারে। তখন বুঝা যাবে এটা কার আর কি উদ্দেশ্যে নোটের গায়ে লেখা? নীতুর এ ব্যাপারে কোন সাড়া নেই। একদিন ছাদে দেখা হতেই গায়ে পড়ে বললাম, “নোটে দেখলাম মোবাইল নম্বর লিখে রেখেছো। কেন? মেয়েদের নম্বর কি কেউ এভাবে লিখে রাখে? বিশেষত যে নোট চোদ্দ হাত ঘুড়ে”? নীতু চমকে উঠলো। বললো, “ তুমি কি রিং দিয়েছো নাকি”? বললাম, “ কেন? কার নম্বর? তোমার না”? নীতু হেসেই মরে যাচ্ছে। বললো, “আরে না না। তুমি একটা হাঁদারাম। ওটা তো আমাদের নতুন বুয়ার নম্বর। আম্মা জরুরি টুকে রাখতে বলায় টুকে রেখেছিলাম। কাটতে ভুলে গেছি। তুমি সত্যিই রিং দিয়েছিলে নাকি”? নিজেকে সামলে নিয়ে ভাব নিয়ে বললাম, “ না। মেয়েদের সাথে আমি ফোনে কথা বলিনা”। নীতু মৃদু হাসলো। বললো, “ বাব্বা! হেবি পাট নিচ্ছো দেখছি। আমি তো ভাবলাম আবেগের ঠ্যালায় ফোন করে বস্ছো”। আমি তাৎক্ষণিক অবজ্ঞা ভরে বললাম, “আমার আর খেয়ে দেয়ে কাম নেই। আবেগের ঠ্যালায় তোমারে ফোন দিমু”। নীতু কিছুটা বিচলিত হলো মনে হলো। মেয়ে মানুষের জেদ বেশি। হয় তর্ক করবে নাহয় পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেবে। দিলোও তাই, “দেখা যাবে। সময়ই সব বলে দেবে”। আমি চমকে উঠলাম। আমি তো মনে মনে চাই নীতুর নম্বর। ফোনে ফোনে কথা বলতে। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে সাহস করে বলেই ফেললাম, “ অত ভং চং না করে নম্বরটা দিলেই তো হয়”। নীতু চাঙ্গা হলো বলে মনে হলো। বললো, “এতই সহজ। খুব তো ভাব নিয়ে থাকেন সারাক্ষণ। বাসায় গেলেন বেরিয়ে যান। আপনার আবেগ নাকি উথলে উঠেনা”?
এভাবে নীতুর সাথে একান্তে আর গোচরে দেখা-সাক্ষাত আর কথা-বার্তা হতে থাকলো। এইচ এস সি তে অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট হলো। দু’জনেই গোল্ডেন। আব্বা-আম্মা খুশিতে দশখান। নীতু উচ্ছ্বসিত। আর আমি টেনশনে। আমি জানি আমার মেডিকেলে চান্স হবেনা। কিন্তু আব্বা-আম্মা যেন এতদিনে আশার আলো দেখতে পেয়েছে। তাদের ছেলে ডাক্তার হবে। আর আমার এক কথা আমি মেডিকেলে পড়বো না। বাসায় এ নিয়ে চরম অশান্তি। তারা ডাক্তারি ছাড়া অন্য কিছু মেনে নেবে না। আমিও মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হবো না। এ কথা নীতুর কানে গেলো। ততদিনে আমাদের ডায়ালগ প্যাটার্ন তুমি থেকে তুই-এ প্রমোশন পেয়েছে। একদিন নীতুর আম্মা বাড়ী এসে কান্নাকাটি করলেন। নীতু নাকি ডাক্তারি পড়বেনা। এ নিয়ে ওদের বাসায় তুমুল বাহাস হচ্ছে। আম্মা বিস্ময়ে হতবাক, আন্টিকে জানালেন আমার কথা। আমি নিজেও হতবাক। নীতু বরাবরই বলে এসেছে সে মেডিকেলেই পড়বে। এবারে না হলে আগামীবার ট্রাই করবে। নীতুকে ছাদে পাওয়া গেল। বললাম, “তুই নাকি পাগলামি করছিস”?
— তুইও তো করছিস। নীতুর পাল্টা উত্তর।
— আমার তো ডাক্তারি ‘এইম ইন লাইফে’ ছিলো না। তোর ছিলো। এখন হঠাৎ কি হলো?
— কিছু হয়নি। মাইন্ড চেইঞ্জ করেছি। তোর কোন সমস্যা?
— সমস্যা না। তবে কারণটা জানলে ভালো লাগত।
— জানলে কি করবি?
— কিছু করতে না পারলেও শুনতে তো পারি।
— কোন দরকার নাই। নীতুর গলা ভারি। চোখ ছলছল। বললাম, “কি হয়েছে বলবি তো”? নীতু চুপ করে থাকে। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। পরদিন মেডিকেল কোচিংয়ে গিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাসায় আব্বা-আম্মা মহা খুশি। ছেলের সুমতি হয়েছে। আম্মা খুশির চাপে এই কথা নীতুদের বাসায় গিয়ে ছেড়ে আসলো। একথা শুনে নীতুদের বাসায় তুলকালাম কান্ড ঘটে গেলো। নীতুর জন্য মায়া হলো। নীতুকে মেডিকেল একজামে বসাতে আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে না জানিয়ে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এতে তাদের বাসার পরিবেশ যে এত তিক্ত হবে বুঝতে পারিনি। নীতু পড়েছে মহাবিপদে। সে এখন হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই তিন শ’ ষাট ডিগ্রী ঘুরতেও পারছেনা। একদিন ছাদে দেখা হতেই সে জ্বলে উঠলো, “তুই পাইছস কি”? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, “ মানে কি”?
— মানে বুঝতাছিস না?
— না
— ভন্ড কোথাকার। লায়ার।
— বুঝলাম না
— বুঝবি কিভাবে? আমারে তো ডুবাইছস
— কিভাবে?
— তোকে রাজী করানোর জন্যই তো আমি এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলাম
— আমিও তো তোকে ফেরাতে এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছি। এখন তুইও এডমিশন নিয়ে নে।
— তোর মাথা। এখন রাজী হলে আমার লজিক কি হবে?
— আংকেল-আন্টিকে আমার কথা বলে বলবি ওই হাঁদারাম যদি মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারে তাহলে আমিও হবো।
— তোর মাথায় তো ঘিলু নাই, গোবরে ভর্তি।
আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “তুই তো চান্স পাবিই। আমার চান্স নাই”। নীতু প্রায় কান্না করে বলে উঠলো, “তুই একটা পাষাণ”। নীতু নেমে গেলো নীচে। মাগরিবের আযান চলছে। ছাদ থেকে ব্যস্ত শহরের নাগরিক ম্যুভমেন্ট দেখছি। সবাই ছোটাছুটি করছে। গাড়ীগুলোও। হঠাৎই মনে ঝিলিক মেরে উঠলো গতিই জীবন। আমার নিজের উপর আস্থা কম। কিন্তু নীতুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত মহাসড়ক ফেলে বাইলেন বরাবর ছুটবে তা হয় না। ছোট্ট একটা চিরকুটে লিখলাম, “তুই ঠিকই বলেছিলি আমি মাকাল ফল। আমার জন্য হলেও ডিশিসন চেঞ্জ কর প্লিজ। ট্রুলি লাভ ইউ”। কিন্তু কিভাবে তাকে দেবো ভাবছি। নীতু ইদানীং ছাদে কম আসে। বুক পকেটে চিরকুট নিয়ে ওপেক্ষা করি। কিন্তু নীতুর কাছে পৌছাতে পারিনা।
একদিন আন্টির ডাক পড়লো তাদের বাসায়। তারা বিপর্যস্ত। অনন্যোপায় হয়ে নীতুকে বুঝাতে আমার স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এই নাটকের জন্য আমার উপর নীতুর প্রচন্ড রাগ। সামনাসামনি হতেই বললাম, “পাগলামি করো না। তুমি তো ঢাকা মেডিকেলেই চান্স পেয়ে যাবা। আমার তো হবে না আমি জানি”। আন্টিকে বললাম, “ভর্তির টাকা আর ওর ডকুমেন্টগুলো আমাকে দিয়েন। আমি কাল মেডিকেল কোচিংয়ের ফর্ম নিয়ে আসবো”। এই বলে নীতুকে চিরকুটটা হাতে গুঁজে দিয়ে আমি চলে আসলাম। আন্টি খুশি।
মেডিকেল ভর্তি ফর্ম নিয়ে এসে নীতুকে দিলাম। নীতু একটা বায়োলজী রেফারেন্স বুক ধরিয়ে দিলো। আমার এতে ইন্টারেস্ট কম। সাধারণ বই পড়তেই ইচ্ছে করেনা। আবার রেফারেন্স বুক! তবু বাসায় এনে উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎই একটা চিরকুট নীচে পড়ে গেলো। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তাতে একটা ফোন নম্বর। নীচে লেখা, লাভ ইউ টু বাবু।