আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
লজিং মাস্টার
আনোয়ার হাকিম

পর্ব-২
আরেকটা বিপদ আচমকা যুক্ত হলো। এই চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ীর একটিতে যে আমার সহপাঠী কেয়ারা ভাড়া থাকে তা আমার জানা ছিলো না। আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি। তবে সব সময় পারিও না। ভাল ছাত্রের তকমা থাকায় সহপাঠীরা পাঠোদ্ধারের জন্য আসত। তাদের মধ্যে মেয়েরাই একটু বেশি। এদের বিভিন্ন ছল, বিভিন্ন আবদার। সবই বুঝি কিন্তু মেধাবীর স্বীকৃতির ঘ্রাণ সুমিষ্ট বোধ হওয়ায় এড়িয়ে যেতেও মন সায় দেয় না।

একদিন শীতের বিকেলে দুরন্ত বিপ্লবকে বশে আনবার প্রয়াসে ব্যাট বল খেলছিলাম। প্রশস্ত ছাদের এক কোণায় শুকনো কাপড় নেওয়ার নাম করে ছায়ার ছায়া ঘুরঘুর করছে। এমন সময় অকস্মাৎ কেয়া এসে হাজির। আমাকে দেখে সে সশব্দে এমন আবেগ প্রকাশ করলো যেন পারলে সিনেমার নায়িকার মত দু’হাত প্রশস্ত করে বাহুলগ্না হয়। সেই আবহসংগীতসহ দৃশ্য ছায়া’র নজরে এলো। শীতের বিকেল টুপ করে ছাদে সন্ধ্যার আগমনী ছায়া ফেললো। একটু পরেই মাগরিবের আযান দেবে। এরপর রুটিন মোতাবেক দুরন্তকে ঘন্টাখানেক সাইজ করার দায়িত্ব। দুরন্ত বিপ্লবকে বিদায় করলাম। ছায়া বিস্ময়ের ঘোর অমানিশা নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। বাকি থাকলাম আমি আর কেয়া। কেয়ার সে কি আনন্দ! সন্ধ্যায় আমাকে কেয়াদের বাসায় যেতেই হবে এই তার বায়না। কোন কথাই সে শুনবে না। মান-সম্মানের বিষয়টি বরাবরই আমার প্রায়োরিটি লিস্টের শীর্ষে থাকে। শীতের এই কাল সন্ধ্যায় সহপাঠী কেয়ার সাথে কেউ এভাবে দেখলে কি থেকে কি ভেবে বসে থাকবে কে জানে? আর তার সাথে কি এমন কথা থাকতে পারে যে অধিককাল চলতে পারে? বলে রাখা ভালো কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে তো বটেই পুরো কলেজেই হাতেগোনা নীলাঞ্জনা টাইপের মধ্যে সে অন্যতমা। কেয়া ভালো আবৃত্তি করে, ভাল গান গায়। কলেজের প্রতিযোগিতায় এ দুই বিভাগে সে চ্যাম্পিয়ন।
এরুপ বিব্রতকর ও ইতস্ততবিক্ষিপ্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলাম ছায়া দুরন্ত বিপ্লবকে নিয়ে ছাদে কি খুঁজতে যেন ফিরে এলো। বুঝলাম কেয়ার উপস্থিতি চাক্ষুষ করতেই তার এই অনাবশ্যক আগমন। মাগরিবের আযান চলছে। আমি কেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় যাবো এই ওয়াদা কবুল করতে বাধ্য হলাম। কেয়া নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর ছায়ার আর থাকার আবশ্যকতা নেই। দেখলাম আমার এ ভাবনা যথার্থ। হাসিও পেলো। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো। বিসিএস আর ম্যাজিস্ট্রেট ভিন্ন আমার আর কোন এজেন্ডা নেই। থাকতে পারেনা। থাকা উচিত না। সন্ধ্যার পর কেয়াদের বাসায় গেলাম। কেয়ার আম্মা অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। রাশভারি। তাই বাসায় থাকলেও তাঁর দর্শন মিলেনি। কেয়া তাদের একমাত্র সন্তান। কেয়াকে এতই উচ্ছ্বল লাগলো যা আগে কোনদিন দেখিনি। বুঝলাম তার মনে প্রচুর আনন্দ খেলা করছে। আর মননে কি খেলছে তা জানার সাধ্য নাই। এদিকে ঘটেছে আরেক বিপত্তি। কেয়াদের বাসায় অপরিকল্পিত এই সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার খবর দুরন্ত বিপ্লবকে জানাতে ভুলে গেছি। এই নিয়ে কারো অনুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি যে ছায়ার মনঃপূত হয়নি তা বুঝতে বাকি থাকলো না।

বিসিএস এর প্রিপারেশন জোরেশোরে চলছে। আমার কাছে মাস্টার্সের চেয়ে এটাই এখন টপ প্রায়োরিটি। কলেজ বন্ধ। ঘন ঘন বাড়ী না গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বাবার তাগাদা অব্যাহত। এরকম একদিনে বসে বসে ভাবছিলাম অনেক কিছু। জীবনের রঙ কিরুপ? উদ্ভট এ জিজ্ঞাসা মননে মগজে কেন এলো বুঝে উঠতে পারলাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মনে হলো জীবনের রঙ স্বচ্ছ প্রিজম কাঁচে আলোর প্রতিসরণের মত। যেভাবে আলো ফেলবেন ঠিক সে বরাবর অগ্রসর হবে না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।

দুরন্ত বিপ্লবকে বশীভূত করার প্ল্যান প্রাথমিক ভাবে ক্লিক করেছে। আমি তার সার্বক্ষণিক খেলা বিষয়ক সাথী। বিশেষত ক্রিকেটের। এভাবে সে হয়ে উঠেছে আমার অনুরক্ত ভক্ত। আমার চূড়ান্ত প্ল্যানও কাজ করেছে এক শর্তে। বিকেলে ক্রিকেট, নো ইন্টারফেরেন্স। আর বাকী সময় পড়ালেখা, নো ছলচাতুরী। এক্ষেত্রে আমাকে প্রায়ই নানা উপলক্ষ্য তৈরি করে প্রাইজ হিসেবে কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। মানুষের সামনে টার্গেট না থাকলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে মৃগী রুগীর মত ভীমড়ি খেতে থাকে। ইংরেজী আর অংকে সে কাঁচা। ভালো করলেই পুরষ্কার মিলবে এমন ঘোষণায় কাজ হলো চমৎকার। আন্টি ডেকে পাঠালেন। বাসায় ঢুকতেই পোলাও পোলাও গন্ধ। বুঝলাম আজ রীচ ফুড হবে। কলিং বেল টিপতে দেরি কিন্তু দরোজা খুলতে সময় লাগলো না। ছায়া দাঁড়িয়ে। ছায়ার সাথে আমার কথা হয়না তেমন। সেও বলেনা। কিন্তু মুখটা দুখু দুখু করে রাখে। যাদের মুখশ্রী সুশ্রী তাদের এরকম দুখু দুখু মুখ আলাদা বিভা ছড়ায়। বললাম, “ভালো আছো”? সোজা উত্তর না দিয়ে বললো, “আসেন। ভেতরে এসে বসেন”। আন্টি এলেন। তারিফ করলেন। ছায়া যে দরোজার আশপাশ দিয়ে অযথা যাতায়াত করছে টের পাচ্ছি। দুরন্ত বিপ্লব এলো। আন্টি উঠে গেলেন। বললাম, “এবার অংকটাকে কুপোকাত করতে হবে”। বিপ্লব মাথা নাড়লো। আচমকা বলে ফেললো, “আপু অংকে আমার চেয়েও কাঁচা”। আমি বললাম, “কে বললো? তুমি বুঝলা কেমনে”? ছায়া দরোজার পাশেই ছিলো। বললো, “বিপ্লব এদিকে আয়”। বিপ্লব গেলো না। মুচকি হেসে বললো, “ধরা খেয়ে আপু লজ্জা পেয়েছে”। যাহোক, একদিন ছাদে ছায়াকে পেলাম। সাজুগুজু করে এ সময় ছাদে আসার কোন অর্থ নেই। বললাম, “তোমাকে তো ছাদে এখন কম দেখি”।
— ঠিকই আসি। আপনিই দেখেন না। ছায়ার ত্বরিত উত্তর।
— সে কি রকম? আমি তো ছাদেই বাস করি।
— কেয়া আপু আছে না?
রোগের লক্ষ্মণ ধরা পড়েছিলো আগেই। আজ এর কারণ জানা গেল। বললাম, “কেয়ার সাথে তোমার কি? সে তোমার সিনিয়র আর আমার ক্লাসমেট”। ছায়া নিরুত্তর থাকলো। বললাম, “পড়াশোনা কেমন চলছে”?
— পড়াশোনা ভালো লাগেনা
— তাহলে কি ভালো লাগে?
— জানিনা।
— বাহ। কিছুই ভালো লাগেনা?
— লাগে
— সেটা কি?
— বলা যাবে না।
সিঁড়িতে কেয়ার কথা শুনে বলে উঠলো, “ওই যে আপনার প্রিয় বান্ধবী আসছে”। বলেই নেমে গেল। কেয়া এলো। ছায়া নেমে গেলো। ছাদ থেকে কাপড় নিতে নিতে কেয়া বললো, “লজিং মাস্টার ভালো আছেন”? আঁতে ঘা লাগলেও নিছক দুষ্টুমী ভেবে পাল্টা মিসাইল ছুঁড়ে দিলাম, “কেন জ্বলছে নাকি”?
— হুম্ম। খুব জ্বলে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। কি করছো?
— বিসিএস প্রিপারেশন
— প্রিপারেশন না ছাই। ওই মেয়ে সারাক্ষণ তোমার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করে কেন? যখনই ছাদে আসি তখনই দেখি
— এ তোমার ভারি অন্যায়
— বাহ। খুব দরদ দেখছি তার জন্য
— লিভ ইট। তোমার খবর কি?
— খবর ভালো না
— কেন? কি হয়েছে?
— বিয়ের কথা হচ্ছে
— ভালো তো। পাত্র কি করে?
— বিসিএস ক্যাডার
— বাহ। ঝুলে পড়ো
— অত সহজ না। না করে দিয়েছি
— কেন? চয়েস আছে নাকি?
— আছে তো।
— তাহলে তাকেই করে ফেলো
— সমস্যা আছে
— কি সমস্যা?
— সে তো কেলাস টাইপের। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আর ইদানীং বালিকা নিয়ে।

তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি আহত হলাম। বললাম, “এ তোমার ভুল ধারণা”। “পুরুষ মানুষদের চেনা আছে” বলে কেয়া চলে গেলো। কি চেনা আছে বুঝলাম না। বাবা-মা’র কথা মনে হলো। আমি কি টার্গেট থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি? দুরন্ত বিপ্লবের রেজাল্টের অভাবিত উন্নতি হলো। এই দেখে আন্টির আবদার ছায়াকে শুধু ম্যাথটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে। বিসিএস প্রিপারেশনের দোহাই পেড়েও কিছু হলো না। রোজ এক ঘন্টা করে ফ্ল্যাটে গিয়ে ম্যাথ বুঝাতে হলো। এতে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ। ছায়া উৎফুল্ল। আমি যত সিরিয়াস। ছায়া তত অমনোযোগী। সিলেবাসের বাইরেই তার মনযোগ বেশি। আমাকে ঘিড়ে তার প্রচুর কিওরিসিটি। খালি গল্প করতে আর কথা বলতে চায়। আমার শংকা বাড়তে থাকলো। অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে পাগলামী স্বভাব প্রকট হয়। যাকে কাছে পায় তাকেই পছন্দ হয়। ভালো লাগে। ক্ষণিকের মোহ আরকি। বাবার বন্ধুর মেয়ে। একটু সন্দেহ বা কোন ঘটনা ঘটলে আমার জীবন যতটুকু না চৌচির হবে তার চেয়ে বেশি হবে বাবা-মা’র। যেদিন থেকে এই পার্ট টাইম ডিউটি খাটছি সেদিন থেকে কেয়ার ম্যুড অফ। আমার কোনই ভূমিকা নেই কোন কিছুতে। অথচ উভর পক্ষের মামলায় আমি একমাত্র আসামী।

চলবে…