আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
লজিং মাস্টার
আনোয়ার হাকিম

পর্ব-১
আমার বিপদ অবর্ণনীয়। অসহনীয়ও বটে। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি গ্রামদেশে জায়গীর মাস্টারের শেষ পরিণতি হয় ঘর জামাই হিসেবে। প্রাইভেট টিউটরের সাথে ছাত্রীর প্রেম অবশ্যম্ভাবী। আর সহপাঠীর সাথে প্রেম কাহিনী সর্বজন বিদিত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একেক জনের কপালে একেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। আর তার পরিণতিও একেক রকম হয়ে থাকে। কিন্তু একসাথে এই ত্রিশংকু অবস্থা কারো জীবনে নাযিল হয়েছে বলে শুনিনি। আমার হয়েছে সেই দশা।

ছোটবেলা থেকেই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় বাবার বিশেষ দৃষ্টিতে পড়লাম। সাথে অসীম ছাড়। আম্মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। কারো কুনজরে যেন বিদ্ধ না হই সেজন্য মাঝে মধ্যেই আচমকা জড়িয়ে ধরে দোয়া-দরুদ পড়ে বিশাল বিশাল ফু দিতেন। ছোট ছিলাম। পরীক্ষা বা টেনশনের কিছু হলে আমিও আম্মার কাছে গিয়ে ফু দাবী করতাম। জুনিয়র স্কলারশীপেও গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পেলাম। বাবার প্রত্যাশা বাড়তে থাকলো। মুখে সুখের হাসিও ঝিলিক দিতে থাকলো। পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আর সহপাঠীদের কাছে বলা যায় হিরো বনে গেলাম। বাবা উপজেলা সদরের ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। রোজ রোজ সাইকেলে প্যাডেল চেপে আসা-যাওয়া করতাম। মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্ট হলো। পাল্লা দিয়ে অপত্য স্নেহও বাড়তে থাকলো।

শহরের ভালো কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো বিচিত্র। পড়াশোনার বাইরে আমার অন্য ধান্ধা নাই। সহপাঠীদের সমীহ যেমন পাই তেমনি মশকরাও সহ্য করতে হয়। কলেজের কো-এডুকেশনে খাপ খাইয়ে নিতে তাই অনেক কোশেশ করতে হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারিনি। কলেজ জুড়ে মেধাবীর তকমা পেলাম বটে কিন্তু ইনোসেন্ট আর হাবাগোবার মিশ্রণজাত এক ধরণের খোঁচাও খেতে হত প্রায়ই। বাবার বড় আশা আমি বিসিএস দেবো। ম্যাজিস্ট্রেট হবো। ডিসি হবো। গ্রামের বেসরকারি স্কুলের মাস্টার হিসেবে এটাই তাঁর সর্বোচ্চ আশা।

আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনোই স্বচ্ছল ছিলো না। এর যাতনা আমি যতটা টের পেতাম, বাবা-মা ভোগ করতেন ততোধিক। আমরা এক ভাই এক বোন। বোনটি বড়। রুপে ও গুণে সে অদ্বিতীয়া। একদিন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলো। বাবা নিমরাজী হলেও মা গোঁ ধরলো। তাঁর বক্তব্য মেয়ে মানুষের জন্য ইন্টার পাশই যথেষ্ট। ছেলে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। সম্পর্কীয় এক মামা এই প্রস্তাব এনেছেন। বলাচলে একরকম জোর করেই বিয়ের কথা প্রায় পাকা হয় হয়। শুভস্য শীঘ্রম বলে একটা কথা আছে। এটা আর কিছুর ক্ষেত্রে না হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গ্রামদেশে এটাই সর্বজন মানিত। এমন অবস্থায় আমার বুক ঠেলে কেন জানি থেকে থেকে কান্না আসতে থাকলো। বোনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। একবার একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে রাজী কিনা। ছোট ভাইয়ের কাছে এতদসম্পর্কীয় কথা বলতে লজ্জা হলেও এক পর্যায়ে কাছে এসে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “রাফি, আমি এখনই বিয়ে করতে চাইনা”। তার এ কথাটা বুকে যেন শাবল মারলো। কিছু একটা করা জরুরি জ্ঞান করে বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, “বাবা, আপু এখন বিয়েতে রাজী না। আপনি শক্ত থাকেন। আম্মাকে আমি ম্যানেজ করবো”। বাবা বিস্মিত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কথা তো প্রায় পাকা হওয়ার পথে”। ছোট চাচা চালাক চতুর টাইপের। নিঃসন্তান। আমাদের দু’জনকে সন্তানবৎ আদর করেন। তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। তিনিই মজলিশে চমৎকার বোমা ফাটালেন, “মেয়ে ডিগ্রী কমপ্লিট করতে চায়। লেখাপড়ায় মা শা আল্লাহ ভালো। তাই আমরা পরে পারিবারিক ভাবে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদেরকে জানাবো”। তাঁর এ বক্তব্যে আলোকোজ্জ্বল প্যান্ডেল যেন সহসাই নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। অতিথিরা লা জবাব হয়ে ফিরে গেলো। আম্মা আমার উপর, তারচেয়েও বেশি ছোট চাচার উপর নাখোশ হলেন। তাঁর মুখ ভার দেখে আমি গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা, আমি কি কোনদিন তোমাদের অবাধ্য হয়েছি”? আম্মা চোখ তুলে আমাকে জড়ায়ে ধরে বললো, “বাবারে, মেয়ে হওয়ার কষ্ট তুই কি বুঝবি”? সত্যিই আমি অতশত বুঝি না। আমার প্রতি বাবা-মা’র অগাধ আস্থা। তাদের ধারণা আমি জ্ঞানে-গরীমায় তাদের চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। এজন্য এ যাত্রা বোন পরিত্রাণ পেলো। তাঁর খুশি খুশি ভাব দেখে আমার নিজেকে সফল বলে মনে হলো। এরপরের কাহিনী আরো করুণ। স্কুল থেকে সাইকেল চেপে বাড়ী ফেরার পথে বাবা পিচ্ছিল রাস্তায় অন্যমনস্কতার কারণে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদিতে বিস্তর টাকা খরচ হলো। জমি যা ছিলো তার প্রায় অর্ধেক বিক্রি করতে হলো। আর বাকি অর্ধেক বন্ধক রাখা হলো।

সংসারের এরুপ আর্থিক অবস্থার মধ্যে আমি জেলা শহরের কলেজে অনার্সেই ভর্তি হয়ে গেলাম। বাবা খুব মর্মাহত হলেন। তাঁর পক্ষে এর চেয়ে ভালো কিছু করা যে সম্ভব না তা তিনিও ভালো জানেন। যদিও তাঁর সাধ ছিলো ভিন্ন। ভালো মান নিয়ে অনার্স পাস করলাম। বাবা একদিন কাছে ডেকে বললেন, “বাবা, মাস্টার্স করো অসুবিধা নাই। তবে বিসিএস এর প্রিপারেশনও চালিয়ে যাও”। আমি বিস্ময়ে এই প্রথম তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বিসিএস করলে বিশেষ কি হবে? বাবা বললেন, “ম্যাজিস্ট্রেট হবা”। ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথে পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষা হলে বার কয়েক পরিচয় হয়েছে। তাকে নিয়ে হেড স্যার থেকে প্রিন্সিপালসহ সবাই তটস্থ থাকত। তোষামোদে ব্যস্ত থাকত। এর বেশি কিছু উত্তাপ অনুভব করতাম না।

ছোটবেলা হতে কোনদিনই বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হইনি। মূলত তাদের কাছে আমার কোন বেয়ারা বা বাড়তি আবদারও ছিলো না। বিনিময়ে সংসারের ভারি ভারি সিদ্ধান্তের সময় আমার শলা-পরামর্শ বিশেষ মর্যাদা পেতে থাকলো। সে যাহোক, বোনের বিয়ের সে পাত্র সম্মন্ধে একদিন খবর এলো যে আগে সে গোপনে বিয়ে করেছিলো। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। সে ঘরে তার সন্তানও আছে। এ খবর শুনা মাত্র বাবা-মা আমাকে সংসারের সকল ভালো-মন্দের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। আমার কাঁধ ভারি হলো। বয়স আন্দাজে আমার চলাফেরায় ভারিক্কি চাল ভর করলো। তবে বাবার ওই এক কথা বিসিএস দিতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। শক্ত হৃদয় বলে কোন কালেই আমার খ্যাতি ছিলো না। এই ফেরে পড়ে এখন তা আরো কোমল হলো।

একদিন জেলা সদর থেকে ফিরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাবা বললেন, “সব ফাইনাল করে এলাম। এখন থেকে শুধু পড়াশোনা করবা। টাকার কথা চিন্তা করবা না। প্রয়োজনে আরো এক কানি ক্ষেত বিক্রি করবো”। আমার কান্না পেলো। পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই। চেপে বুক ভারি করাই রেওয়াজ। তাই করলাম। আর মনে মনে পণ করলাম বাবার খায়েস পূরণই আমার একমাত্র কাজ। আমার জন্য বাবা তাঁর বন্ধুর বাসার চিলে কোঠায় অব্যবহৃত এক রুম যৎসামান্য মাসোয়ারার বিনিময়ে রফা করলেন। বাক্সপেটরা সমেত একদিন আমাকে নিয়ে তার দ্বারোদঘাটনও করলেন। বাবার সে বন্ধুর সাথে, তার পরিবারের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। আন্টির প্রতিটি কথাতেই যেন মায়ার প্রলেপ মাখা। প্রারম্ভিক পর্যায়েই স্বস্তি বোধ হলো। তাদের এক ছেলে। ছোট। নাম বিপ্লব। ক্লাস টেনে উঠেছে। অবসম্ভব চঞ্চল। ছাত্র ভালো তবে পড়াশোনা বাদে আর সব কিছুতেই পজিটিভ। আমি তাকে দুরন্ত বিপ্লব বলে ডাকি। তাদের আরেক মেয়ে। বড়। নাম ছায়া। পারিবারিক প্রথম পরিচয় পর্বে পাশের রুমের দরোজার কাছে কারো ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিকে নজর পরায় সেই ছায়াকে চকিতে মিলিয়ে যেতেও দেখলাম। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না যে সেই ছায়া ছায়া’র ছিলো। ছায়া এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাবার সেই বন্ধু প্রাইভেট কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। অত্যন্ত সজ্জন, অমায়িক। বাবার সাথে তাঁর জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট হলো, তাঁর দুরন্ত বিপ্লব-কে পড়াশোনার ক্রিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট ক্রিজে সে ইতোমধ্যেই অলরাউন্ডার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুরন্ত বিপ্লবের সূত্রেই আমার প্রাইভেট পড়ানোর ইনিংসের সূচনা হলো। অন্যদিকে তিন বেলা আহারের ব্যবস্থাও তাদের বাসা থেকে গ্যারান্টেড সাব্যস্ত হলো। আর এর মাধ্যমে আমার লজিং মাস্টারের যাত্রাও শুরু হলো। ভাগ্য ভালো যে ছায়ার পড়াশোনার দায়িত্ব স্কন্ধে চাপেনি।

চলবে…