আজিমপুর টু উত্তর – আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো (সূচনা পর্ব)

Photo of author

By Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা।
  • আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।
  • আনোয়ার হাকিম।


মৌমিতার এক কথা। তার পক্ষে আমার সাথে আর এভাবে রিলেশন টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তার এ অনুযোগ নতুন কিছু না। এর আগেও বহুবার এরকম অভিযোগ এনে সে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছুদিন পর যেচে এসে কান ঝালাপালা করা শুরু করে দিয়েছে। তাই এবারের হুমকিকে বরাবরের মত আমলে নেইনি। ভেবেছিলাম কিছু দিন গেলেই পাখী ফিরে আসবে। কিন্তু এবারের বিরতি ঢের প্রলম্বিত হচ্ছে। ফোনে তাকে পাওয়া যাবেনা জানি। ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপেও পাওয়া যাচ্ছেনা। যাবে কি করে? আমি তো ব্লক লিস্টেড।
অফিসের কাজে মন নেই। ক’দিন যাবত অফিসের পরিবেশও ভাল না। নতুন বস এসেছেন। এসেই আগেকার সব কিছু খারাপ, তাই পরিত্যাজ্য শ্লোগানে সবাই পেরেশানির মধ্যে আছি। আগের বস ব্যবহারে চামার প্রকৃতির হলেও কারো উপর কলম প্রয়োগ করেন নি। এই বস দেখতে আগের জনের চেয়ে পরিপাটি, পোষাকে-আশাকে ও কাজে-কর্মে। কিন্তু কথায় কথায় কলম ধরতেও ওস্তাদ। কয়েকটা চামচা জুটেছে তাঁর সাথে। পুরো অফিসটাকে সার্কাস্টিক করে তুলেছে। আমার সাথে বসের প্রথম সাক্ষাৎ মোটেই সুখকর ছিলনা। বসের সালাম মানে অবশ্যপালনীয় সাক্ষাত। টুক করে অস্ফুট স্বরে সালাম ঠুকতেই তাঁর কোপানলে পড়লাম, “সালাম দিলা না ঢুস মারলা?” আমি অপ্রস্তুত। ‘স্যরি’ বলে নিষ্পত্তি করতে গিয়ে পড়লাম আরো ভেজালে। ম্যানার আর এটিকেট সম্মন্ধে লম্বা লেকচার শুনলাম। বলাচলে ক্লাউন বনে গেলাম। চামচারা চারপাশ আলোকিত করে বসে আছে। তাদের মুখে আমার প্রতি পরিহাস আর বসের প্রতি কৃতজ্ঞতার বত্রিশ দন্তের এক্সিবিশন। মেজাজ তিরিক্ষি। কিন্তু করার কিছু নেই। চাকরি বলে কথা। করিডোরে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা। তাদেরও মুখ কালো। তাদেরও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অফিসে এক ধরণের অস্বস্তি ও রাখঢাক ভাব। এমন সময় মৌমিতার ফোন, কই তুমি?
— অফিসে
— এখনই বের হও
— কেন?
— এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না
— নতুন বস। মার্শাল ল’ চলছে
— সে তোমার বস। আমার না
— তো
— আমি ওসব বুঝিনা। বের হও আমি অপেক্ষা করছি।
— এ মুহুর্তে অফিস লিভ করা যাবে না। তুমি আসো
— আমি পারবো না। আসবে কিনা বলো
— বললাম তো সম্ভব না
— ঠিক আছে।
কথা বলতে গিয়ে দেখি লাইন নেই।
মৌমিতার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত আকস্মিক। সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছি। সরকারি চাকরি। বাবার পছন্দের। আমারও। চাকুরীজীবিদের জন্য বছর শেষে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন নেওয়ার নিয়ম। সবাই দুই প্রস্থ ফর্ম নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে। সে এক এলাহী কান্ড। নির্ধারিত প্রফেসরের চেম্বারের সামনে লম্বা লাইন। একজন কর্মচারী সেগুলো জমা নিচ্ছে। আমি একজনের রেফারেন্সে গিয়ে পড়লাম বিপদে। কর্মচারীটা আমার দিকে কিভাবে যেন দৃকপাত করলো। আমি এর কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না। দেখলাম ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে অনেকেই বিজয়ের হাসি হেসে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম নগদানগদি কারবারের ক্যাটালিস্ট কাজ করছে। আমার এতে আপত্তি। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার ডাক পড়লো। নির্ধারিত রুমে ঢুকেই পড়লাম জেরার মুখে। এক লেডি ডক্টর বসে আছেন। মুখ না তুলেই বললেন, “হাইট কত সেন্টি”? আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বললাম, “ভুলে গেছি”। লেডি ডক্টর মুখ তুলে তাকালেন। বললেন,”কি বললেন”? বললাম, “ভুলে গেছি”। বিস্ফারিত চোখ মেলে শব্দ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বললেন, “মানে”? আমি স্থির হয়ে বললাম, “বমি আসছে। মাথা ঘোড়াচ্ছে”।
— প্রেসার আছে? তার প্রশ্ন
— জানিনা। মাপিনি কোন দিন
— ডায়াবেটিস?
— জানিনা
— বড় ধরনের কোন অসুখ?
— জানিনা।
লেডি ডক্টর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন চোখে-মুখে, কপালে ফুটিয়ে তুলে কলিং বেল চাপলেন। পিওন এলো। ফরমগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, “উনাকে নিয়ে গিয়ে এগুলো করিয়ে আনেন”। আমি অসহায়ের মত সেই পিওনকে অনুসরণ করলাম। রুম থেকে বেরোতে গিয়ে পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাম, আমার কি সাংঘাতিক কিছু হয়েছে”? লেডি ডক্টর এবার হেসে উঠলেন। বললেন, “যান তো”। আমার মন কেন জানি নেচে উঠলো। যাকগে সেসব। হাইট, প্রেসার ইত্যাদি মেপে আবার ফিরে এলাম সেই ম্যাম এর রুমে। দেখলাম তিনি সিঙ্গারা খাচ্ছেন। সামনে ছোট্ট ফ্লাক্স। চায়ের। বললেন, “হয়েছে?” ফরমগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর ইনিশিয়াল দিয়ে পিওনের হাতে দিয়ে বললেন সাথে যান।
ফর্ম হাতে অফিসে পৌছা মাত্রই ফোন। আন নোন নম্বর। ধরলাম। সেই লেডি ডক্টরের। ভুলো মনে তার টেবিলে আমার ফোল্ডার ফেলে এসেছি। ফোল্ডারেই আমার মোবাইল নম্বর ছিল। মন ইউরেকা উত্তেজনায় থেকে থেকে নেচে উঠছে। ভাবছিলাম এইসব অনেক কিছু। আবারো বসের সালাম।
রাতে ব্যালকনিতে বসে নচিকেতার গান শুনছিলামঃ হাজারো কবিতা, বেকার সবই তা। তার কথা কেউ বলেনা। সে প্রথম প্রেম আমার, নীলাঞ্জনা। আমি নীলাঞ্জনাকে পেয়ে গেছি। সে উত্তেজনাতেই মন নেচে উঠছে, কি থেকে কি করি এই অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে। দ্বিধা চেপে রেখে ফোন দিলাম। রিং হলো। রিসিভ হলোনা। গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। সকালে নাস্তার টেবিলে মোবাইলে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখি ক্ষুদে বার্তাঃ এত রাত জেগে কি করেন? শরীর খারাপ হয়ে যাবে- মৌমিতা। খুশীতে লাফ দিতে মন চাইলো। আম্মা সামনে বসে থাকায় চেয়ারেই দৃঢ় হয়ে বসে থাকলাম। তবে ভেতরে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে। অফিসে গিয়ে রিং দিলাম। অনেক ক্ষণ পর রিসিভ হলো, “বলেন”।
— অসুখ- বিসুখ রাত বিরেতেই হয়।
— কি হয়েছে?
— বুক চিন চিন করছে
— কবে থেকে
— এই তো কয়েক দিন থেকে
— ডাক্তার দেখান
— সেজন্যই তো ফোন দিয়েছিলাম। ধরেন নি। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল জাতীয় যদি হত
— কথা তো ভালই জানেন দেখছি
— এপয়েন্টমেন্ট কি হবে?
— কিসের?
— ডাক্তারের
— যাকে দেখাবেন তার চেম্বারে যান। কন্টাক্ট করেন
— আপনাকেই তো দেখাতে চাই
— দেখাতে না দেখতে?
— দু’টোই
— দু’টোর কোনটাই হবে না।
— কেন?
— প্রথমত আমি হার্টের ডাক্তার না। আর দ্বিতীয়ত আমি চিড়িয়া না যে দ্রষ্টব্য হবো।
এভাবেই মৌমিতা আমার নিত্যদিনের দ্রষ্টব্য হয়ে উঠে। আমাদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তবু জমে ভাল। আমি আবেগী। মৌমিতা সারাক্ষণ অপারেশনের সিজার হাতে ফোর ফোরটি ভোল্টের মত। আমার ভাল লাগে। সুন্দরীদের দেমাগ থাকে জানি। আর এই দেমাগই তাদের রাগের পাওয়ার হাউস। রাগলে মৌমিতার গাল দু’টো আরো রক্তাভ হয়। একটু ফোলা ফোলা ভাব থাকে। চোখে আলাদা তেজ প্রস্ফুটিত হয়। আমি আরো রাগাই। মৌমিতা ফিক করে হেসে উঠে , কখনো চুপ মেরে বসে থাকে।
তার সাথে বিপত্তির শুরু আমার এক মহিলা কলিগকে নিয়ে। নাম শমরিতা। ঘটনার শুরু এক ট্যুরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। অফিসের কাজে তার সাথে যেতে হয়েছিল বান্দরবান। দু’দিনের জন্য। কথা প্রসঙ্গে আর ছবি শেয়ার করার আহাম্মকির কারণে বিষয়টি যে মৌমিতার কাছে সন্দেহের প্রশ্নবোধক ট্যাগ হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। সেই থেকেই থেকে থেকে এই অন-অফ খেলা। চরম বিপত্তি বাধে বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে। শমরিতার কিছু কেনাকাটা আছে ওখানে। আমারও একটা মোবাইল সেট কেনা দরকার। অফিসের গাড়ীর সুবিধা পাওয়ায় দু’জন একসাথে গিয়েছি সেখানে। মোবাইল সেট কিনতে গিয়েই দেখা হয়ে গেল মৌমিতার সাথে। আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বে কুশল বিনিময় হলেও বিষয়টা যে পরে কুরুক্ষেত্র বাধাবে তা আঁচ করতে পেরে ক্রমাগত ঢোক গিলতে থাকলাম। মৌমিতা তাড়া আছে বলে বলা চলে ইচ্ছে করেই চলে গেল দ্রুত। আমি কিছু বুঝতে না দিলেও আর সহজ করতে পারছিলাম না নিজেকে। মোবাইল সেট আর কেনা হয়নি সেদিন। এরপর যথারীতি মৌমিতার ফোন বন্ধ। খোলা থাকলেও রিং দিলে ধরেনা। একদিন পেয়ে গেলাম হঠাৎ। বললাম, ফোন ধরোনা কেন?
— ধরতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কি আছে?
— এরকম বলছো কেন?
— কি বলবে বলো, আমি ওয়ার্ডে রাউন্ডে যাবো
— দেখা করতে চাই
— কেন? কলিগ আছে না? তাকেই তো সারাক্ষণ দেখছো। তাকেই দেখে রেখো। রাখছি।
জানি শমরিতা ফোবিয়ায় তাকে পেয়ে বসেছে। নারী যতই স্বাবলম্বী হোক, যতই আয় রোজগারি হোক যতই উদার আর উচ্চ শিক্ষিত হোক এই একটি জায়গায় তার সন্দেহ, ভয়, আর হিংসা তাকে সাধারণ নারী পর্যায়ে নামিয়ে আনে। কই, আমি তো শার্লক হোমস সেজে কখনো ভাবিনি তার পুরুষ কলিগদের সাথে তার কি সম্পর্ক? আদৌ কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা? পাগলের মত তার চেম্বারে গিয়েছি। পাইনি। ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। প্রফেসর রাউন্ডে আছে তাই ঢুকিনি। মৌমিতা আর বের হয়নি। এভাবেই যোগাযোগহীন চলছে অনেক দিন। এরকম অবস্থায় মানুষের আচরণে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, যা সে নিজেও বুঝতে পারেনা। নিকটজনেরা পারে। আম্মার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। তাঁর নানারুপ তত্ত্বতালাশে আমি বেজায় বিরক্ত। এরমধ্যে শুরু হয়েছে পাত্রী দেখার তাগিদ। তাঁর জানাশোনা এক মেয়ে আছে। পাবলিক ভার্সিটির লেকচারার। দেখতে অপরুপা। একহারা গড়ন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। ঢাকায় বাড়ী, গাড়ী সবই আছে। এক বাপের একমাত্র সন্তান। বলা চলে রাজকন্যা। পাত্রী হিসেবে দশে দশ দেওয়া যায়। কিন্তু মৌমিতা আলাদা। তার রেটিং একান্তই মনের। মনের এই অবস্থায় শমরিতার টেক কেয়ার আরো বেড়ে গেছে। বাসা থেকে নানান খাবার নিয়ে আসে। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত দেয়। এগারোটায় চা খেতে খেতে আলাপও হয়। শমরিতা কি তার পরিধি বাড়াচ্ছে? বুঝতে পারিনা। এমনিতে সে খুব সুন্দর, জড়তাহীন। উদার। এক ধরণের মেয়ে আছে যাদের দেখলেই দিনটা ভাল হয়ে যায়। একটু হাসলেই মনে হয় শীতের সূর্য একটু দিলখোলা হয়েছে। একদিন এমনই এক চা চক্রে অফিসে বসেই নানা আলাপ চলছিলো। হঠাৎই গম্ভীর হয়ে শমরিতা বলে, “একটা কথার ঠিক ঠাক উত্তর দিবে?”
— বলো
— তোমার কি কিছু হয়েছে?
— না তো
— সে তো বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, বাই দা ওয়ে, সেদিনের সেই মহিলাটা কে ছিল?
— লেডি ডক্টর
— ব্যস, এটুকুই?
— তো
— তুমি কি কিছু আড়াল করছো?
— না তো
— উনি সেদিন ওভাবে হুট করে চলে গেলেন যে
— আমি কি করে বলবো?
— আর ইউ ইন আ রিলেশন উইথ হার
— ডোন্ট নো।
সেদিনের পর থেকে শমরিতা বেশ ফরমাল। হাই- হ্যালোতে আমাদের নিত্যদিন দেখা হয়, কথা হয়। রাখঢাক হয়। চোখাচোখি হয়। তার মুখের ভাষা বুঝি। শমরিতার কি তবে অন্য কোন চিন্তা ছিল? তার সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর আগের মত নেই।
এদিকে আম্মার চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। তিনি প্রায় একরকম কথা দিয়েই ফেলেছেন সেই লেকচারার পাত্রীর বাবা-মা’কে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কোন ভাবেই মৌমিতাকে রীচ করতে পারছিনা। মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারলাম, মৌমিতা এখন আর সেখানে পোস্টেড নেই। এম আর সিপি করতে ইংল্যান্ড চলে গেছে বেশ ক’দিন আগে। মাথাটা চক্কর মেরে উঠলো। এবার সত্যি সত্যিই বমি বমি লাগছে। মনে হয় সুগার লেভেল নেমে গেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
অফিস এখন আর কোনভাবেই আকর্ষণ করেনা আমাকে। শমরিতার মধ্যেও আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। পাত্রী পক্ষ দ্রুত এগোচ্ছে। আম্মা তার চেয়ে বেশি। আমি ততোধিক ব্যাক ফুটে।
হঠাৎই হোয়াটসঅ্যাপে মৃদু গুঞ্জন তুলে মৌমিতার ক্ষুদে বার্তাঃ আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।

চলবে…