আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(৯)
সেলিমের জামিন হয়েছে। তবে দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা। জামিন পেয়ে সে কোথায় গিয়ে উঠবে? বড় মামার কড়া হুকুম আমাদের বাসায় না। মান-ইজ্জত যা গেছে সেটুকুই যথেষ্ট। নতুন করে সবার কাছে আর পরিহাসের পাত্র হওয়ার দরকার নেই। আম্মারও তাই মত। মলি ভোট দানে বিরত। আমার কাছে মনে হলো জামিন পেয়ে একবারের জন্য হলেও বাসায় যাওয়া উচিত। অন্তত তাতে আমাদের আশেপাশের আর অন্য ফ্ল্যাটবাসীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাবে যে হয়রানীমূলক বা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়েছিলো। বড় মামা একথা শুনে আমার মুন্ডুপাত করতে চাচ্ছে। ছোট মামা তাকে বুঝালেন। সেলিম জামিনে মুক্ত হয়ে বাসায় এলো। এসেই মলির রুমে গিয়ে সটান শোয়া দিলো। কোথায় সে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে, কান্নাকাটি করবে, অপরাধ স্বীকার করে আর করবেনা মর্মে মুচলেকা টাইপের কিছু একটা বলবে। কিন্তু এর কোনটাই করেনি। উল্টো তার হাবভাব এমন যে আমরাই অপরাধী। মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিন্তু কিছু করার বা বলার উপায় নেই। তার নিজ বাড়ীতে যাবারও কোন উদ্যোগ নেই। মলিরও এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। ভাবটা এমন যে সোনার টুকরো পিতলা ঘুঘু হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এখানেই সেলিমদের তেলেসমাতি। ওরা জানে কোনটা কার উইকনেস আর কোনটা স্ট্রেংথ। ফোন দিয়ে বললাম, “এখন কি করবা”?
— জানিনা। তার সংক্ষিপ্ততম উত্তর।
— কেন?
— মাথা কাজ করে না
— আস্তে আস্তে চিন্তাভাবনা শুরু করো।
— জ্বী
— বাড়ী যাবা না?
— ইচ্ছে নাই
— কেন?
— ফ্যামিলি প্রেস্টিজের ব্যাপার
— আমাদের এখানেও তো একই ব্যাপার
— তাহলে অন্য কোথাও চলে যাবো।
— আমি কি তাই বলেছি?
— বেশিদিন শ্বশুর বাড়ি থাকা ঠিক না।
— মলি কি বলে?
— সে কি বলবে? দোষ তো আমার।
— তাহলে তার মুখের দিকে চেয়ে কিছু করো
— জানিনা।
এরকম জেগে ঘুমানো ছেলেকে আর কি বলা যায়? আম্মাকে বললাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুধু। আর বললেন তাকে কিছু না বলতে। মলি মাইন্ড করে।
মিটিং আর ওরিয়েন্টেশন কোর্সে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছি। আমি আসবো শুনে সেলিম চুল কাটার নাম করে উধাও। আবারো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেলো তাকে নিয়ে। এদিকে মলি আমার উপর মহা ক্ষ্যাপা। সেলিমের সাথে আমার ফোনালাপ মলিকে বলে দিয়েছে সে। অনুমান করছি যতটা না অপব্যাখ্যা করেছে সে, তার চেয়ে বেশি বদ অনুমান করে নিয়েছে মলি নিজে। সকালে অফিসে যাই। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। সেলিমের পাত্তা নেই। মলিও জানেনা কোথায়। বাসার পরিস্থিতি সেই আগের মত। মলির রুম বন্ধ। খায় তো খায় না। রুমের বাইরে আসে তো আসেনা। কথা বললে উত্তর দেয় তো দেয় না। কি যে একটা বিদঘুটে অবস্থা। আম্মার অবস্থা আরো খারাপ। বড় মামা বেজায় বিরক্ত। সিরাজগঞ্জের বন্ধুর কাছে খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানে যায় নি। ওদের বাসায় খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানেও যায় নি। খবর দিয়েও হয়েছে আরেক ঝামেলা। ছেলের জন্য যেন তাদের দরদ এতদিনে উথলে উঠেছে। পুনরায় নিখোঁজ সংবাদে তাদের মাতম শুরু হয়ে গেছে। একদিন জানা গেলো যাত্রা বাড়ীতে তাদের এক দুঃসম্পর্কীয় দুলা ভাইয়ের ওখানে গিয়ে ঘাটি গেড়েছে। তারাও ত্যক্ত। বিজনেস করবে তাই টাকা চাচ্ছে। অনুমান করতে অসুবিধে হলো না যে, এ ছাড়া তার বিকল্প কোন পথ খোলাও নাই। অবশেষে অনেক বলে কয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।
কয়দিন যাবত শরীর খুব খারাপ। দুর্বল আর খাবার রুচি কমে গেছে। শরীরের সাথে মনের যোগাযোগ যে কত নিবিড় তা অসুস্থ না হলে বুঝা যায়না। বিশেষত রাতে অসহ্য লাগে। মনে থেকে থেকে যতসব অলুক্ষণে কথা এসে হাজির হয়। শুধু হাজিরই হয়না। সম্ভাব্য অশুভ পরিণতিও দেখাতে থাকে। এর মাত্রা আরো বাড়ে যখন চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যাও। স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়েছি। বললেন, কিছুনা। টেনশন কাজ করছে তাই এমন হয়েছে। বললেন, “এই বয়সে এত টেনশন কিসের? খাবেন-দাবেন আর ঘুড়ে বেড়াবেন। চাকরি তো ভালই করেন। বিয়েশাদি করে ফেলেন”। আব্বার কথা মনে পড়লো। ছোট বেলাতে দেখেছি কারো খেতে ইচ্ছে না করলে তিনি ধরেই নিতেন, বাথরুম ক্লিয়ার হয়নি। কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষ্মণ। কখনো কখনো তাঁর কথা সত্যিও হত। আবার কখনো ক্লিনিক্যাল টেস্টে অন্য কিছু ধরা পড়ত। আর এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মাদার অফ অল ডিজিসেস হলো এই টেনশন। ডাক্তাররাও এটা ধরে নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে থাকেন। আর রোগী যদি তরুণ বয়সের হয় তাহলে তো অবধারিত ভাবে সন্দেহের তীর এফেয়ারস আর এতদসংক্রান্ত টানাপোড়েনের উপর গিয়ে পড়বে। কি ভেবে যেন ডাক্তার মৃদু হাসলেন। কথা যে বেশ খানিকটা সত্য তা উপলব্ধি করে ঢোক গিললাম। কি কি সব ওষুধ দিলেন। সাথে মাসল রিল্যাক্স ও টেনশন রিলিফের ওষুধও। বললেন, “আপনার ঘুম দরকার। এগুলো খান। ভাল ঘুম হলেই ঠিক হয়ে যাবে”। সেই ঘুম আর আসেনা। একেবারে ভোরের দিকে শরীর ক্লান্ত হয়ে নার্ভ যখন আর কুলিয়ে উঠতে পারেনা তখন ঘুম আসে। ছুটির দিন হলে অসুবিধে হয়না। কিন্তু অফিস দিনে হয় বিপত্তি।
আমাদের বাল্যবন্ধু লালনের জিএফ সম্পর্ক কাট অফ করে দিয়েছে। তৌহিদের কাছে জানলাম, তার অন্যত্র বাগদান হয়ে গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কি করে জানিনা। পারিবারিক পর্যায়েই এই ব্যবস্থা হয়েছে। লালনকে ফোন দিতে স্বস্তি পাচ্ছিনা। বুঝতে পারি তার বুকের ভেতরের দহন জ্বালা কত তীব্র! অথচ তাদের রিলেশন আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে সৌরভ ছড়াতো। মানব-মানবীর মধ্যেকার সম্পর্ক অনেক ভেরিয়েবলস এর উপর ভর করে এগোয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই প্রেম-ভালোবাসায় অনেক বাধার চিত্র পাওয়া যায়। ব্যাক্তি স্বাধীনতার এযুগে প্রেম আজকাল সামাজিক আর পারিবারিক ভাবে অনেকটাই স্বীকৃত। এই রিলেশন নিয়ে অনেক কথা চালু আছে। ফেবু পেইজে কেউ “ইন এ রিলেশন” সেঁটে দিচ্ছে। কেউ কনফিজড হয়ে লিখছে “ইন এ কমপ্লিকেটেড রিলেশন”। আজকাল ভালবাসা প্রমান সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় কথায় প্রমিজ করা আর ভাঙ্গা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাসা বাড়ীতে কারেন্টের সুইচও এত অন অফ করতে হয়না যতটা ব্রেক আপ আর ব্লক ব্লক অনুশাসন চলে। আস্থার অগ্নি পরীক্ষা দিতে তাই উভয়ের পাসওয়ার্ড উভয়ের করতলগত থাকে। তাই ফেবু জুড়ে সচিত্র প্রেমের উদগীরণ দৃশ্যমান। আসল আর মেকির এই ভেল্কি দুর্বোধ্য ও অসহনীয়।
লালনের জন্য মন কেমন যেন করছে। তৌহিদকে বললাম ওকে এখানে নিয়ে আসতে। প্রাকৃতিক এই নিসর্গে ভাল লাগবে।
এমন সময় আম্মার ফোন। বাসায় কুরুক্ষেত্র অবস্থা। ভোরে সেলিমের সাথে মলির তুমুল কথা কাটাকাটি। দরোজা বন্ধ। ডাকাডাকি করলেও দরোজা কেউ খুলছে না। এই কিছুক্ষণ আগে মুখের উপর ব্যাগ ছুড়ে মেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে মলি। সেলিমও ত্যাড়ামো করে সেই ব্যাগ সম্বল করে ঝটিকা বেগে বেরিয়ে গেছে। কেন এই অবস্থা বিস্তারিত জানা না গেলেও আম্মা যতটুকু জেনেছে সে মলির কাছে টাকা চেয়েছে। অথবা গয়না। বিদেশ যাবে। মলি নাকচ করে দিয়ে বলেছে তাকে ওদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে রাখতে। সেখানেই টুকটাক কিছু করতে। আব্বার অবর্তমানে আম্মাই আমাদেরকে মানুষ করেছে এতকাল। তার শরীর যথেষ্ট খারাপ। তারচেয়ে আরো খারাপ তার মানসিক অবস্থা। পৃথিবীতে সুখের সংবাদ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পেরেশানির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে তার সুখের স্মৃতিগুলো। কয়েকদিন আগে পেপারে দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে দ্রুত বাড়ছে। আমাকে দেওয়া ডাক্তারের ওষুধগুলোর বেশির ভাগই নার্ভ রিলাকসেশন ও নিউরো ধাঁচের। তাহলে কি আমিও সেপথে এগোচ্ছি?
চলবে…